আবু মারিয়া আল কাহতানী আর আবু মুহাম্মাদ আল আদনানী দুইজনই ছিলেন আল কায়েদা ইন ইরাকের তুখোড় মুজাহিদ। ২০০৪ সালে আল কায়েদা ইন ইরাকে যোগ দেয়ার মাধ্যমে তাদের জিহাদী জীবনের সূচনা ঘটে। জিহাদে যোগ দেয়ার পরপরই তারা নিজেদের প্রতিভা ও দক্ষতার মাধ্যমে শাইখ যারকাওয়ীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এক সময় শাহাদাত হয় শাইখ যারকাবীর। আল কায়েদা ইন ইরাক অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন এর মধ্যে দিয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে তারাও হয়ে ওঠেন ইরাকের জিহাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হলে তার প্রভাব পড়ে সিরিয়ায়। সিরিয়ায় শুরু হয় জিহাদ। ইরাক থেকে যাদেরকে তখন পাঠানো হয়েছিলে সিরিয়ায় তাদের মধ্যে আবু মারিয়া আল কাহতানী ছিলেন অন্যতম। সিরিয়ান জিহাদের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিতে পরিণত হন। আর আবু মুহাম্মাদ আদনানী ইরাকে থেকে যান ইরাকের জিহাদেরই অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হয়ে। শামে জাবহাত আন নুসরাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আমীর হন আবু মুহাম্মাদ আল জাওলানী।
২০১৪ সালের ফিতনার বছরে দাওলাতুল ইরাক আল কায়েদার বাইআত ভঙ্গ করে ও খিলাফতের ঘোষণা দেয়। আবু মুহাম্মাদ আল আদনানী হন খাওয়ারিজ দায়েশের মুখপাত্র। ঘোষণা দিয়ে আল কায়েদার বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ শুরু করেন। আবু মারিয়া আল কাহতানী ছিলেন খারেজীদের বিরুদ্ধে অন্যতম সর্বাধিক ব্যক্তি। ফলে আইসিসও তাকে মুরতাদ্দ ও বিশ্বাসঘাতক ফতোয়া দিয়ে তার রক্ত হালাল ঘোষণা দেয়।
এতোদিন একই পতাকাতলে একই উদ্দেশ্যে জিহাদ করলেও কিছু ষড়যন্ত্রকারী প্রাক্তন কমিউনিস্ট ফাত্তানদের উচ্চাভিলাসের বলি হয়ে দুইজন মানুষই পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হন। ২০১৬ সালে আবু মুহাম্মদ আল আদনানী আমেরিকার হামলায় মৃত্যুবরণ করেন।
শামের জিহাদ সরলভাবেই চলছিলো। ২০১৫ সাল নাগাদ মুজাহিদগণ দামেস্কের দরজায় পৌছে গিয়েছিলো্ একদিকে ইরান-বাশার-হিজবুল্লাত জোটের সংগে বাকি সকল মুজাহিদ জামাআতের যুদ্ধ। এদিকে আল কায়েদার দূরদর্শী প্রবীণ মুজাহিদদের নিষেধ সত্ত্বেও খারেজী আইসিস তাদের কল্পিত খিলাফতের বিস্তৃতি ঘটাতে শামে আগ্রাসন ঘটায়। বিদ্রোহীদের দখল করা অধিকাংশ এলাকা তারা দখল করে নেয়।
আইএসের শামে ঢুকাটা ছিলো শামের জন্য ফিতনার ট্রিগার। এতোদিন সকল জিহাদী জামাআতের মেশিনগান মাজুসীদের দিকে নিবদ্ধ থাকলেও আইসিস এসে, "আগে ঘরের শত্রুকে দমন করতে হবে" এই নীতি ফলো করে জিহাদী জামাআতগুলোকে তাকফীর করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের পিছন থেকে আক্রমণ শুরু করে। ফলে অন্যান্য জিহাদী জামাআতও তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ঘুরিয়ে দেয়।
