গাযওয়ায়ে হিন্দ বিষয়ক হাদীসসমূহ:
সনদ বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা
মুফতি আবু আসেম নাবিল হাফিযাহুল্লাহ
সনদ বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা
মুফতি আবু আসেম নাবিল হাফিযাহুল্লাহ

তৃতীয় অংশ
গাযওয়ায়ে হিন্দ কি সংঘটিত হয়ে গেছে, না, শেষ জামানায় হবে?
উপরে উল্লিখিত সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর হাদীস, যেখানে বলা হয়েছে, ‘দুটি দলকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। একটি দল, যারা হিন্দুস্তানের যুদ্ধে শরিক হবে। আর দ্বিতীয় দল, যারা ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম-এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করবে।’ কোনো কোনো গবেষকের ধারণা, ‘এই হাদীসে আলোচিত দুটি দলের মাঝে পারস্পারিক কোনো সম্পর্ক নেই। এবং উভয় দলের যুদ্ধ একই জামানায় হওয়াও জরুরি নয়।’ তাদের দৃষ্টিতে ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ উমাইয়া যুগে সংঘটিত হয়ে গেছে। আর ‘দাজ্জালের সাথে ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর বাহিনীর যুদ্ধ শেষ জামানায় ঘটবে।’ এভাবে তারা একই হাদীসে উল্লিখিত দুটি যুদ্ধের সময়কালের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য আছে বলে মনে করেন। উক্ত বিষয় সম্পর্কে সামনে পৃথক আলোচনা আসছে।
তবে বিশিষ্ট তাবিঈ আরতাত রহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর বর্ণিত হাদীসে আলোচিত দুটি যুদ্ধের ঘটনা একই যুগে সংঘটিত হবে।
উল্লেখ্য, আরতাত রহিমাহুল্লাহ শামের হিমস এলাকার অধিবাসী। আর সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) শেষ বয়সে শামের হিমস এলাকায় বসবাস করেন এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন[1]। আর এ কারণে তাবিঈ আরতাত রহিমাহুল্লাহ সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর সাক্ষাত পেয়েছিলেন। তাই এটা খুবই সম্ভব যে, তিনি সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকেই এ হাদীসটি জানতে পেরেছেন এবং সে অনুযায়ী তা বর্ণনা করেছেন।
বিশিষ্ট তাবিঈ আরতাত রহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনা
আরতাত রহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনাটি নুআইম বিন হাম্মাদ (মৃত্যু ২২৮ হি.) তাঁর ‘আলফিতান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,
حَدَّثَنَا الْوَلِيْدُ بْنُ مُسْلِمٍ عَنْ جَرَّاْحٍ عَنْ أَرْطَاْةَ قَالَ: عَلَى يَدَيْ ذَلِكَ الْخَلِيْفَةِ الْيَمَانِيِّ الَّذِيْ تُفْتَحُ الْقُسْطَنْطِيْنِيَّةُ وَرُوْمِيَّةُ عَلَى يَدَيْهِ، يَخْرُجُ الدَّجَّالُ وَ فِيْ زَمَانِهِ يَنْزِلُ عِيْسَى ابْنُ مَرْيَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ، عَلَى يَدَيْهِ تَكُوْنُ غَزْوَةُ الْهِنْدِ، وَهُوَ مِنْ بَنِيْ هَاْشِمٍ، غَزْوَةُ الْهِنْدِ الَّتِي قَالَ فِيْهَا أَبُوْ هُرَيْرَةَ.
قَالَ الْوَلِيدُ: قَالَ جَرَّاحٌ، عَنْ أَرْطَاةَ، عَلَى يَدَيْ ذَلِكَ الْخَلِيفَةِ، وَهُوَ يَمَانٌ، تَكُونُ غَزْوَةُ الْهِنْدِ الَّتِي قَالَ فِيهَا أَبُو هُرَيْرَةَ
قُلْتُ: إِسْنَاْدُهُ إلى أَرْطَاْةَ صَحِيْحٌ.
