একজন দরবারী / মডারেট ফেসবুক দায়ী আমাদের মুজাহিদ ভাইদের সাম্প্রতিক অপারেশনের ব্যাপারে নীচের লেখাটি লিখেছেন। আলেম ভাইদেরকে এই মডারেট দায়ীর তৈরীকৃত সন্দেহ-শুবুহাত দূর করার মতো দলীল ভিত্তিক উত্তর আশা করছি।
উল্লেখ্যঃ এই লোকের বেশ কিছু ফলোয়ার থাকায় অনেক মানুষ উনার মাধ্যমে ভ্রান্তিতে পরে যেতে পারে। তাই, দলীল ভিত্তিক উত্তর জরুরী। গালাগালি কিংবা কটুক্তি কাম্য নয়।
==========
এই হত্যাকান্ডগুলো কারা ঘটাচ্ছে আসুন সেই রাজনৈতিক বিতর্কে আমরা নাহয় নাই জড়ালাম। যেহেতু ধর্মীয়-রাজনৈতিক ধুম্রজাল অত্যন্ত বিস্তৃত তাই আমরা সবাইকে বেনিফিট অফ ডাউট দিই। কে এই কাজ করেছে এই ব্যাপারে আমরা কথাই না বলি।
কিন্তু আমরা মুসলিমরা কি এই হত্যাকান্ডগুলোকে সমর্থন করবো? এই দায়ে যে যাদের হত্যা করা হচ্ছে তারা এমন কিছু কাজে জড়িত যা ইসলাম সমর্থন করে না? এবং এই হত্যাকান্ডগুলোকে সমর্থন না করার মানেই কি এই দাঁড়াবে যে আমরা ঐ অনৈসলামিক কাজগুলোকেও সমর্থন করি? নাকি আমরা বড় পরিসরে ব্যাপারগুলোকে যাচাই করে দেখার দিকে আহ্বান করছি কেবল?
এটা তো আমাদের অজানা নয় যে বহুদিন হয়ে গেল আমাদের দেশ কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ মাত্র, এখানে ইসলামকে সামষ্টিক ভাবে বোঝার চর্চা এখনও খুবই সীমিত। এবং এটা কেবল আজকের কথা নয়, বহু দশক হয়ে গেছে আমরা একটি টোকেন ইসলামের চর্চা করে আসছি। এরকম একটি পরিবেশে সেক্যুলার চিন্তাভাবনা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার যে মডার্নিস্ট ব্যাখ্যা - যা পুরো বিশ্বে প্রধানতম আদর্শের স্থান নিয়ে নিয়েছে - এখানেও যে তা আস্তে আস্তে শিক্ষিত সমাজের প্রধান আদর্শিক অবস্থানে রূপ নিয়েছে তাতে আমাদের খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু অবাক হয়ে ওঠার তো কিছু নেই। বহুদিন ধরে ইসলামের আদর্শিক সত্যকে বুদ্ধিবৃত্তিক লেভেলে তুলে ধরার মতো কিছুই তো আমরা করতে পারিনি। সেরকম ইন্সটিটিউশন, ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানের চর্চা আমরা যারা ইসলামের ঝান্ডা বহন করি তারা তো গড়ে তুলতে পারিনি - এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় কী আমাদের আছে নাকি এটা স্বীকার করার মতো সৎ সাহস এবং বাস্তব জ্ঞানও আমাদের হয়ে ওঠেনি?
নবীজী (সা.) তার সময়ে যা কিছু করেছেন তার কোনোটিই অবু দশ বিশ ত্রিশ গুনে করা হয়নি। তেমনটি দাবী করা হলে সেটা হবে আল্লাহ্* ও তার রাসূলের (সা.) প্রতিই মিথ্যাচার। তার দা'ওয়াত ও তার জিহাদের প্রতিটি ঘটনাই ছিলো হিকমাহ্* বা প্রজ্ঞা অবলম্বন করে। এখন কারও কারও মনে হচ্ছে হিকমতের নাম নিয়ে সব কিছুকে জলবৎ তরলং করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি ধর্মীয় ইস্যুর পেছনে হিকমাহ্* থাকাটা যে নবীজীর (সা.) সুন্নাহ তা আপনি কীভাবে অস্বীকার করেন? আল্লাহ্*র একটি নাম যে আল-হাকীম তা কীভাবে অস্বীকার করবেন? হিকমাহ্* শব্দটি যে কুরআনের একটি দর্শন সেটি কীভাবে অস্বীকার করা হবে?
ইবনুল কায়্যিম, ত্রয়োদশ শতাব্দির একজন শ্রেষ্ঠ 'আলেম, বলেছেন হিকমাহ হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি সঠিক পদ্ধতিতে করা। কখনই হিকমার এই অর্থ করা হয়নি যে নবীজীর (সা.) সীরাতের কোনও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে স্থান কাল পাত্রের হিসেব না করেই প্রমাণ হিসেবে বর্তমান সময়ে প্রয়োগ করে দেয়া হবে। ইবনুল কায়্যিম যে কথাটি বলেছেন সেটি খেয়াল করুন। আপনার সত্যিই কী মনে হয় যে আমরা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি সঠিক পদ্ধতিতে করছি? নাকি আমরা এতটাই দাম্ভিক ও স্বধার্মিকতায় এতটাই মোহিত যে এই প্রশ্ন নিজেদের কিছুক্ষণ সময় নিয়ে করার মতো মানসিকতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি?