দাঈশের এই রোগ মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে শামের সকল জিহাদী জামাআতগুলোর মধ্যে। জিহাদী জামাআতগুলো তখন একে অপরের দখল করা ভুখন্ড কেড়ে নেয়ার প্রতিযোগীতা শুরু করে ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
রাশিয়া ও পশ্চিমারা যুদ্ধক্ষেত্রে নামার পরে এই বিদ্রোহী জামাআতগুলো তাদের বিরুদ্ধে লড়াই না করেই তাদের দখল করা ভূখন্ড ফেলে ফেলে চলে যেতে থাকে। এভাবেই দামেশক, হলব, হিমস, হামা, দেইর আয-যুর, রাক্কা নগরী একে একে ফেলে ফেলে সবাই ইদলিবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সময়ে জাবহাত আন নুসরা ভেঙ্গে প্রথমে জাবহাত ফাতেহ আশ শাম এবং জাবহাত ফাতেহ আশ শাম ভেঙ্গে আরো অনেক জামাআত নিয়ে তাহরীরুশ শাম গঠন করা হয়। ২০১৭ সালের শেষের দিকে তাহরীরুশ শাম আল কায়েদার সঙ্গে বায়াত ভঙ্গ করে। আবু মারিয়া আল কাহতানী ছিলেন তাহরীর শামের সেকেন্ড হ্যান্ড ইন কমান্ড। আল কায়েদার সঙ্গে বাইআত ভঙ্গ করতে জাওলানীকে যারা প্ররোচনা দিচ্ছিলো তিনি ছিলেন তাদেরই একজন।
ইদলিব ছিলো সর্বশেষ ঘাঁটি যা তাহরীরুশ শাম(বিলুপ্ত জাবহাত আন নুসরা) এর দখলে বাকি ছিলো। রাশিয়া ইরান জোট সবগুলো ভুখন্ড দখলের পরে ইদলিব দখলের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তখন জিহাদী জামাআতগুলো তুরস্কের সাহায্য চাইতে শুরু করে। তাহরীর আশ শাম সহ সকল অধিকাংশ বিদ্রোহী গোষ্ঠী তুরস্কের আনুগত্য মেনে নেয়। সেক্যুলার তুরস্কের ইচ্ছাই ছিলো আল কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।
হাইআত তাহরীরুশ শামের ওপর সেক্যুলার তুরস্কের প্রভাব বাড়ায় এবং জাওলানী ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করায় শাইখ সামী আল উরাইদী, শাইখ আব্দুল্লাহ আল মুহাইসিনি সহ বড় বড় মুজাহিদ কমান্ডার তখন এটি ছেড়ে চলে যান। শরীআহকামী মুজাহিদগণ তাহরীর আল শাম ছেড়ে গঠন করেন হুররাস আদ দ্বীন। তাহরীরুশ সেই সময় থেকেই তানযীম হুররাস আদ দ্বীনকে ভালো চোখে দেখেনি। আল কায়েদাকে ইদলিব থেকে বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর ছিলো। কয়েকবার হুররাস আদ দ্বীনের ওপর তাহরীরুশ শাম আক্রমণ করে, ফলে উভয় পক্ষের বহু মুজাহিদ মারা যান।
তুর্কী সেনারা তখন তথাকথিত ইদলিব রক্ষার জন্য ফ্রন্টলাইনে চলে আসে। বিষয়টা যেনো এমন যে শামের লক্ষাধিক বিদ্রোহী ইদলিবকে বাঁচাতে পারছে না, তাই তুর্কী সেনাদের নামতে হলো। ইদলিবের চতুর্দিকে তখন তুর্কী ও রাশিয়ান সেনারা মুখোমুখি অবস্থান নিচ্ছিলো। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিন এরদোগান, পুতিন ও ইরানের রুহানী তেহরানে আলোচনায় বসে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে। এটি ছিলো শামের বিদ্রোহী দলগুলোর জন্য অপমানজনক। এই চুক্তির মাধ্যমে শামের শরীআহকামী হকপন্থী মুজাহিদ জামাআতগুলো ছাড়া তাহরীরুশ শামসহ বাকি সকল বিদ্রোহী দলগুলোই প্রায় তুরস্কের কন্ট্রোলে চলে যায়। তুরস্কের ইচ্ছায়ই কয়েক জায়গা থেকে তাহরীরুশ শামের মুজাহিদগণ সারেন্ডার করে ও ইদলিবে চলে আসে।