অর্থ:“ওয়ালিদ বিন মুসলিম রহিমাহুল্লাহ জাররাহ বিন মালীহ থেকে, তিনি বিশিষ্ট তাবেয়ী আরতাত রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন; আরতাত রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইয়ামানী খলিফার নেতৃত্বে কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) ও রোম বিজয় হবে। তাঁর সময়েই দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে। তাঁর যুগেই ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন এবং তাঁর নেতৃত্বেই হিন্দুস্তানের যুদ্ধ সংঘটিত হবে। তিনি হবেন হাশেমী বংশের লোক। আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) হিন্দের এই যুদ্ধ সম্পর্কেই (হাদীস) বর্ণনা করেছেন।” [2] -আলফিতান, নুআইম বিন হাম্মাদ ১/৪১০, হাদীস ১২৩৮, ১২০১
বর্ণনাটির মান: বর্ণনাটির সনদ সহীহ।
নিম্নে রাবি বা বর্ণনাকারীগণের সংক্ষিপ্ত পরিচিত পেশ করা হলো-
১. ওয়ালিদ বিন মুসলিম আলকুরাশী আবুল আব্বাস আদদিমাশকী। জন্ম ১১৯ হি., মৃত্যু ১৯৫ হি.। ইমাম আবু হাতিম, ইজলী, ইয়াকুব বিন শায়বাহ ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ তাঁকে ‘ছিক্বাহ’ (নির্ভরযোগ্য) বলেছেন। -তাহযীবুল কামাল ৭/৪৮৭, রাবি ৭৩৩২; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/২১১; তাযকিরাতুল হুফফায ১/২২২
২. জাররাহ বিন মালীহ, আলবাহরানী। মৃত্যু ১৭১-১৮০ হি.। আবু হাতিম বলেন, صَالِحُ الْحَدِيْثِ (তিনি হাদীস বর্ণনায় যোগ্য), নাসাঈ বলেন, صَدُوْقٌ، لَيْسَ بِهِ بَأسٌ (তিনি রাবি হিসেবে সত্যপরায়ণ, কোনো সমস্যা নেই)। -তাহযীবুল কামাল ১/৪৪২, রাবি ৮৯৪; তা’রীখুল ইসলাম ৪/৫৯২
৩. আরতাত বিন মুনযির। জন্ম ৭৩ হি., মৃত্যু ১৬৩ হি.। তাঁর পুরো নাম হল, আরতাত বিন মুনযির বিন আসওয়াদ বিন সাবিত আসসুকুনী আবু আদি। তিনি শামের হিমস এলাকার অধিবাসী। তিনি সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) ও আবু উমামাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) প্রমুখ সাহাবীদের সাক্ষাত পেয়েছিলেন। আরতাত রহিমাহুল্লাহ আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু)কে পাননি। কারণ তাঁর জন্মের পূর্বে আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। তবে তার বেশ কয়েকজন ছাত্র বা তার থেকে বর্ণনাকারীগণকে পেয়েছেন এবং তাঁদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব, আব্দুর রহমান ইবনে গনম আলআশআরি, আতা ইবনে আবি রবাহ, উমায়ের ইবনুল আসওয়াদ, কাছির বিন মুররাহ ও মুজাহিদ বিন জাবর প্রমুখ। ইমাম আহমাদ বলেন, ثقة ثقة (তিনি হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য)। ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, তিনি ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য। ইবনু হিব্বান বলেন, ثقة حافظ فقيه (তিনি ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য, হাফেযে হাদীস ও ফকীহ।) -তাহযীবুল কামাল ১/১৬১, রাবি ২৯২; তা’রীখুল ইসলাম ৪/৩০৪ (আবু হুরায়রাহ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর ছাত্রদের তালিকা-তাহযীবুল কামাল ৮/৪৪৮-৪৪৯, রাবি ৮২৭৬
সম্ভবত আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর উক্ত ছাত্রদের থেকে শুনে আরতাত রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) হিন্দের এই যুদ্ধ সম্পর্কেই (হাদীসটি) বর্ণনা করেছেন।”
প্রকাশ থাকে যে, উক্ত হাদীসে ‘ইয়ামানী খলিফা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হাশেমী বংশের একজন খলীফা, যিনি (কিয়ামাতের পূর্বে এসে প্রথমে) ইয়েমেনে বসবাস করে বাইতুল মুক্বাদ্দাসে আগমন করবেন। তাঁর শাসনামলে পৃথিবী ন্যায়-ইনসাফে ভরে যাবে। তিনিই হবেন হাদীসে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী।[3]
বিশিষ্ট তাবিঈ কা’আব আহবার রহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনা
আরতাত রহিমাহুল্লাহ এর বক্তব্যকে অধিকতর স্পষ্ট করে দেয় বিশিষ্ট তাবিঈ কা’আব আহবার রহিমাহুল্লাহ এর এ-সংক্রান্ত একটি বর্ণনা। বর্ণনাটি নুআইম বিন হাম্মাদ ‘আলফিতান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,
حَدَّثَنَا الْحَكَمُ بْنُ نَافِعٍ عَمَّنْ حَدَّثَهُ عَنْ كَعْبٍ قَالَ:"يَبْعَثُ مَلِكٌ فِيْ بَيْتِ الْمَقْدِسِ جَيْشًا إِلَى الْهِنْدِ فَيَفْتَحُهَا، فَيَطَئُوْا أَرْضَ الْهِنْدِ، وَيَأْخُذُوْا كُنُوْزَهَا، فَيُصَيِّرُهُ ذَلِكَ الْمَلِكُ حِلْيَةً لِبَيْتِ الْمَقْدِسِ، وَيُقَدِّمُ عَلَيْهِ ذَلِكَ الْجَيْشُ بِمُلُوْكِ الْهِنْدِ مُغَلَّلِيْنَ، وَيُفْتَحُ لَهُ مَابَيْنَ الْمَشْرِقِ وِالْمَغْرِبِ، وَيَكُوْنُ مَقَامُهُمْ فِيْ الْهِنْدِ إِلَى خُرُوْجِ الدَّجَّالِ".