ইসলামের স্বার্থেই আসুন আমরা এই হত্যাকান্ডগুলোর বিরোধিতা করি। এইজন্য নয় যে আমরা কোনও ইসলাম বিরোধী কাজকে সমর্থন করি। এজন্যই যে আমরা মনে করি আমাদের স্থান ও কালে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক। আমাদের ইসলামের সৌন্দর্যকে এর জ্ঞানের আলোকে তুলে ধরতে হবে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যেসব মানুষ ইসলামের ব্যাপারে একটি প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে তাদের কাছে ইসলামের মূল মেসেজ আমাদের তুলে ধরা হয়নি। ইসলামের মেসেজকে তুলে ধরার জন্য আমাদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে এবং শক্তিশালী ইসলামিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে হবে। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ইসলাম কায়েম হবে না, কেবল ত্রাস কায়েম হবে।
আসুন হিকমাহ্* অবলম্বন করি। সংকীর্ণমনারা এই হিকমাহ্* বা প্রজ্ঞা অবলম্বন করাকে যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখুক না কেন হিকমাহ্* বা প্রজ্ঞা দিয়ে ইসলাম করা ও ইসলামকে মানুষের কাছে নিয়ে আসা আল্লাহ্* প্রদত্ত একটি মৌলিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে ইসলাম পছন্দ করে না এমন অনেক কাজকে আমরা ধৈর্য ধরে সহ্য করেছি এবং আমরা আমাদের ইসলামিক জ্ঞান দিয়ে হোক অথবা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে হোক - বুঝতে শিখেছি যে সত্যিকারের ইসলামকে তুলে ধরার জন্য আমাদের সত্যিকারের প্রজ্ঞা ও সত্যিকারের ধৈর্য লাগবে।
আবারও বলছি এই হত্যাকান্ডগুলোর দায় আমি কারও ওপর চাপাচ্ছি না। আল্লাহ্*ই ভালো জানেন এগুলো কার করা। কিন্তু আসুন কাকে হত্যা করা হয়েছে সেদিকে আলোচনাকে প্রবাহিত করে এটিকে ইসলামের নামে জায়েজ না করে বরং আমরা ইসলামের মূল মেসেজকে ক্ষুণ্ণ করছে এমন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরোধিতা করি। আপনি সেই দেশে বাস করছেন যেই দেশে মানুষ ইসলামের নামে শিরকও করে থাকে, এতে আপনার সহিষ্ণুতা ধরে রাখতে একদমই কষ্ট হচ্ছে না। একই ধরণের সহিষ্ণুতা আবারও ধরে রেখে আমরা এধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অনৈসলামিকতাকে স্পষ্ট করে তুলি। ইসলামকে ভালোবাসি বলেই, ইসলামের খাতিরেই, ইসলামের ভালো চেয়েই।
ইসলামের পথ থেকে সরে এসে যে তরুণটি বিভিন্ন ইসলাম বিরোধী কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাকে আপনি শয়তানের দোসর ভাবতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার চিন্তাকে আরেকটু প্রসারিত করেন তাহলে এও হতে পারে যে তরুণটি ইসলামের কথা সঠিক ভাবে শোনেনি, ঈমানের পথে এমন কোনও সারথি সে এখনও পায়নি যে তাকে সেই সৌন্দর্যের সন্ধান দেবে যার সন্ধান আপনি পেয়েছেন। আপনি নিজেই কেন সেই সারথি হবার কথা চিন্তা করছেন না? আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপট তো আপনার অজানা নয়, এইটুকু উপসংহারে পৌঁছানো কি আপনার জন্য খুব কঠিন?
আপনি আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করুন - যেদিন আপনি আল্লাহ্*র সামনে দাঁড়াবেন সেদিন আল্লাহ্*কে আপনি কী বলে খুশি করাটা যৌক্তিক মনে করবেন? "আমি আপনার জন্য মানুষকে ইসলামের মেসেজ দিয়েছি হিকমাহ্* ও সুন্দর বক্তব্যের মাধ্যমে" নাকি "আমি আপনার জন্য গুপ্তহত্যা করে বা গুপ্তহত্যাকে সমর্থন দিয়ে ইসলাম কায়েম করে এসেছি।"
আমার এই আলোচনাটির জন্য বেধড়ক গালিগালাজ খেতে হবে যথারীতি। কিন্তু যেসব সাধারণ মুসলিমরা তাদের সাধারণ প্রজ্ঞা ও ইসলামের সামষ্টিক সৌন্দর্যকে মনে ধারণ করে আছেন তারা যদি নিজেদের সঠিক চিন্তার পেছনে আরেকটু মানসিক বল পান এবং এ নিয়ে নির্ভয়ে কথা বলার আরেকটু সাহস খুঁজে পান তাহলেই হবে। ইসলামকে এগিয়ে নেবেন এরাই - কুচক্রী ও নিন্দুকদের সকল অশ্লীল বক্তব্যকে অগ্রাহ্য করেই। অবিবেচক রক্তপাত ঘটানো কোনও কাজ না - প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির মাধ্যমে যে ধর্মীয় অনুশীলন সেটাই মূল কাজ - ইসলাম বলতে সেটাকেই বোঝায়।
