দারুল ইরফান কর্তৃক প্রকাশিত
কা‘ব বিন মালেক রাযি. এর ঘটনা থেকে শিক্ষা
শায়খ আবু আব্দুল্লাহ উসামা রহ.
এর থেকে
পর্ব-১২
==================================================
===============================
আমি জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকা এবং মিথ্যা বলা, দুই গুনাহ একত্র করতে পারবো না
হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, তিনি এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার নিকট কৃতজ্ঞ যে, তার সাথে সে আচরণ করা হয়নি যা মুনাফিকদের সাথে করা হয়েছে। যদি তিনিও অন্যদের মত মিথ্যা বলতেন তাহলে ধ্বংস হয়ে যেতেন।
ইতোপূর্বে যখন তাকে বলা হয়েছিল যে, কোন বাহানা পেশ করো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ক্ষমা দ্বারা তোমার ক্ষমা লাভ হয়ে যাবে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকা এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে মিথ্যা বলা, দুই গুনাহ একত্র করতে পারবো না।
এটা সেসব লোকদের জন্য চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্র, যারা শুধু জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকিনি। বরং এর সাথে সরলমনা আল্লাহর বান্দাদেরকে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ থেকে বাধা প্রদানের মত জঘন্য কাজ করছে! এরা নিজেরাও কৃপণতা করছে আবার অন্যদেরকে কৃপণতার দাওয়াত দিচ্ছে। এগুলো এমন ভয়ানক বৈশিষ্ট্য যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কঠোর নিন্দা করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলার বাণী,
الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ
‘যারা (নিজেরাও) কার্পণ্য করে এবং অন্যদেরকে কার্পণ্যের নির্দেশ দেয়।’
‘যারা (নিজেরাও) কার্পণ্য করে এবং অন্যদেরকে কার্পণ্যের নির্দেশ দেয়।’
কৃপণতা একটি বিপদ। যদি আপনি কৃপণতা কিংবা কাপুরুষতার রোগে আক্রান্ত হোন তাহলে আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কিন্তু প্রশ্ন হলও এই, আপনি অন্যদেরকেও কার্পণ্যের হুকুম দেন কেন? লোকদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে না দিয়ে আপনার কি লাভ হবে? লোকেরা নিজেদের ‘দ্বীন’ রক্ষায় অগ্রসর না হলে আপনার কোন স্বার্থ হাসিল হবে? আসল কথা হচ্ছে, এই যুগটাই হল শয়তানের ছড়ানো সংশয় ও কুমন্ত্রণার। এদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘প্রকৃত পক্ষে এই ব্যক্তি শয়তান, সে মুমিনদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়। তাই তোমরা তাদের ভয় না করে আমাকে ভয় কর। যদি তোমরা মুমিন হেয় থাকো।’ [1]
আজও যদি মুষ্টিমেয় কয়েক হাজার লোক আল্লাহর রাহে খাঁটি নিয়তে জিহাদে বের হয় তাহলে আল্লাহর অনুগ্রহে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ হতে পারে। এবং এ কথা আমি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ায় এই পথে এবং ময়দানে বিশ বছরের অধিক অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি। নিশ্চয় যাবতীয় অনুগ্রহ ও দয়া আল্লাহ তাআলারই পক্ষ থেকে।
নিজে বের হচ্ছিনা অন্যকেও বাধা দিচ্ছি
আজকের সমস্যা গুলোর মাঝে একটি জটিল সমস্যা হল, অনেক লোক ভিত্তিহীন ওজর আপত্তি পেশ করে। মূলত শয়তানই তাদের মস্তিষ্কে এসব অলিক কল্পনা ঢেলে দেয় এবং সেগুলোকে সুসজ্জিত করে দেখায়। এ জাতীয় লোককে সব সময় আপনি এক ধরনের বাহানা পেশ করতে দেখবেন। যেমন কখনো আপনাকে বলবে, যদি সবাই জিহাদে বেরিয়ে যায় তাহলে দ্বীনের অন্য কাজগুলো কে করবে। ফলস্বরূপ সাধারণ জনগণ এ সকল সংশয়ের শিকার হয়ে বসে থাকে। এ লোকেরা তাদের গুনাহের বোঝা বহন করেও মনে মনে ভাবতে থাকে যে, তারা নিজের উপর আরোপিত দ্বীনের নুসরাতের ফরজ দায়িত্ব আদায় করে ফেলেছে। অতএব, হে আল্লাহর বান্দারা! জিহাদ থেকে পশ্চাতে বসে থাকার সাথে জিহাদে বাধা প্রদান এবং এ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার গুণাহ থেকে সাবধান হোন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الْمُعَوِّقِينَ مِنْكُمْ وَالْقَائِلِينَ لِإِخْوَانِهِمْ هَلُمَّ إِلَيْنَا وَلا يَأْتُونَ الْبَأْسَ إِلا قَلِيلًا
‘আল্লাহ তোমাদের মধ্যকার সেসব লোকদেরকে খুব ভাল করে জানেন যারা (তার পথে) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।’[2]
সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তাআলা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে ভালভাবে অবগত আছেন। অতএব, নিজের নফসের পরীক্ষা গ্রহণ করুন! সে কোথাও আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছেনা তো। যেমন সাইয়্যেদুনা কা‘ব রাযি. এবং তার সাথীদের নফস তাদেরকে ধোঁকা দিয়েছিল।
হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলারই জন্য যিনি আমাকে সত্যের দিকে পরিচালিত করেছেন এবং আমাকে এ অনুগ্রহে ভূষিত করেছেন। ইসলাম গ্রহণের পর আমার প্রতি আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হল, আমি মিথ্যা থেকে বেঁচে গেছি। নতুবা আমিও সেসব লোকদের মত ধ্বংস হয়ে যেতাম যারা মিথ্যা বলেছে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের নিন্দা বর্ণনায় এমন কঠোর শব্দ ব্যবহার করেছেন যা অন্য কারো ক্ষেত্রে করেন নি।’