২০২২ সালে শাইখ যাওয়াহিরি এর সম্ভাব্য শাহাদাতের নিউজ প্রকাশ পাওয়ার পর তার এক টেলিগ্রাম চ্যানেলে আবু মারিয়া আল কাহতানী আল কায়েদার হাতে বাইআত দেয়া মুজাহিদ ও তাদের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে একটি নসীহাহ প্রেরণ করেন। এই নসীহাতে তিনি বলেন যে আল কায়েদার নেতা নাকি ইরানে আছেন। এই কারনে আল কায়েদা নাকি ইরান কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। তিনি এই নসীহাহতে আল কায়েদাকে ভেঙ্গে দেয়ার প্রস্তাবনা দেন। তিনি আল কায়েদা ইন জাযীরাতুল আরব সহ বিভিন্ন জিহাদী জামাআতের প্রতি আহবান জানান যেনো এই জিহাদী জামাআতকে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়।
তখন বিভিন্ন ইয়ামান সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মুজাহিদগণ তার এই মতামতের বিরোধিতা করেন এবং আল কায়েদা ইরান কর্তৃক পরিচালিত হওয়ার দাবিকে তারা মিথ্যা অপবাদ হিসেবে সাব্যস্ত করেন। তার এই আহবানকে হাস্যকর ও অযৌক্তিক সাব্যস্ত করেন।
২০২২ সালের শেষের দিকে সাংবাদিক ওয়াসিম নাসর ইদলিব সফরে যান। আল কায়েদার বিরুদ্ধে নিজেদের যুদ্ধের বিষয়টা তিনি খোলাসাই প্রকাশ করেন। ওয়াসিম নাসরের কাছে তিনি আল কায়েদার ব্যাপারে বলেন, "আমরা তরুণদেরকে এর আল কায়েদা বা আইএসে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখছি। সেটা শুধু জোর করেই না, তাদেরকে এটাও দেখাচ্ছি যে আমাদের সিস্টেমও যথেষ্ট।"
কিন্তু তিনি তো এক যুগ ধরে আল কায়েদার অধীনে যুদ্ধ করেছেন। এটার ব্যাপারে কি হবে? তিনি এই ব্যাপারে বলেন, "we made a mistake!"
"ভুল করেছিলাম। আমরা দশকের পর দশক কাটিয়েছি যুদ্ধে। আমার যৌবন যুদ্ধের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। এখন আমরা অন্য কিছুর সন্ধানে আছি। আমরা আর পশ্চিমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই যারা আমাদের ভুমিকে ব্যবহার করে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে।"
আল কায়েদাকে ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারে তার বিভিন্ন সময়ে করা মতামতের ব্যাপারে জানতে চান সাংবাদিক ওয়াসিম নাসর। এর জবাবে আবু মারিয়া আল কাহতানি বলেন, "আমি প্রকাশ্যেই এই আহবান করেছি। এমনকি আমি আল কায়েদা ইয়েমেনের কাছেও এই বার্তা পাঠিয়েছিলাম যে, আপনাদের এবার থামতে হবে।"
এসব কাজের কারণ হিসেবে বলেন, "এর কারণ হলো আল কায়েদার নেতা সাইফ আল আদল, ইরানে আছে। এর দ্বারা কি প্রমাণ হয়? আমরা আমাদের সুন্নি সংগঠনকে ইরান দ্বারা পরিচালিত করতে চাই না।"
তিনি সাংবাদিক ওয়াসিম নাসরকে এই বার্তাগুলো পাবলিকে প্রকাশ করতেও বলেন।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে তার নিজ সংগঠন হাইআত তাহরীর শামের আমির জাওলানী তাকে গ্রেফতার করে, যদিও তিনি জাওলানীর সেকেন্ড কমান্ড ইন হ্যান্ড হিসেবে পরিচিত। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিলো যে তাহরীর শামের বিরুদ্ধে তিনি আমেরিকান-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন জোটের পক্ষ হয়ে গোয়েন্দাবৃত্তি করছেন! কারণ তার পার্সোনাল সহকারীর কাছে কোয়ালিশন জোটের কাছে এসপিওনাজ একটিভিটির প্রমাণ নাকি পাওয়া যায়।