আমি পূর্বের স্টেটাসটিতে ব্যাখ্যা করেছিলাম যে কেন ইসলামের নামে এসব চোরাগোপ্তা হত্যাকান্ডগুলোকে সমর্থন করা যাবে না। আমার মূল প্রস্তাবনা ছিলো যে ইসলামি শাস্তিগুলো কোনোরকম স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনা না করেই প্রয়োগ করা হঠকারিতা এবং তা ইসলামের জন্যই ক্ষতিকর। এই আলোচনার বিপক্ষে কেবল একটি নির্ধারিত অপরাধের বিপক্ষে ইসলামে কী শাস্তি বর্ণিত হয়েছে সেই সংক্রান্ত আয়াত বা হাদীসের রেফরেন্স দিয়েই অনেকে খুশি। ঐ অপরাধগুলোর শাস্তিগুলোকে কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু প্রসঙ্গটা হোলো এই শাস্তিগুলো কোন প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা হবে। যে কোনও ইসলামিক বিধানই প্রয়োগ করার শর্ত রয়েছে, পদ্ধতি রয়েছে এবং প্রয়োগ করাটা কখন কী কারণে স্থগিত রাখা যেতে পারে বা রাখতে হবে তারও নির্দেশনা রয়েছে। সেটি ইসলামের যে হুদূদ শাস্তি (অর্থাৎ সেসব শাস্তি যা আল্লাহ্* কিছু নির্দিষ্ট অপরাধে নির্ধারণ করে দিয়েছেন) - এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কখনই আয়াত বা হাদীস দিয়ে কোনও একটি অপরাধের ইসলামি শাস্তি কি সেটা দেখিয়ে দিলেই - দলিল প্রতিষ্ঠিত হয় না। কেননা ঐ অপরাধের শাস্তি কী সেটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে না। আলোচনার বিষয় হোল শাস্তির প্রায়োগিক দিক।
চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে শাস্তি দেয়ার যে কায়দা তা হুদূদ শাস্তির প্রায়োগিক দিকগুলোর বিচারে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এখানে যে আমাদের সমাজের পরিস্থিতির খেয়াল রাখা হচ্ছে না কেবল তাই নয়, হুদুদ শাস্তি প্রয়োগ করার আগে মানুষকে ইসলামের ব্যাপারে বোঝানো লাগে, সুষ্ঠু বিচারপদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণ করা লাগে, শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবধরণের সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকা লাগে তার কিছুই এখানে করা হয়নি। যারা খুন করছে তারা শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা রাখে কীনা সেই মৌলিক প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম। সন্দেহ মুক্ত থাকা বলতে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কীনা কেবল সেই সন্দেহের কথা হচ্ছে না, সেই অপরাধী ইসলামের ব্যাপারে সুন্দর করে জানে কীনা সেই সন্দেহও প্রযোজ্য। 'আইশা রা. বর্ণিত একটি হাদীস - যা ইমাম বাইহাকীর মতে মাওকূফ (অর্থাৎ এটি নবীজীর হাদীস হিসেবে প্রচলিত হলেও আসলে সাহাবীর কথা) - তাতে বলা হয়েছে: "মুসলিমদের ওপর হুদূদ প্রয়োগ করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকো, যদি মুসলিমদের জন্য (শাস্তি প্রয়োগ না করার) কোনও রাস্তা খুঁজে পাও তাহলে তাদের ছেড়ে দাও। কেননা শাস্তি দিতে গিয়ে ভুল করার চেয়ে একজন ইমামের ক্ষমা করতে গিয়ে ভুল করাটা উত্তম।" ইমাম আত-তিরমিযী, আল-হাকিম, আল-বাইহাকী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এখানে কী ঘটছে? কিছু মানুষ - যারা ইমাম নন কোনও যুক্তিতেই - তারা কোনও রকম কোর্ট কাচারি না করে এবং হুদূদ শাস্তির সকল শর্ত পূরণ না করেই চাপাতি দিয়ে মানুষ খুন করে আসছেন।
ইমাম ওয়াহবাহ্* আয-যুহাইলী "আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া-আদিল্লাতুহ" গ্রন্থটির লেখক। যারা ইসলামিক স্টাডিজ নিয়ে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়েন তাদের কারো এই বইটি অজানা থাকার কথা নয় এবং বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বইটি একটি মূল রেফরেন্স গ্রন্থ। ৪ মাযহাবের তুলনামূলক আলোচনা সংবলিত এমন বইয়ের নমুনা সমসাময়িক স্কলারশিপে বিরল। বইটির ৫ম খন্ডে তিনি ইসলামের শাস্তি ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি বলেছেন যে হাদ্দ শাস্তি যেকোনও শাস্তির মতই যেনতেন ভাবে দেয়া চলবে না, এবং শাস্তি দেয়ার সময়ও ভয় বা আতঙ্ক তৈরি করলে চলবে না। কারণ শাস্তির মূল কারণ হচ্ছে - যে কোনও শাস্তি ব্যবস্থার মতোই - সমাজে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া বা যা শাস্তি রয়েছে তার উর্দ্ধে তাকে আতঙ্কিত করা এবং তার ব্যক্তিগত সম্মান নষ্ট করা শাস্তির মূল উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির মাঝে কখনই পড়ে না। এখন যারা চাপাতি দিয়ে বাসাবাড়ি গিয়ে শাস্তি দিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা কি এসব মেইন্টেইন করছেন? মানুষের ঘরে হামলা করে হুদূদ শাস্তি কায়েম করার কথা কি ইসলামে এসেছে? ঘরের যে দারোয়ানটিকে মারা হোলো তার ওপর কোন শাস্তি প্রয়োগ করা হয়েছে? আশ্চর্যের কথা যে কিছু মুসলিম এসব কাজের সমর্থন দিচ্ছেন! এ কোন ইসলাম যেখানে বিবেক হারিয়ে মানুষ দানবে পরিণত হয়?