قُلْتُ: رِجَالُ هَذَا الْإِسْنَادِ ثِقَاتٌ إِلَّا أَنَّ فِيْهِ اِنْقِطَاعٌ ظَاهِرًا، وَلَعَلَّ الْمَحْذُوفَ فِيْهِ "صَفْوَانَ بْنِ عَمْرٍو عَنْ شُرَيْحِ بْنِ عُبَيْدٍ"، وَالدَّلِيْلُ عَلَيْهِ أَنَّ نُعَيْمَ بْنَ حَمَّادٍ رَوَىَ فِي كِتَابِهِ "الْفِتَن" غَيْرَ وَاحِدٍ مِنَ الْأَحَادِيْثِ مِنْ طَرِيْقِ "الْحَكَمِ بْنِ نَافِعٍ عَنْ صَفْوَانَ بْنِ عَمْرٍو عَنْ شُرَيْحِ بْنِ عُبَيْدٍ عَنْ كَعْبٍ الْأَحْبَارِ"، (و أَرْقَامُهُ 238،241،294،609،667)
অর্থ:“নুআইম বিন হাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ হাকাম বিন নাফি’ থেকে, তিনি জনৈক শায়খ থেকে, তিনি কা’ব আহবার থেকে বর্ণনা করেছেন; কা’ব রহিমাহুল্লাহ বলেন, বাইতুল মাকদিসের (জেরুসালেমের) একজন বাদশাহ হিন্দুস্তানের দিকে একটি সৈন্যদল পাঠাবেন। সৈন্যদল হিন্দুস্তানের ভূমি জয় করে তা পদানত করবে। তারা সেখানকার গুপ্ত ধন-ভাণ্ডার করায়ত্ব করবেন। তারপর বাদশাহ এসব ধনদৌলত বাইতুল মাকদিসের সৌন্দর্য বর্ধনে ব্যবহার করবেন। সৈন্যদলটি হিন্দুস্তানের রাজাদের শিকল দিয়ে বেঁধে বন্দী করে তাঁর নিকট উপস্থিত করবে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সকল এলাকায় তিনি জয়লাভ করবেন। দাজ্জালের আবির্ভাব পর্যন্ত তাঁরা হিন্দুস্তানেই অবস্থান করবেন।” -নুআইম বিন হাম্মাদ, আলফিতান ১/৪০৯, হাদীস ১২৩৫, ১২১৫
হাদীসটির মান: সনদটির বর্ণনাকারীগণ ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য। তবে সনদে বাহ্যত ইনকিতা বা রাবির বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। সম্ভবত হাকাম বিন নাফি’ বর্ণনাটি বলার সময় সংক্ষিপ্ত করার জন্য মাঝের দুজন বর্ণনাকারীর নাম (সফওয়ান বিন আমর ও শুরাইহ বিন উবায়দ) বাদ দিয়েছেন। আর বিষয়টি এভাবে বুঝে আসে যে, নুআইম বিন হাম্মাদ ‘আলফিতান’ গ্রন্থে হাকাম বিন নাফি’ থেকে, তিনি সফওয়ান বিন আমর থেকে, তিনি শুরাইহ বিন উবায়দ থেকে, তিনি কা’ব আহবার থেকে
(الحَكَمِ بْنِ نَافِعٍ عَنْ صَفْوَانَ بْنَ عَمْرٍو عَنْ شُرَيْحِ بْنِ عُبَيْدٍ عَنْ كَعْبٍ الْأَحْبَارِ) একাধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন। (হাদীস ২৩৮, ২৪১, ২৯৪, ৬০৯, ৬৬৭)
নিম্নে রাবি বা বর্ণনাকারীগণের সংক্ষিপ্ত পরিচিত পেশ করা হলো-
১. হাকাম বিন নাফি’ আবুল ইয়ামান আলবাহরানী। তিনি হিমসের অধিবাসী ছিলেন। জন্ম. ১৩৮ হিজরি এবং মৃত্যু ২২২ হিজরি। তিনি হাফিযে হাদীস ছিলেন, হাদীসের ক্ষেত্রে তাকে ইমাম হিসেবে গণ্য করা হত। তিনি উচ্চপর্যায়ের ছিকাহ রাবি ছিলেন। সফওয়ান বিন আমর ও আরতাত বিন মুনযির থেকে তিনি হাদীস শুনেছেন। -তাযকিরাতুল হুফফায ১/৩০১, রাবি ৪১৮
২. সফওয়ান ইবনে আমর (জন্ম ৭২ হি., মৃত্যু ১৫৫ হি.)। তিনি তাবিঈ ছিলেন। তিনি শুরাইহ বিন উবায়দ ও অন্যান্যদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। হাফেয যাহাবি রহিমাহুল্লাহ তার সম্পর্কে বলেন,
هُوَ الإِمَامُ المُحَدِّثُ الحَافِظُ، أَبُوْ عَمْرٍو السَّكْسَكِيْ، الحِمْصِيْ، مُحَدِّثُ حِمْص. ثِقَةٌ مِنْ صِغَارِ التَّابِعِيْنَ.