কারাগারে থাকতেই রিউমার ছড়ায় যে তিনি অত্যাধিক নির্যাতনের মুখে মারা গেছেন। এই সংবাদ চাউর হলে জাওলানী তার সহযোগীদের অসন্তোষের মুখে পড়েন। তাহরীরুশ শামের আরেক উচ্চপর্যয়ায়ের কমান্ডার আবু আহমেদ আল যাকুর তাহরীর শাম পরিত্যাগ করেন এই অভিযোগে যে জাওলানী তার ক্ষমতা অপব্যবহার করছেন। কিন্তু পরে জানা যায় এখনো বেঁচে আছেন। এই বছরের মার্চ মাসে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
মুক্তি দেয়ার পরপরই ৪ এপ্রিল ২০২৪ ইদলিবে তার এক বাসায় তাকে বোমা হামলা করে হত্যা করা হয়। যদিও এর কারণ হিসেবে অনেকে আইএসকে দায়ী করছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ তার দায় স্বীকার করেনি। ষড়যন্ত্রতত্ববিদরা তার হত্যার জন্য খোদ তাহরীরুশ শামকেই দায়ী করছেন।
[বিঃদ্রঃ আমি তার ব্যাপারে পার্সোনাল মন্তব্য যোগ করা থেকে বিরত থাকছি। তার কাজের সমালোচনা যা করার মুজাহিদদের পক্ষ থেকে অতীতে করা হয়েছে। এখানে যা বর্ণনা করলাম তা এক দীর্ঘশ্বাস সৃষ্টিকারী দাস্তান মাত্র। আল্লাহ পাক পৃথিবীর সকল মুজাহিদ জামাআতসমুহকে বিজয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে দ্বীনকায়েমের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার মতো হালত থেকে হেফাজত করুন]
[সিরিয়ান জিহাদী জামাআতগুলোর তুর্কীর দখলে চলে যাওয়ার ঘটনা বেশ সাড়া জাগানো ছিলো এবং জিহাদের পথের পথিক সকল ভাইয়ের জন্যই তা জেনে রাখা জরুরী বলে মনে করি। কাজে যাদের পক্ষে সম্ভব ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত শামের জিহাদে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাপঞ্জি অধ্যয়ন করে রাখা উচিত। এটা ইনশাআল্লাহ ভাইদের জিহাদী জীবনের ক্ষেত্রে খুব কাজে দেবে বলে মনে করি। কারণ এখানে যারা এখন পাঠক তাদের সবাই তো আর সবসময় পাঠক থাকবেন না! একদিন তাদের কেউ হয়তো ঝানু মুজাহিদ কমান্ডার হবেন।]
[আমার পক্ষে সম্ভব হলে ওই সময়কার দাস্তান ও তার প্রভাব-পরিণতি নিয়ে লিখবো ইনশাআল্লাহ।]
২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হলে তার প্রভাব পড়ে সিরিয়ায়। সিরিয়ায় শুরু হয় জিহাদ। ইরাক থেকে যাদেরকে তখন পাঠানো হয়েছিলে সিরিয়ায় তাদের মধ্যে আবু মারিয়া আল কাহতানী ছিলেন অন্যতম। সিরিয়ান জিহাদের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিতে পরিণত হন। আর আবু মুহাম্মাদ আদনানী ইরাকে থেকে যান ইরাকের জিহাদেরই অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হয়ে। শামে জাবহাত আন নুসরাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আমীর হন আবু মুহাম্মাদ আল জাওলানী।
২০১৪ সালের ফিতনার বছরে দাওলাতুল ইরাক আল কায়েদার বাইআত ভঙ্গ করে ও খিলাফতের ঘোষণা দেয়। আবু মুহাম্মাদ আল আদনানী হন খাওয়ারিজ দায়েশের মুখপাত্র। ঘোষণা দিয়ে আল কায়েদার বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ শুরু করেন। আবু মারিয়া আল কাহতানী ছিলেন খারেজীদের বিরুদ্ধে অন্যতম সর্বাধিক ব্যক্তি। ফলে আইসিসও তাকে মুরতাদ্দ ও বিশ্বাসঘাতক ফতোয়া দিয়ে তার রক্ত হালাল ঘোষণা দেয়।