কিন্তু এতো গেলো শাস্তি যখন প্রয়োগ করা হবে তখনকার কথা। আসুন শাস্তি প্রয়োগের প্রেক্ষাপট নিয়ে শায়েখ ড: ওয়াহবাহ আয-যুহাইলী কী বলছেন সেটা দেখা যাক। যেহেতু এরকম সংকীর্ণমনা মানুষের অভাব হবে না যারা ন্যূনতম যাচাই বাছাই না করে এবং পড়াশোনা না করেই আমার পাশাপাশি এই অসামান্য শায়েখেরও পিন্ডি চটকাবেন - সেটা অবধারিত জেনেও - এটা বলে নেয়া দরকার যে নিচের অংশটুকু একটি বিস্তৃত আলোচনার একটি ছোট অংশ মাত্র। কোনও আলটপকা উপসংহারে পৌঁছনোর পূর্বে আমি বোদ্ধাদের ব্যর্থ অনুরোধ করবো তারা যেন কষ্ট করে পুরো আলোচনা পড়ে নেন। নিচের অংশটি শায়েখের (এর আগে দুটি কথা, এক, আমি অনুবাদে অবশ্যই অর্থ ঠিক রেখে যতটা প্রাঞ্জল করা যায় চেষ্টা করেছি। কিন্তু আরবি ভাষার বাক্যগঠন, গাম্ভীর্য ও অর্থ ঠিক রাখতে গিয়ে কিছু বাক্য সুখপাঠ্য হয়নি, আশা করি বিষয়ের গুরুত্বের কারণে সেটা ক্ষমার যোগ্য অপরাধ হবে। দুই, মূল প্রসঙ্গের বাইরে বলা কিছু কথার সাথে আমি ব্যক্তিগত ভাবে একমত নই, যেটা আমার চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিতরা বুঝবেন, কিন্তু আমি এখানে কেবল অনুবাদকের ভূমিকা পালন করছি এবং দ্বিমতের জায়গাগুলো এই টপিকে গুরুত্বপূর্ণ নয়)।
"হুদূদের যে শাস্তিগুলো সেগুলো তাই একই সাথে সতর্ক করার ও সংশোধনের উপকরণ – সমাজে সংস্কার আনার ও শোভনীয়তা বজায় রাখার মাধ্যম। কিন্তু আমি এটাও একই সাথে উল্লেখ করতে চাই যে ইসলামি শরি’আ প্রতিষ্ঠা করার জন্য এর সবচেয়ে কঠোর দিকগুলো – যেমন হুদূদের শাস্তি ও এরকম যা আছে – সেগুলো দিয়ে শুরু করাটা উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি, ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা ও বাড়াবাড়ির নামান্তর মাত্র। এটি মোটেই সঠিক মেথডলজি নয়। এভাবে শরি’আ কায়েম করতে চাইলে তা দেশের ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে – যেমনটা ঘটেছিলো সুদানে ১৯৮৫ সালে হুদুদ শাস্তি প্রচলনের পর (১৯৮৩ সালে) এবং পাকিস্তানে ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের প্লেন বিধ্বস্ত হবার পর – যিনি সেখানে শরি’আ অ্যাপ্লাই করেছিলেন। কেননা শরি’আ হোলো একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা যা বিচ্ছিন্নভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানব জীবনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক – এ সকল দিগন্ত জুড়ে এটি বিস্তৃত।
সংস্কারের ক্ষেত্রে ইসলামের পদ্ধতি হোলো প্রথমত মানুষকে বোঝানো ও আশ্বস্ত করা, যুক্তি দেয়া ও ব্যাখ্যা প্রদান করা, সুন্দর কথা ও বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে আহ্বান করা, অযথা মনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে না এমন শান্ত ও সৌম্য দিকনির্দেশনা দেয়া। যারা পাশ্চাত্যের আইন-কানুনের প্রতি অনুরক্ত তাদের সাথে আলোচনা করা ও তাদের প্ররোচিত করার জন্যই এসব কিছু ব্যবহার করতে হবে।
সামাজিক রীতিনীতির গোঁড়ামি, ঔপনিবেশিকতা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া উপাদানসমূহ, পাশ্চাত্যের পার্থিব দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি থেকে সমাজকে সরিয়ে ইসলামের পরিপূর্ণ দয়া, সুবিচার, সহজতা এবং ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে এর শান্তিময়তার দিকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে হিক্*মাহ (প্রজ্ঞা) প্রয়োগ করে এবং মানুষের মাঝে ইসলামের শিক্ষাসমূহ ছড়িয়ে দিয়ে। একই সাথে এও নিশ্চিত করতে হবে যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর সংস্কার সাধিত হচ্ছে। এটি করতে হবে শুরা বা পারস্পরিক আলোচনাভিত্তিক শাসনব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমে - সুবিচারকে বিচার ব্যবস্থা ও রাজনীতির সত্যিকার নিয়ন্ত্রকে পরিণত করে - কেবল স্লোগান হিসেবে নয়, কাজের মাধ্যমে। যতটা পারা যায় সমাজে অর্থনৈতিক সুস্থিরতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে সবার জন্য। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব রোধের চেষ্টা করতে হবে, নিরক্ষরতা দূর করতে হবে। শিক্ষাহীন সমাজের চিহ্নসমূহ মুছে ফেলতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও মিডিয়ার – বিশেষ করে রেডিও টিভির - সংস্কার করতে হবে। এসবের মাধ্যমে যেসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও জটিলতা তৈরি হয়েছে তা দূর করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে যেসব জট তৈরি হয়েছে ও সন্দেহের বীজ রোপিত হয়েছে সেগুলো দূর হয় – যার মূল উৎস হচ্ছে জীবনের ঘটনাসমূহের ধর্মীয় ব্যাখ্যা না জেনে অন্তঃসারশূণ্য মেটেরিয়ালিস্টিক চিন্তাধারা দিয়ে প্রভাবিত হওয়া।
এসব না করে কেবল নামকাওয়াস্তে হুদূদ শাস্তির বিধানগুলো প্রয়োগ করা এবং ইসলামের প্রয়োগকে এই শাস্তিগুলো কায়েম করার মাঝে সীমাবদ্ধ করে রাখা আর অন্যদিকে মানুষকে দ্বিধা, অজ্ঞানতা, অভাব ও মানসিক দোটানার মাঝে ফেলে রাখা – এটা মোটেই আল্লাহ্*র শরি’আ বা দ্বীনের মধ্যে পড়ে না - যে শরি’আ বা দ্বীন কিনা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। সম্ভবত শরি’আকে হুদুদ শাস্তি প্রয়োগের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখাটা মানুষকে ইসলাম থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয়ারই মাধ্যম মাত্র। এর মাধ্যমে ইসলামের ব্যর্থতা, এর অনুপযোগিতা এবং এর বিধানসমূহের পূর্ণাঙ্গতার অভাবই মানুষের কাছে তুলে ধরা হবে মাত্র। আল্লাহ্* তা’আলা বলেন: “তোমরা কি কেবল কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করো এবং অপর অংশগুলোতে অবিশ্বাস করো? যে এমনটা করে তার প্রতিদান আর কী হতে পারে দুনিয়াতে লাঞ্ছিত হওয়া ছাড়া! আর শেষ বিচারের দিন তাকে ঠেলে দেয়া হবে কঠোরতম শাস্তির দিকে। আর তোমরা যা করো তার ব্যাপারে আল্লাহ্* অনবহিত নন”। [আল-বাক্বারাহ্*: ৮৫]"
[আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া-আদিল্লাতুহ: ভ: ৫, পৃ: ৭৫৩-৭৫৪, প্র: দারুল ফিক্*র]
========================
উনার ফেসবুক লিংকঃ www.facebook.com/asifshibgat.bhuiyan?fref=ts
উল্লেখ্যঃ এই লোকের বেশ কিছু ফলোয়ার থাকায় অনেক মানুষ উনার মাধ্যমে ভ্রান্তিতে পরে যেতে পারে। তাই, দলীল ভিত্তিক উত্তর জরুরী। গালাগালি কিংবা কটুক্তি কাম্য নয়।
==========
এই হত্যাকান্ডগুলো কারা ঘটাচ্ছে আসুন সেই রাজনৈতিক বিতর্কে আমরা নাহয় নাই জড়ালাম। যেহেতু ধর্মীয়-রাজনৈতিক ধুম্রজাল অত্যন্ত বিস্তৃত তাই আমরা সবাইকে বেনিফিট অফ ডাউট দিই। কে এই কাজ করেছে এই ব্যাপারে আমরা কথাই না বলি।
কিন্তু আমরা মুসলিমরা কি এই হত্যাকান্ডগুলোকে সমর্থন করবো? এই দায়ে যে যাদের হত্যা করা হচ্ছে তারা এমন কিছু কাজে জড়িত যা ইসলাম সমর্থন করে না? এবং এই হত্যাকান্ডগুলোকে সমর্থন না করার মানেই কি এই দাঁড়াবে যে আমরা ঐ অনৈসলামিক কাজগুলোকেও সমর্থন করি? নাকি আমরা বড় পরিসরে ব্যাপারগুলোকে যাচাই করে দেখার দিকে আহ্বান করছি কেবল?