“তিনি হাদীসের ইমাম, মুহাদ্দিস ও হাফেযে হাদীস। হিমসের অধিবাসী এবং সেখানকার বিশিষ্ট মুহাদ্দিস। হাদীসের বর্ণনাকারী হিসেবে ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য, তাবিঈদের অন্তর্ভুক্ত।” -তাহযীবুল কামাল ৩/৪৬১, রাবি ২৮৭৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/৩৮০
৩. শুরাইহ বিন উবায়দ। তিনি তাবিঈ ছিলেন। তিনি শামের হিমস এলাকার অধিবাসী। মৃত্যু ১০০ হিজরির পরে। ইমাম নাসাঈ, ইজলী ও দুহাইম বলেন, তিনি ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য। -তাহযীবুল কামাল ৩/৩৮০, রাবি ২৭১১; তাকরীবুত তাহযীব, রাবি ২৭৭৫, পৃ. ২৬৫
৪. কা’ব আলআহবার। তিনি ইয়ামানের অধিবাসী ছিলেন। অতঃপর শামে বসবাস করেন। কা’ব আহবার রহিমাহুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামানা পেয়েছেন, তবে ইসলাম গ্রহণ করেছেন আবু বকর (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর খেলাফতকালে। তিনি উসমান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর খেলাফতকালে ইন্তেকাল করেন। হাফেয যাহাবি রহিমাহুল্লাহ বলেন, “ কা’ব আহবার রহিমাহুল্লাহ সোহাইব রুমি, ওমর ইবনুল খাত্তাব ও আয়শা (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। ...তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুরসাল (সাহাবির নাম বাদ দিয়ে) হাদীসও বর্ণনা করেন।” -তাহযীবুল কামাল ৬/১৬৯, রাবি ৫৫৬৯, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/৪৮৯
একটি পর্যালোচনা
ইসলামের প্রাচীন কোনো কোনো ইতিহাসগ্রন্থে হিন্দুস্তানের যে সকল অভিযানকে ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে, তার আলোকে কিছু কথা
উপরোক্ত সহীহ হাদীসসমূহ ও আছারের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে, গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী শেষ জামানায় ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের পূর্ব সময়ে প্রকাশ পাবে। সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে দু’টি ঘটনা (গাযওয়ায়ে হিন্দ ও দাজ্জালের বিরুদ্ধে ঈসা আলাইহিস সালামের যুদ্ধ) একই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ দু’টি ঘটনা যে একই সময়ে ঘটবে, তা তাবেঈ আরতাত রহিমাহুল্লাহ (যিনি সাওবান রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এর যুগের একজন তাবেঈ) এর আছার থেকে খুবই স্পষ্ট।
তথাপি কারো কারো ধারণা, উক্ত হাদীসগুলোতে আলোচিত ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ অতীতে সংঘটিত হয়ে গেছে। তারা দাবি করেন যে, শেষ জামানায় দাজ্জাল বের হওয়ার পূর্বে পুনরায় ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে উক্ত হাদীসগুলোতে কোনো ইঙ্গিত বা নির্দেশনা নেই। তারা নিজেদের মতের পক্ষে ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ ও আল্লামা সিদ্দীক হাসান খান রহিমাহুল্লাহ এর বক্তব্যকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন।
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ স্বীয় ‘আন-নিহায়াহ ফিল ফিতান’ গ্রন্থে ‘অচিরেই মুসলিম সৈন্যবাহিনী হিন্দ ও সিন্ধে পৌঁছবে মর্মে নববী ইঙ্গিত’ অধ্যায়ের অধীনে বলেন, ‘মুসলিমগণ মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর যুগে ৪৪ হিজরীতে হিন্দে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেছেন।’ ইবনে কাসীরের এই বক্তব্য থেকে তারা ধরে নিয়েছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গাযওয়ায়ে হিন্দের ভবিষ্যদ্বাণী মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর যুগে ৪৪ হিজরীর হিন্দ-অভিযানের মাধ্যমেই পূর্ণ হয়ে গেছে।
কিন্তু ইবনে কাসীর ও সিদ্দীক হাসান খান রহিমাহুল্লাহ এর পুরো বক্তব্যকে সামনে রাখলে বিষয়টি সেরকম বুঝে আসে না।
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ শুধু মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর যুগের অভিযানই নয় বরং এর পরবর্তী মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিম রহিমাহুল্লাহ এর হিন্দ অভিযান[4] ও সুলতান মাহমুদ গজনবীর হিন্দ-অভিযানগুলোকেও ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ স্বীয় ইতিহাস-গ্রন্থসমূহে তাঁর যুগ পর্যন্ত সংঘটিত এসবগুলো ঘটনাকে গাযওয়ায়ে হিন্দের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং সিদ্দীক হাসান খান রহিমাহুল্লাহও ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ এর মতো ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’কে অতীতের কোনো ঘটনার মাঝে সীমাবদ্ধ করেননি। নিম্নে ইবনে কাসীর ও সিদ্দীক হাসান খান রহিমাহুল্লাহ এর মূল বক্তব্য তুলে ধরা হল-
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৭৭৪ হি.) ‘আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ’ গ্রন্থে الاخْبَارُ عَنْ غَزْوَةِ الْهِنْدِ (গাযওয়াতুল হিন্দ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ) শিরোনামের অধীনে অত্র প্রবন্ধে প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীস উল্লেখ করে বলেন,
وَقَدْ غَزَا الْمُسْلِمُوْنَ الْهِنْدَ فِي أَيَّامِ مُعَاوِيَةَ سَنَةَ أَرْبَعِ وَّأَرْبَعِيْنَ، وَكَانَتْ هُنَالِكَ أُمُوْرٌ سَيَأْتِيْ بَسْطُهَا فِي مَوْضِعِهَا، وَقَدْ غَزَا الْمَلِكُ الْكَبِيْرُ الْجَلِيْلُ مَحْمُوْدُ بْنُ سُبُكْتُكِينْ، صَاحِبُ غَزْنَةَ، فِي حُدُوْدِ أَرْبَعِمِائَةٍ، بِلَادَ الْهِنْدِ فَدَخَلَ فِيْهَا وَقَتَلَ وَأَسَرَ وَسَبَى وَغَنِمَ وَدَخَلَ السُّومْنَاتْ وَكَسَرَ النّدَّ الْاَعْظَمَ الَّذِيْ يَعْبُدُوْنَهُ . . . . ثُمَّ رَجَعَ سَالِمًا مُؤَيَّدًا مَنْصُوْرًا.