মিথ্যা বাহানা সৃষ্টি কারীদেরকে আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত কঠোর ভাবে শাস্তি দিয়ে থাকেন, সুতরাং ইরশাদ হয়েছে,
سَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ إِذَا انْقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ إِنَّهُمْ رِجْسٌ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ > يَحْلِفُونَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنْ تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لا يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ
“যখন তোমরা তাদের কাছে (যুদ্ধ শেষে) ফিরে যাবে তখন তোমাদের সামনে আল্লাহর নামে শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের থেকে পাশ কেটে যাও। সুতরাং তোমরা তাদেরকে পাশ কেটে যাও, নিঃসন্দেহে তারা অপবিত্র এবং তাদের ঠিকানা জাহান্নাম তাদের কর্মের প্রতিফলস্বরূপ। এরা তোমাদের সামনে শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ তো অবাধ্য সম্প্রদায়ের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।“ [3]
এই হাদিসে কা‘ব বিন মালেক রাযি. নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। অতএব নিজেকে যাচাই করার এবং আত্ম সংশোধন করে সঠিক পথে ফিরে আসার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের আদর্শ। তিনি আমাদের মাপকাঠি।
ঈমান, জিহাদ এবং সততা ঈমানদারদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য
সামনে আল্লাহ তাআলা উম্মাহর আসলাফদের আদর্শ বর্ণনা করে বলেন,
لَكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَأُولَئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং যারা তাঁর সাথে ঈমান এনেছে, তাঁরা জিহাদ করেছে।“ [4]
ঐ সময় জিহাদ থেকে শুধুমাত্র সেই মরুবাসী বেদুইনরাই পিছনে থাকত যাদের দ্বীনের কোন বুঝ ছিল না। কিন্তু তারা নিজেদের ব্যাপারে ধারণা রাখতো যে, তারা মুমিন। সুতরাং যখন তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে অনুগ্রহ প্রকাশের ছলে বলল, আমরা ঈমান নিয়ে এসেছি। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَالَتِ الْأَعْرَابُ آَمَنَّا قُلْ لَمْ تُؤْمِنُوا وَلَكِنْ قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوبِكُمْ وَإِنْ تُطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ لا يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“মরুবাসীরা বলে যে, আমরা ঈমান নিয়ে এসেছি। বলে দিন, তোমরা ঈমান আনয়ন করনি। বরং বলও, আমরা (বাহ্যিক ভাবে) অনুগত হয়েছ। অথচ এখনো তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি।“ [5]
পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের গুণাবলি এবং তাদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ
“মুমিন তো সেসব লোক, যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর ঈমান আনয়ন করে অতঃপর কোন সংশয়ে পড়েনা এবং আল্লাহর পথে নিজের সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করে। তারাই ঈমানে সত্যবাদী।“ [6]
আল্লাহু আকবার! বিবেকবানদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। যদি কেউ মুমিন হতে চায়, তবে তো আল্লাহ তাআলা তার সামনে তার ঈমানের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে দিয়েছে। তা হচ্ছে, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি সংশয়হীন ঈমান ও বিশ্বাস এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে তাঁর পথে জিহাদ। জিহাদের পরই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সততার কথা উল্লেখ করেছেন। এবং এটাই সেই বৈশিষ্ট্য যার বদৌলতে হযরত কা‘ব রাযি. এর মুক্তি লাভ হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুবারক বাণী,
فإن الصدق يهدي إلى البر،وإنَّ البرَّ يهدي إلى الجنةِ وإنه يعني الرجلَ ليصدقُ ويتحرى الصدقَ حتى يُكتبَ عندَ اللهِ صدِّيقًا
নিশ্চয় সত্য কথা মানুষকে সৎকর্মের দিকে নিয়ে যায়। আর সৎকর্ম তাকে জান্নাতে নিয়ে যায়। মানুষ যখন সত্য কথা বলতে থাকে এবং সত্য বলতে সন্ধানী হয়। তখন, এক সময় সে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী বলে গণ্য হয়। [7]
অতএব, সততার হাতল মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরুন! এবং অবাধ্যতা ও পাপাচার থেকে দূরে থাকুন! দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি আমাদেরকে সততার বৈশিষ্ট্য দান করুন। এবং আমাদেরকে সত্যবাদীদের দলভুক্ত করুন!
[1] সূরা আলে-ইমরান: ১৭৫
[2] সূরা আহযাব: ১৮
[3] সূরা তাওবা - ৯৫, ৯৬
[4] সুরা তাওবা: ৮৮
[5] সূরা হুজুরাত: ১৪
[6] সূরা হুজুরাত: ১৫
[7] সহীহুল মুসলিম; বাবুল বির্রি ওযাস সিলাত ওয়াল আদাব, ৪৭২১
আরও পড়ুন
১১তম পর্ব ----------------------------------------------------------------- ১৩ তম পর্ব
Comment