এটা তো আমাদের অজানা নয় যে বহুদিন হয়ে গেল আমাদের দেশ কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ মাত্র, এখানে ইসলামকে সামষ্টিক ভাবে বোঝার চর্চা এখনও খুবই সীমিত। এবং এটা কেবল আজকের কথা নয়, বহু দশক হয়ে গেছে আমরা একটি টোকেন ইসলামের চর্চা করে আসছি। এরকম একটি পরিবেশে সেক্যুলার চিন্তাভাবনা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার যে মডার্নিস্ট ব্যাখ্যা - যা পুরো বিশ্বে প্রধানতম আদর্শের স্থান নিয়ে নিয়েছে - এখানেও যে তা আস্তে আস্তে শিক্ষিত সমাজের প্রধান আদর্শিক অবস্থানে রূপ নিয়েছে তাতে আমাদের খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু অবাক হয়ে ওঠার তো কিছু নেই। বহুদিন ধরে ইসলামের আদর্শিক সত্যকে বুদ্ধিবৃত্তিক লেভেলে তুলে ধরার মতো কিছুই তো আমরা করতে পারিনি। সেরকম ইন্সটিটিউশন, ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানের চর্চা আমরা যারা ইসলামের ঝান্ডা বহন করি তারা তো গড়ে তুলতে পারিনি - এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় কী আমাদের আছে নাকি এটা স্বীকার করার মতো সৎ সাহস এবং বাস্তব জ্ঞানও আমাদের হয়ে ওঠেনি?
নবীজী (সা.) তার সময়ে যা কিছু করেছেন তার কোনোটিই অবু দশ বিশ ত্রিশ গুনে করা হয়নি। তেমনটি দাবী করা হলে সেটা হবে আল্লাহ্* ও তার রাসূলের (সা.) প্রতিই মিথ্যাচার। তার দা'ওয়াত ও তার জিহাদের প্রতিটি ঘটনাই ছিলো হিকমাহ্* বা প্রজ্ঞা অবলম্বন করে। এখন কারও কারও মনে হচ্ছে হিকমতের নাম নিয়ে সব কিছুকে জলবৎ তরলং করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি ধর্মীয় ইস্যুর পেছনে হিকমাহ্* থাকাটা যে নবীজীর (সা.) সুন্নাহ তা আপনি কীভাবে অস্বীকার করেন? আল্লাহ্*র একটি নাম যে আল-হাকীম তা কীভাবে অস্বীকার করবেন? হিকমাহ্* শব্দটি যে কুরআনের একটি দর্শন সেটি কীভাবে অস্বীকার করা হবে?
ইবনুল কায়্যিম, ত্রয়োদশ শতাব্দির একজন শ্রেষ্ঠ 'আলেম, বলেছেন হিকমাহ হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি সঠিক পদ্ধতিতে করা। কখনই হিকমার এই অর্থ করা হয়নি যে নবীজীর (সা.) সীরাতের কোনও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে স্থান কাল পাত্রের হিসেব না করেই প্রমাণ হিসেবে বর্তমান সময়ে প্রয়োগ করে দেয়া হবে। ইবনুল কায়্যিম যে কথাটি বলেছেন সেটি খেয়াল করুন। আপনার সত্যিই কী মনে হয় যে আমরা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি সঠিক পদ্ধতিতে করছি? নাকি আমরা এতটাই দাম্ভিক ও স্বধার্মিকতায় এতটাই মোহিত যে এই প্রশ্ন নিজেদের কিছুক্ষণ সময় নিয়ে করার মতো মানসিকতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি?