“৪৪ হিজরিতে মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর শাসনামলে মুসলমানরা সর্বপ্রথম হিন্দুস্তানে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। সেসময়ের ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত বিবরণ সামনে আলোচনা করা হবে।[5] হিজরি চার শত (৪০০) সনের দিকে গযনীর সুলতান মাহমুদ সবুক্তগীনও হিন্দুস্তানে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন।[6] সেসকল যুদ্ধে তিনি অনেক মুশরিককে হত্যা ও বন্দি করেন এবং গনিমত হিসেবে প্রচুর ধন-সম্পদ লাভ করেন। তিনি সোমনাথ মন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তিপূজকদের সবচেয়ে বড় মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলেন। .... এরপর তিনি বিজয়বেশে নিরাপদে হিন্দুস্তান থেকে গজনিতে ফিরে আসেন।” -ইবনে কাসীর, আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ : ৪/৬৩১
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৭৭৪ হি.) তাঁর ‘আননিহায়াহ ফিল ফিতান’ গ্রন্থে প্রায় কাছাকাছি আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি
إِشَارَةٌ نَبَوِيَّةٌ إِلَى أَنَّ الْجَيْشَ الْمُسْلِمَ سَيَصِلُ إِلَى الْهِنْدِ وَالسِّنْدِ
(অচিরেই হিন্দ এবং সিন্ধুতে মুসলিমবাহিনীর প্রবেশের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী) শিরোনামের অধীনে অত্র পুস্তিকার প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীস উল্লেখ করার পরে বলেন,
وَقَدْ غَزَا الْمُسْلِمُوْنَ الْهِنْدَ فِي سَنَةِ أَرْبَعِ وَأَرْبَعِيْنَ فِي إِمَارَةِ مُعَاوِيَةَ بْنِ أَبِيْ سُفْيَانَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فَجَرَتْ هُنَاكَ أُمُوْرٌ فَذَكَرْنَاهَا مَبْسُوطَةً، وَقَدْ غَزَاهَا الْمَلِكُ الْكَبِيْرُ السَّعِيْدُ مَحْمُودُ بْنُ سُبُكْتُكِينْ صَاحِبُ بِلَادِ غَزْنَةَ وَمَا وَالَاهَا فِي حُدُوْدِ أَرْبَعِ مِائَةٍ فَفَعَلَ هُنَالِكَ أَفْعَالًا مَشْهُورَةً وَأُمُوْراً مَشْكُورَةً وَكَسَرَ الصَّنَمَ الْأَعْظَمَ الْمُسَمَّى بِسُومْنَاتْ . . . وَرَجَعَ إِلَى بِلَادِهِ سَالِماً غَانِماً.
“৪৪ হিজরীতে মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর শাসনামলে মুসলমানরা সর্বপ্রথম হিন্দুস্তান আক্রমণ করে। সেসময়ের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হিজরী চার শত (৪০০) সনের দিকে গযনী ও তার আশপাশের অঞ্চলের মহান অধিপতি সুলতান মাহমুদ সবুক্তগীনের হিন্দুস্তান-অভিযান ও তাঁর বীরত্বের কাহিনী সর্বজনবিদিত এবং প্রশংসিত। তিনি সেখানের সোমনাথ মন্দিরের সর্ববৃহৎ মূর্তিটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেন। .... এরপর তিনি গনিমত হিসেবে প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিয়ে নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যান।” -আননিহায়াহ ফিল ফিতান ওয়াল মালাহিম, ইবনে কাসীর পৃ.১২
আল্লামা ছিদ্দিক হাসান খান কিন্নৌজী রহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ১৩০৭হি.) বলেন,
وَأَمَّا الْهِنْدُ : فَقَدْ فُتِحَ فِي عَهْدِ الْوَلِيْدِ بْنِ عَبْدِ الْمَلِكِ عَلى يَدِ مُحَمَّدِ بْنِ قَاسِمٍ الثَّقَفِيِّ سَنَةَ اثْنَتَيْنِ وَتِسْعِيْنَ الْهِجْرِيَّةَ وَبَلَغَتْ رَايَاتُهُ الْمِظَلَّةُ عَلَى الْفَوْجِ مِنْ حُدُوْدِ السِّنْدِ إِلَى أَقْصَى قَنُوْجَ سَنَةَ خَمْسِ وَتِسْعِيْنَ وَبَعْدَ مَا عَادَ وُلَاةُ الْهِنْدِ إِلَى أَمْكِنَتِهِمْ وَبَقِيَ الْحُكَّامُ مِنَ الْخُلَفَاءِ الْمَرْوَانِيَّةِ وَالْعَبَّاسِيَّةِ بِبِلَادِ السِّنْدِ وَقَصَدَ السُّلْطَانُ مَحْمُوْدُ الغَزْنَوِيُّ - أَوَاخِرَ الْمِائَةِ الرَّابِعَةِ - غَزْوَ الْهِنْدِ وَأَتَى مِرَارًا وَغَلَبَ وَأَخَذَ الْغَنَائِمَ ........ وَمِنْ هَذَا التَّارِيْخِ إِلَى آخِرِ الْمِائَةِ الثَّانِيَةَ عَشَرَ كَانَتْ مَمَالِكُ الْهِنْدِ فِي يَدِ السَّلَاطِيْنِ الْإِسْلَامِيَّةِ.
“আর হিন্দুস্তানের বিষয় হলো, হিজরী ৯২ সালে উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের [7] শাসনামলে মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিমের নেতৃত্বে হিন্দুস্তান বিজয়ের সূচনা হয়। ৯৫ হিজরীতে সিন্ধু থেকে কনৌজের শেষসীমানা পর্যন্ত মুসলমানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর হিন্দুস্তানের ক্ষমতায় রদবদল হলেও সিন্ধুতে ধারাবাহিকভাবে উমাইয়া এবং আব্বাসি খলীফাদের প্রতিনিধিগণ দাপটের সাথে রাজত্ব করেছেন। ৪র্থ হিজরীর শেষ দিকে সুলতান মাহমুদ গযনবী হিন্দুস্তানে আক্রমণ করেন। দফায় দফায় হামলা চালিয়ে তিনি বিজয় ছিনিয়ে আনেন এবং প্রচুর গনীমত লাভ করেন।..........
(অতঃপর সুলতান মাহমুদ গযনবীর ক্ষমতা গ্রহণ, তাঁর শাসনাধীন বিস্তীর্ণ এলাকার বিবরণ, সুলতান মুঈযুদ্দীন ঘুরীর আগমন এবং ৫৮৯ হিজরিতে হিন্দুস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরের বর্ণনা করে) সিদ্দীক হাসান খান রহিমাহুল্লাহ বলেন, তখন থেকে হিজরি ১২শত শতক পর্যন্ত হিন্দুস্তানের ক্ষমতা ইসলামী সালতানাতের অধীনেই ছিল।” - আবজাদুল উলূম ৩/২১৪
ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ তাঁর কিতাবে আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) বর্ণিত বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের প্রথম দুটি হাদীস এনেছেন। যেখানে শুধু হিন্দুস্তানে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। সেটা কবে হবে বা শেষ জামানায় হবে কিনা (যা অন্যান্য হাদীসে এসেছে) সে হাদীসদ্বয়ে এমন কিছু বলা হয়নি। তাই ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ তাঁর জামানা পর্যন্ত হিন্দের সকল যুদ্ধকে এই হাদীসদ্বয়ের অধীনে আলোচনায় এনেছেন। অনুরূপভাবে সিদ্দীক হাসান খান রহিমাহুল্লাহও গাযওয়ায়ে হিন্দকে বিশেষ কোনো জামানার সাথে নির্দিষ্ট করেননি। তিনিও মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর যুগের অভিযান, মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিমের হিন্দ অভিযান বা এর পরের সুলতান মাহমুদ গযনবী ও সুলতান মুঈযুদ্দীন ঘুরীসহ সকলের অভিযানকে ‘গাযওয়ায়ে হিন্দে’র মাঝে শামিল করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের সময় পর্যন্ত অতীতে হিন্দের ভূমিতে মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে সংঘটিত হওয়া সকল যুদ্ধকে হিন্দের যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করেছেন। নির্দিষ্ট কোনোটাকেই ‘গাযওয়ায়ে হিন্দে’র চূড়ান্ত বা সর্বশেষ যুদ্ধ হিসেবে সাব্যস্ত করেননি। তাদের কথার পূর্বাপর থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, ভবিষ্যতের সকল যুদ্ধও হিন্দের যুদ্ধের মাঝে শামিল হবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে হিন্দের কোনো অভিযান গাযওয়ায়ে হিন্দের মাঝে শামিল হবে না, এমন দাবিও তাঁরা করেননি। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, ইবনে কাসীর বা সিদ্দীক হাসান খান রহিমাহুল্লাহ এর কথার উদ্ধৃতি দিয়ে এমনটি দাবি করা মোটেও যৌক্তিক হবে না যে, তাঁদের মতে হাদীসে প্রতিশ্রুত গাযওয়ায়ে হিন্দ অতীতেই সম্পন্ন হয়ে গেছে!