ইসলামের স্বার্থেই আসুন আমরা এই হত্যাকান্ডগুলোর বিরোধিতা করি। এইজন্য নয় যে আমরা কোনও ইসলাম বিরোধী কাজকে সমর্থন করি। এজন্যই যে আমরা মনে করি আমাদের স্থান ও কালে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক। আমাদের ইসলামের সৌন্দর্যকে এর জ্ঞানের আলোকে তুলে ধরতে হবে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যেসব মানুষ ইসলামের ব্যাপারে একটি প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে তাদের কাছে ইসলামের মূল মেসেজ আমাদের তুলে ধরা হয়নি। ইসলামের মেসেজকে তুলে ধরার জন্য আমাদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে এবং শক্তিশালী ইসলামিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে হবে। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ইসলাম কায়েম হবে না, কেবল ত্রাস কায়েম হবে।
আসুন হিকমাহ্* অবলম্বন করি। সংকীর্ণমনারা এই হিকমাহ্* বা প্রজ্ঞা অবলম্বন করাকে যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখুক না কেন হিকমাহ্* বা প্রজ্ঞা দিয়ে ইসলাম করা ও ইসলামকে মানুষের কাছে নিয়ে আসা আল্লাহ্* প্রদত্ত একটি মৌলিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে ইসলাম পছন্দ করে না এমন অনেক কাজকে আমরা ধৈর্য ধরে সহ্য করেছি এবং আমরা আমাদের ইসলামিক জ্ঞান দিয়ে হোক অথবা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে হোক - বুঝতে শিখেছি যে সত্যিকারের ইসলামকে তুলে ধরার জন্য আমাদের সত্যিকারের প্রজ্ঞা ও সত্যিকারের ধৈর্য লাগবে।
আবারও বলছি এই হত্যাকান্ডগুলোর দায় আমি কারও ওপর চাপাচ্ছি না। আল্লাহ্*ই ভালো জানেন এগুলো কার করা। কিন্তু আসুন কাকে হত্যা করা হয়েছে সেদিকে আলোচনাকে প্রবাহিত করে এটিকে ইসলামের নামে জায়েজ না করে বরং আমরা ইসলামের মূল মেসেজকে ক্ষুণ্ণ করছে এমন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরোধিতা করি। আপনি সেই দেশে বাস করছেন যেই দেশে মানুষ ইসলামের নামে শিরকও করে থাকে, এতে আপনার সহিষ্ণুতা ধরে রাখতে একদমই কষ্ট হচ্ছে না। একই ধরণের সহিষ্ণুতা আবারও ধরে রেখে আমরা এধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অনৈসলামিকতাকে স্পষ্ট করে তুলি। ইসলামকে ভালোবাসি বলেই, ইসলামের খাতিরেই, ইসলামের ভালো চেয়েই।
ইসলামের পথ থেকে সরে এসে যে তরুণটি বিভিন্ন ইসলাম বিরোধী কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাকে আপনি শয়তানের দোসর ভাবতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার চিন্তাকে আরেকটু প্রসারিত করেন তাহলে এও হতে পারে যে তরুণটি ইসলামের কথা সঠিক ভাবে শোনেনি, ঈমানের পথে এমন কোনও সারথি সে এখনও পায়নি যে তাকে সেই সৌন্দর্যের সন্ধান দেবে যার সন্ধান আপনি পেয়েছেন। আপনি নিজেই কেন সেই সারথি হবার কথা চিন্তা করছেন না? আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপট তো আপনার অজানা নয়, এইটুকু উপসংহারে পৌঁছানো কি আপনার জন্য খুব কঠিন?
আপনি আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করুন - যেদিন আপনি আল্লাহ্*র সামনে দাঁড়াবেন সেদিন আল্লাহ্*কে আপনি কী বলে খুশি করাটা যৌক্তিক মনে করবেন? "আমি আপনার জন্য মানুষকে ইসলামের মেসেজ দিয়েছি হিকমাহ্* ও সুন্দর বক্তব্যের মাধ্যমে" নাকি "আমি আপনার জন্য গুপ্তহত্যা করে বা গুপ্তহত্যাকে সমর্থন দিয়ে ইসলাম কায়েম করে এসেছি।"
আমার এই আলোচনাটির জন্য বেধড়ক গালিগালাজ খেতে হবে যথারীতি। কিন্তু যেসব সাধারণ মুসলিমরা তাদের সাধারণ প্রজ্ঞা ও ইসলামের সামষ্টিক সৌন্দর্যকে মনে ধারণ করে আছেন তারা যদি নিজেদের সঠিক চিন্তার পেছনে আরেকটু মানসিক বল পান এবং এ নিয়ে নির্ভয়ে কথা বলার আরেকটু সাহস খুঁজে পান তাহলেই হবে। ইসলামকে এগিয়ে নেবেন এরাই - কুচক্রী ও নিন্দুকদের সকল অশ্লীল বক্তব্যকে অগ্রাহ্য করেই। অবিবেচক রক্তপাত ঘটানো কোনও কাজ না - প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির মাধ্যমে যে ধর্মীয় অনুশীলন সেটাই মূল কাজ - ইসলাম বলতে সেটাকেই বোঝায়।
আমি পূর্বের স্টেটাসটিতে ব্যাখ্যা করেছিলাম যে কেন ইসলামের নামে এসব চোরাগোপ্তা হত্যাকান্ডগুলোকে সমর্থন করা যাবে না। আমার মূল প্রস্তাবনা ছিলো যে ইসলামি শাস্তিগুলো কোনোরকম স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনা না করেই প্রয়োগ করা হঠকারিতা এবং তা ইসলামের জন্যই ক্ষতিকর। এই আলোচনার বিপক্ষে কেবল একটি নির্ধারিত অপরাধের বিপক্ষে ইসলামে কী শাস্তি বর্ণিত হয়েছে সেই সংক্রান্ত আয়াত বা হাদীসের রেফরেন্স দিয়েই অনেকে খুশি। ঐ অপরাধগুলোর শাস্তিগুলোকে কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু প্রসঙ্গটা হোলো এই শাস্তিগুলো কোন প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা হবে। যে কোনও ইসলামিক বিধানই প্রয়োগ করার শর্ত রয়েছে, পদ্ধতি রয়েছে এবং প্রয়োগ করাটা কখন কী কারণে স্থগিত রাখা যেতে পারে বা রাখতে হবে তারও নির্দেশনা রয়েছে। সেটি ইসলামের যে হুদূদ শাস্তি (অর্থাৎ সেসব শাস্তি যা আল্লাহ্* কিছু নির্দিষ্ট অপরাধে নির্ধারণ করে দিয়েছেন) - এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কখনই আয়াত বা হাদীস দিয়ে কোনও একটি অপরাধের ইসলামি শাস্তি কি সেটা দেখিয়ে দিলেই - দলিল প্রতিষ্ঠিত হয় না। কেননা ঐ অপরাধের শাস্তি কী সেটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে না। আলোচনার বিষয় হোল শাস্তির প্রায়োগিক দিক।
চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে শাস্তি দেয়ার যে কায়দা তা হুদূদ শাস্তির প্রায়োগিক দিকগুলোর বিচারে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এখানে যে আমাদের সমাজের পরিস্থিতির খেয়াল রাখা হচ্ছে না কেবল তাই নয়, হুদুদ শাস্তি প্রয়োগ করার আগে মানুষকে ইসলামের ব্যাপারে বোঝানো লাগে, সুষ্ঠু বিচারপদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণ করা লাগে, শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবধরণের সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকা লাগে তার কিছুই এখানে করা হয়নি। যারা খুন করছে তারা শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা রাখে কীনা সেই মৌলিক প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম। সন্দেহ মুক্ত থাকা বলতে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কীনা কেবল সেই সন্দেহের কথা হচ্ছে না, সেই অপরাধী ইসলামের ব্যাপারে সুন্দর করে জানে কীনা সেই সন্দেহও প্রযোজ্য। 'আইশা রা. বর্ণিত একটি হাদীস - যা ইমাম বাইহাকীর মতে মাওকূফ (অর্থাৎ এটি নবীজীর হাদীস হিসেবে প্রচলিত হলেও আসলে সাহাবীর কথা) - তাতে বলা হয়েছে: "মুসলিমদের ওপর হুদূদ প্রয়োগ করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকো, যদি মুসলিমদের জন্য (শাস্তি প্রয়োগ না করার) কোনও রাস্তা খুঁজে পাও তাহলে তাদের ছেড়ে দাও। কেননা শাস্তি দিতে গিয়ে ভুল করার চেয়ে একজন ইমামের ক্ষমা করতে গিয়ে ভুল করাটা উত্তম।" ইমাম আত-তিরমিযী, আল-হাকিম, আল-বাইহাকী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এখানে কী ঘটছে? কিছু মানুষ - যারা ইমাম নন কোনও যুক্তিতেই - তারা কোনও রকম কোর্ট কাচারি না করে এবং হুদূদ শাস্তির সকল শর্ত পূরণ না করেই চাপাতি দিয়ে মানুষ খুন করে আসছেন।
ইমাম ওয়াহবাহ্* আয-যুহাইলী "আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া-আদিল্লাতুহ" গ্রন্থটির লেখক। যারা ইসলামিক স্টাডিজ নিয়ে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়েন তাদের কারো এই বইটি অজানা থাকার কথা নয় এবং বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বইটি একটি মূল রেফরেন্স গ্রন্থ। ৪ মাযহাবের তুলনামূলক আলোচনা সংবলিত এমন বইয়ের নমুনা সমসাময়িক স্কলারশিপে বিরল। বইটির ৫ম খন্ডে তিনি ইসলামের শাস্তি ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি বলেছেন যে হাদ্দ শাস্তি যেকোনও শাস্তির মতই যেনতেন ভাবে দেয়া চলবে না, এবং শাস্তি দেয়ার সময়ও ভয় বা আতঙ্ক তৈরি করলে চলবে না। কারণ শাস্তির মূল কারণ হচ্ছে - যে কোনও শাস্তি ব্যবস্থার মতোই - সমাজে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া বা যা শাস্তি রয়েছে তার উর্দ্ধে তাকে আতঙ্কিত করা এবং তার ব্যক্তিগত সম্মান নষ্ট করা শাস্তির মূল উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির মাঝে কখনই পড়ে না। এখন যারা চাপাতি দিয়ে বাসাবাড়ি গিয়ে শাস্তি দিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা কি এসব মেইন্টেইন করছেন? মানুষের ঘরে হামলা করে হুদূদ শাস্তি কায়েম করার কথা কি ইসলামে এসেছে? ঘরের যে দারোয়ানটিকে মারা হোলো তার ওপর কোন শাস্তি প্রয়োগ করা হয়েছে? আশ্চর্যের কথা যে কিছু মুসলিম এসব কাজের সমর্থন দিচ্ছেন! এ কোন ইসলাম যেখানে বিবেক হারিয়ে মানুষ দানবে পরিণত হয়?
কিন্তু এতো গেলো শাস্তি যখন প্রয়োগ করা হবে তখনকার কথা। আসুন শাস্তি প্রয়োগের প্রেক্ষাপট নিয়ে শায়েখ ড: ওয়াহবাহ আয-যুহাইলী কী বলছেন সেটা দেখা যাক। যেহেতু এরকম সংকীর্ণমনা মানুষের অভাব হবে না যারা ন্যূনতম যাচাই বাছাই না করে এবং পড়াশোনা না করেই আমার পাশাপাশি এই অসামান্য শায়েখেরও পিন্ডি চটকাবেন - সেটা অবধারিত জেনেও - এটা বলে নেয়া দরকার যে নিচের অংশটুকু একটি বিস্তৃত আলোচনার একটি ছোট অংশ মাত্র। কোনও আলটপকা উপসংহারে পৌঁছনোর পূর্বে আমি বোদ্ধাদের ব্যর্থ অনুরোধ করবো তারা যেন কষ্ট করে পুরো আলোচনা পড়ে নেন। নিচের অংশটি শায়েখের (এর আগে দুটি কথা, এক, আমি অনুবাদে অবশ্যই অর্থ ঠিক রেখে যতটা প্রাঞ্জল করা যায় চেষ্টা করেছি। কিন্তু আরবি ভাষার বাক্যগঠন, গাম্ভীর্য ও অর্থ ঠিক রাখতে গিয়ে কিছু বাক্য সুখপাঠ্য হয়নি, আশা করি বিষয়ের গুরুত্বের কারণে সেটা ক্ষমার যোগ্য অপরাধ হবে। দুই, মূল প্রসঙ্গের বাইরে বলা কিছু কথার সাথে আমি ব্যক্তিগত ভাবে একমত নই, যেটা আমার চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিতরা বুঝবেন, কিন্তু আমি এখানে কেবল অনুবাদকের ভূমিকা পালন করছি এবং দ্বিমতের জায়গাগুলো এই টপিকে গুরুত্বপূর্ণ নয়)।