তবে বাস্তবতা এটাই যে, ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে হিন্দের জমিনে মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হলেও অত্র প্রবন্ধে উল্লিখিত সহীহ হাদীসসমূহ ও আছারের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে, গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী এখনো ঘটেনি, বরং শেষ জামানায় ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের পূর্ব-সময়ে প্রকাশ পাবে। এবং এ যুদ্ধের অবশিষ্ট মুজাহিদরা ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে শামে সাক্ষাৎ করবে। এতদসংক্রান্ত হাদীস আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।
সুতরাং অতীতে ঘটে যাওয়া মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর জামানায় হিন্দ অভিযান, মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিম বা সুলতান মাহমুদ গজনবীর হিন্দ অভিযানের মাধ্যমে হাদীসে আলোচিত ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ এর সমাপ্তি ঘটার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রসঙ্গত, হাদীসে প্রতিশ্রুত ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ শেষ জামানায় ঘটার ব্যাপারে সহীহ রেওয়ায়েতের পাশাপাশি সমকালীন কতিপয় মুহাক্কিকও মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন-
শাইখ হামূদ তুওয়াইজিরী রহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু: ১৪১৩ হি.) বলেন,
وَمَا ذُكِرَ فِيْ حَدِيْثِ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ الَّذِيْ رَوَاهُ نُعَيْمُ بْنُ حَمَّادٍ مِنْ غَزْوِ الْهِنْدِ؛ فَهُوَ لَمْ يَقَعْ إِلَى الْآنَ، وَسَيَقَعُ عَنْدَ نُزُوْلِ عِيْسَى ابْنِ مَرْيَمَ عَلَيْهِمَا الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ إِنْ صَحَّ الْحَدِيْثُ بِذَلِكَ. وَاللهُ أَعْلَمُ.
“নুআইম বিন হাম্মাদ কর্তৃক বর্ণিত আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর হাদীসে যে গাযওয়ায়ে হিন্দের কথা এসেছে তা এখনো সংঘটিত হয়নি। এ হাদীসটি সহীহ হলে সত্বরই তা ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর অবতরণের সময়কালে সংঘটিত হবে।” -ইতহাফুল জামাআহ ১/৩৬৬, গাযওয়ায়ে হিন্দ সংক্রান্ত অধ্যায়।
শাইখ সালেহ আলমুনাজ্জিদ বলেন,
الَّذِيْ يَبْدُوْ مِنْ ظَاهِرِ حَدِيْثِ ثَوْبَانَ وَحَدِيْثِ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ـ إِنْ صَحَّ ـ أَنَّ غَزْوَةَ الْهِنْدِ الْمَقْصُوْدَةَ سَتَكُوْنُ فِيْ آخِرِ الزَّمَانِ، فِي زَمَنِ قُرْبِ نُزُوْلِ عِيْسَى بْنِ مَرْيَمَ عَلَيْهِمَا السَّلَامُ ، وَلَيْسَ فِي الزَّمَنِ الْقَرِيْبِ الَّذِيْ وَقَعَ فِي عَهْدِ مُعَاوِيَةَ بْنِ أَبِيْ سُفْيَانَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ.
“সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) ও আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর হাদীস সহীহ হয়ে থাকলে এর স্পষ্ট ভাষ্য থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কাঙ্খিত গাযওয়ায়ে হিন্দ শেষ জামানায় ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর অবতরণের নিকটবর্তী সময়ে সংঘটিত হবে। মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর যুগের কাছাকাছি সময়ে যে সকল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলো নয়। -ইসলাম সুওয়াল ও জাওয়াব: প্রশ্নোত্তর নং- ১৪৫৬৩৬ (www.islamqa.info/ar/145636)
Collected
(চলবে, ইনশা আল্লাহ)
[1]. তাহযীবুল কামাল ১/৪১৮, রাবি ৮৪৪; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৩/১৫, রাবি ৫
[2]. কুসতুনতুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপল বিজয়: একটি জিজ্ঞাসার জবাব
قَالَ رَسُوْلُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " لَتُفْتَحَنَّ الْقُسْطَنْطِينِيَّةُ، فَلَنِعْمَ الْأَمِيرُ أَمِيرُهَا، وَلَنِعْمَ الْجَيْشُ ذَلِكَ الْجَيْشُ ".
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ‘অবশ্যই কুসতুনতুনিয়া (ইস্তাম্বুল) বিজিত হবে, কতই না উত্তম ঐ বিজয়ের সেনাপতি, আর কতই না উত্তম বাহিনী সেই বাহিনী!”