"হুদূদের যে শাস্তিগুলো সেগুলো তাই একই সাথে সতর্ক করার ও সংশোধনের উপকরণ – সমাজে সংস্কার আনার ও শোভনীয়তা বজায় রাখার মাধ্যম। কিন্তু আমি এটাও একই সাথে উল্লেখ করতে চাই যে ইসলামি শরি’আ প্রতিষ্ঠা করার জন্য এর সবচেয়ে কঠোর দিকগুলো – যেমন হুদূদের শাস্তি ও এরকম যা আছে – সেগুলো দিয়ে শুরু করাটা উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি, ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা ও বাড়াবাড়ির নামান্তর মাত্র। এটি মোটেই সঠিক মেথডলজি নয়। এভাবে শরি’আ কায়েম করতে চাইলে তা দেশের ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে – যেমনটা ঘটেছিলো সুদানে ১৯৮৫ সালে হুদুদ শাস্তি প্রচলনের পর (১৯৮৩ সালে) এবং পাকিস্তানে ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের প্লেন বিধ্বস্ত হবার পর – যিনি সেখানে শরি’আ অ্যাপ্লাই করেছিলেন। কেননা শরি’আ হোলো একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা যা বিচ্ছিন্নভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানব জীবনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক – এ সকল দিগন্ত জুড়ে এটি বিস্তৃত।
সংস্কারের ক্ষেত্রে ইসলামের পদ্ধতি হোলো প্রথমত মানুষকে বোঝানো ও আশ্বস্ত করা, যুক্তি দেয়া ও ব্যাখ্যা প্রদান করা, সুন্দর কথা ও বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে আহ্বান করা, অযথা মনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে না এমন শান্ত ও সৌম্য দিকনির্দেশনা দেয়া। যারা পাশ্চাত্যের আইন-কানুনের প্রতি অনুরক্ত তাদের সাথে আলোচনা করা ও তাদের প্ররোচিত করার জন্যই এসব কিছু ব্যবহার করতে হবে।
সামাজিক রীতিনীতির গোঁড়ামি, ঔপনিবেশিকতা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া উপাদানসমূহ, পাশ্চাত্যের পার্থিব দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি থেকে সমাজকে সরিয়ে ইসলামের পরিপূর্ণ দয়া, সুবিচার, সহজতা এবং ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে এর শান্তিময়তার দিকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে হিক্*মাহ (প্রজ্ঞা) প্রয়োগ করে এবং মানুষের মাঝে ইসলামের শিক্ষাসমূহ ছড়িয়ে দিয়ে। একই সাথে এও নিশ্চিত করতে হবে যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর সংস্কার সাধিত হচ্ছে। এটি করতে হবে শুরা বা পারস্পরিক আলোচনাভিত্তিক শাসনব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমে - সুবিচারকে বিচার ব্যবস্থা ও রাজনীতির সত্যিকার নিয়ন্ত্রকে পরিণত করে - কেবল স্লোগান হিসেবে নয়, কাজের মাধ্যমে। যতটা পারা যায় সমাজে অর্থনৈতিক সুস্থিরতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে সবার জন্য। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব রোধের চেষ্টা করতে হবে, নিরক্ষরতা দূর করতে হবে। শিক্ষাহীন সমাজের চিহ্নসমূহ মুছে ফেলতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও মিডিয়ার – বিশেষ করে রেডিও টিভির - সংস্কার করতে হবে। এসবের মাধ্যমে যেসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও জটিলতা তৈরি হয়েছে তা দূর করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে যেসব জট তৈরি হয়েছে ও সন্দেহের বীজ রোপিত হয়েছে সেগুলো দূর হয় – যার মূল উৎস হচ্ছে জীবনের ঘটনাসমূহের ধর্মীয় ব্যাখ্যা না জেনে অন্তঃসারশূণ্য মেটেরিয়ালিস্টিক চিন্তাধারা দিয়ে প্রভাবিত হওয়া।
এসব না করে কেবল নামকাওয়াস্তে হুদূদ শাস্তির বিধানগুলো প্রয়োগ করা এবং ইসলামের প্রয়োগকে এই শাস্তিগুলো কায়েম করার মাঝে সীমাবদ্ধ করে রাখা আর অন্যদিকে মানুষকে দ্বিধা, অজ্ঞানতা, অভাব ও মানসিক দোটানার মাঝে ফেলে রাখা – এটা মোটেই আল্লাহ্*র শরি’আ বা দ্বীনের মধ্যে পড়ে না - যে শরি’আ বা দ্বীন কিনা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। সম্ভবত শরি’আকে হুদুদ শাস্তি প্রয়োগের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখাটা মানুষকে ইসলাম থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয়ারই মাধ্যম মাত্র। এর মাধ্যমে ইসলামের ব্যর্থতা, এর অনুপযোগিতা এবং এর বিধানসমূহের পূর্ণাঙ্গতার অভাবই মানুষের কাছে তুলে ধরা হবে মাত্র। আল্লাহ্* তা’আলা বলেন: “তোমরা কি কেবল কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করো এবং অপর অংশগুলোতে অবিশ্বাস করো? যে এমনটা করে তার প্রতিদান আর কী হতে পারে দুনিয়াতে লাঞ্ছিত হওয়া ছাড়া! আর শেষ বিচারের দিন তাকে ঠেলে দেয়া হবে কঠোরতম শাস্তির দিকে। আর তোমরা যা করো তার ব্যাপারে আল্লাহ্* অনবহিত নন”। [আল-বাক্বারাহ্*: ৮৫]"
[আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া-আদিল্লাতুহ: ভ: ৫, পৃ: ৭৫৩-৭৫৪, প্র: দারুল ফিক্*র]
========================
উনার ফেসবুক লিংকঃ www.facebook.com/asifshibgat.bhuiyan?fref=ts
Comment