ইমাম হাকেম রহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। হাইসামী রহিমাহুল্লাহ বলেন: হাদীসটির বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। -মুসনাদে আহমদ ৩১/২৮৭, হাদীস ১৮৯৫৭; মুসতাদরাকে হাকেম ৪/৪৬৮, হাদীস ৮৩০০; মাজমাউয যাওয়াইদ ৬/২১৮
উল্লেখ্য, উক্ত হাদীসে কুসতুনতুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের কোনো সময় উল্লেখ করা হয়নি। তবে ঐতিহাসিকগণ বলেন, ৮৫৭ হিজরি মোতাবেক ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে মুহাম্মাদ আলফাতেহ কুসতুনতুনিয়া বিজয় করেন। তাঁর মাধ্যমে এই হাদীসের বাস্তবায়ন ঘটে। মুহাম্মাদ আলফাতেহ ৮৩৩ হিজরি মোতাবেক ১৪২৯ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৮৬ হিজরি মোতাবেক ১৪৮১ খৃষ্টাব্দে ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।-আলআলাম, যিরিকলি ৭/২২৮; তারীখুত দাওলাতিল উসমানীয়্যাহ, আমির শাকিব আরসালান পৃ. ৯০; আলমুনজিদ ফীল আ’লাম পৃ. ২৫, ৫৩০
১৯২৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সেখানে ইসলামি শরীআ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে (উসমানী খেলাফতের পতনের পর) অদ্যাবধি সেখানে শরীআ আইন নেই বরং মানব রচিত আইনে শাসন চলছে। আর উপরের হাদীসে উক্ত এলাকা দাজ্জালের আবির্ভাব ও ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন সময়ে বিজয়ের কথা বলা হয়েছে।
[3] . কিয়ামতের পূর্বেইমাম মাহদীর আগমন সম্পর্কে বেশ কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেখান থেকে দু‘টি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হল।
এক. ইমাম মাহদীর আগমনের সময় পৃথিবী জুলুমে পরিপূর্ণ থাকবে। তিনি এসে সারা পৃথিবীতে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন। হাদীসটি নিম্নরূপ;
عَنْ عَلِيٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَوْ لَمْ يَبْقَ مِنَ الدَّهْرِ إِلَّا يَوْمٌ، لَبَعَثَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ رجُلاَ مِنْ أَهْلِ بَيْتِيْ يَمْلَؤُهَا عَدْلاَ كَمَا مُلِئَتْ جَوْرًا.
আলী (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যদি পৃথিবীর একদিন সময়ও বাকি থাকে, তবুও আল্লাহ তাআলা নবী পরিবারের এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন। তিনি এসে জুলুম-অত্যাচারে পূর্ণ পৃথিবীকে ন্যায় ও ইনসাফে পরিপূর্ণ করে দিবেন। শায়খ শুয়াইব আরনাউত বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। -সুনানে আবু দাউদ ৬/৩৪১, হাদীস ৪২৮৩, তাহকীক- শায়খ শুয়াইব আরনাউত।
দুই. ইমাম মাহদী হবেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর। তিনি ন্যায়-ইনসাফের সাথে সাত বছর পৃথিবী শাসন করবেন।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
اَلْمَهْدِيُّ مِنِّيْ أَجْلَى الْجَبْهَةِ، أَقْنَى الْأَنْفِ، يَمْلَأُ الْأَرْضَ قِسْطْاً وَعَدْلاً، كَمَا مُلِئَتْ جَوْراً وظُلْماً، يَمْلِكُ سَبْعَ سِنِيْنَ.
ইমাম মাহদী আমার বংশগত সন্তান। তিনি প্রশস্ত ললাটের অধিকারী ও উঁচু নাক বিশিষ্ট হবেন। তিনি জুলুম-অত্যাচারে পূর্ণ পৃথিবীকে ন্যায়-নীতি ও ইনসাফে ভরপুর করবেন। তিনি সাত বছর পৃথিবী শাসন করবেন। শায়খ শুয়াইব আরনাউত বলেন, হাদীসটির সনদ জাইয়িদ।-সুনানে আবু দাউদ ৬/৩৪২, হাদীস ৪২৮৫, তাহকীক- শায়খ শুয়াইব আরনাউত; বাযলুল মাজহুদ, ১২/৩২৭-৩২৮; শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী বলেন, হাদীসটির সনদ হাসান। -সহীহ ওয়া যয়ীফ সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৮৫
[4]. মুহাম্মাদ বিন ক্বাসিমের হিন্দ অভিযান ছিল ৯৩ থেকে ৯৫ হিজরির মধ্যে।
[5]. মুআবিয়া (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) (মৃত্যু ৬০ হি.) এর জামানায় হিন্দুস্তানের অভিযান সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন- তারীখে খলীফা ইবনে খাইয়াত, ইবনে খাইয়াত (মৃত্যু ২৪০ হি.) পৃ. ৪৮-৪৯; আলকামিল, ইবনুল আসীর (মৃত্যু ৬৩০ হি.) ২/১১৯, অধ্যায়: সিন্ধু অভিযান;আলবিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসীর, ৬/২৪৯; তারিখুল ইসলাম, যাহাবী ৪/১২; আলইবার, যাহাবী (মৃত্যু ৭৪৮ হি.) ১/৩৭; তারিকে দিমাশক, ইবনে আসাকির (মৃত্যু ৫৭১ হি.) ৬১/২৮৯
[6]. সুলতান মাহমুদ গযনবী রহিমাহুল্লাহ এর হিন্দুস্তান অভিযান সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন- আলবিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনে কাসীর, ১১/৩৭৯-৩৮৮
[7]. ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিক ৮৬ হিজরীতে তার পিতা আব্দুল মালিকের মৃত্যুর পরে খলীফা নিযুক্ত হন। - আলমুখতাসার ফি আখবারিল বাশার ১/১৩৭
Comment