এতোদিন একই পতাকাতলে একই উদ্দেশ্যে জিহাদ করলেও কিছু ষড়যন্ত্রকারী প্রাক্তন কমিউনিস্ট ফাত্তানদের উচ্চাভিলাসের বলি হয়ে দুইজন মানুষই পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হন। ২০১৬ সালে আবু মুহাম্মদ আল আদনানী আমেরিকার হামলায় মৃত্যুবরণ করেন।
শামের জিহাদ সরলভাবেই চলছিলো। ২০১৫ সাল নাগাদ মুজাহিদগণ দামেস্কের দরজায় পৌছে গিয়েছিলো্ একদিকে ইরান-বাশার-হিজবুল্লাত জোটের সংগে বাকি সকল মুজাহিদ জামাআতের যুদ্ধ। এদিকে আল কায়েদার দূরদর্শী প্রবীণ মুজাহিদদের নিষেধ সত্ত্বেও খারেজী আইসিস তাদের কল্পিত খিলাফতের বিস্তৃতি ঘটাতে শামে আগ্রাসন ঘটায়। বিদ্রোহীদের দখল করা অধিকাংশ এলাকা তারা দখল করে নেয়।
আইএসের শামে ঢুকাটা ছিলো শামের জন্য ফিতনার ট্রিগার। এতোদিন সকল জিহাদী জামাআতের মেশিনগান মাজুসীদের দিকে নিবদ্ধ থাকলেও আইসিস এসে, "আগে ঘরের শত্রুকে দমন করতে হবে" এই নীতি ফলো করে জিহাদী জামাআতগুলোকে তাকফীর করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের পিছন থেকে আক্রমণ শুরু করে। ফলে অন্যান্য জিহাদী জামাআতও তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ঘুরিয়ে দেয়।
দাঈশের এই রোগ মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে শামের সকল জিহাদী জামাআতগুলোর মধ্যে। জিহাদী জামাআতগুলো তখন একে অপরের দখল করা ভুখন্ড কেড়ে নেয়ার প্রতিযোগীতা শুরু করে ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
২০১৫ সালে ইরানিয়ান জেনারেল কাসেম সুলাইমানী রাশিয়ায় যায়। শামের মুজাহিদদের বিরুদ্ধে সে পুতিনের সহায়তা ভিক্ষা চায়। ফলে রাশিয়া ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তার বিপুল শক্তি নিয়ে সিরিয়ায় চলে আসে। একই সময়ে "আইএস দমনের" নামে আমেরিকা তার কোয়ালিশন জোট নিয়ে সিরিয়ায় চলে আসে। এই সময়টাতে নিম্নোক্ত আয়াতের অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন ঘটে:-
وَ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ لَا تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا وَ تَذۡهَبَ رِیۡحُکُمۡ وَ اصۡبِرُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿ۚ۴۶﴾
আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর, পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ করো না, তা করলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে, তোমাদের শক্তি-ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।
-সুরাহ আনফাল আয়াত ৪৬
وَ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ لَا تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا وَ تَذۡهَبَ رِیۡحُکُمۡ وَ اصۡبِرُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿ۚ۴۶﴾
আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর, পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ করো না, তা করলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে, তোমাদের শক্তি-ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।
-সুরাহ আনফাল আয়াত ৪৬
রাশিয়া ও পশ্চিমারা যুদ্ধক্ষেত্রে নামার পরে এই বিদ্রোহী জামাআতগুলো তাদের বিরুদ্ধে লড়াই না করেই তাদের দখল করা ভূখন্ড ফেলে ফেলে চলে যেতে থাকে। এভাবেই দামেশক, হলব, হিমস, হামা, দেইর আয-যুর, রাক্কা নগরী একে একে ফেলে ফেলে সবাই ইদলিবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সময়ে জাবহাত আন নুসরা ভেঙ্গে প্রথমে জাবহাত ফাতেহ আশ শাম এবং জাবহাত ফাতেহ আশ শাম ভেঙ্গে আরো অনেক জামাআত নিয়ে তাহরীরুশ শাম গঠন করা হয়। ২০১৭ সালের শেষের দিকে তাহরীরুশ শাম আল কায়েদার সঙ্গে বায়াত ভঙ্গ করে। আবু মারিয়া আল কাহতানী ছিলেন তাহরীর শামের সেকেন্ড হ্যান্ড ইন কমান্ড। আল কায়েদার সঙ্গে বাইআত ভঙ্গ করতে জাওলানীকে যারা প্ররোচনা দিচ্ছিলো তিনি ছিলেন তাদেরই একজন।
ইদলিব ছিলো সর্বশেষ ঘাঁটি যা তাহরীরুশ শাম(বিলুপ্ত জাবহাত আন নুসরা) এর দখলে বাকি ছিলো। রাশিয়া ইরান জোট সবগুলো ভুখন্ড দখলের পরে ইদলিব দখলের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তখন জিহাদী জামাআতগুলো তুরস্কের সাহায্য চাইতে শুরু করে। তাহরীর আশ শাম সহ সকল অধিকাংশ বিদ্রোহী গোষ্ঠী তুরস্কের আনুগত্য মেনে নেয়। সেক্যুলার তুরস্কের ইচ্ছাই ছিলো আল কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।
হাইআত তাহরীরুশ শামের ওপর সেক্যুলার তুরস্কের প্রভাব বাড়ায় এবং জাওলানী ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করায় শাইখ সামী আল উরাইদী, শাইখ আব্দুল্লাহ আল মুহাইসিনি সহ বড় বড় মুজাহিদ কমান্ডার তখন এটি ছেড়ে চলে যান। শরীআহকামী মুজাহিদগণ তাহরীর আল শাম ছেড়ে গঠন করেন হুররাস আদ দ্বীন। তাহরীরুশ সেই সময় থেকেই তানযীম হুররাস আদ দ্বীনকে ভালো চোখে দেখেনি। আল কায়েদাকে ইদলিব থেকে বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর ছিলো। কয়েকবার হুররাস আদ দ্বীনের ওপর তাহরীরুশ শাম আক্রমণ করে, ফলে উভয় পক্ষের বহু মুজাহিদ মারা যান।
তুর্কী সেনারা তখন তথাকথিত ইদলিব রক্ষার জন্য ফ্রন্টলাইনে চলে আসে। বিষয়টা যেনো এমন যে শামের লক্ষাধিক বিদ্রোহী ইদলিবকে বাঁচাতে পারছে না, তাই তুর্কী সেনাদের নামতে হলো। ইদলিবের চতুর্দিকে তখন তুর্কী ও রাশিয়ান সেনারা মুখোমুখি অবস্থান নিচ্ছিলো। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিন এরদোগান, পুতিন ও ইরানের রুহানী তেহরানে আলোচনায় বসে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে। এটি ছিলো শামের বিদ্রোহী দলগুলোর জন্য অপমানজনক। এই চুক্তির মাধ্যমে শামের শরীআহকামী হকপন্থী মুজাহিদ জামাআতগুলো ছাড়া তাহরীরুশ শামসহ বাকি সকল বিদ্রোহী দলগুলোই প্রায় তুরস্কের কন্ট্রোলে চলে যায়। তুরস্কের ইচ্ছায়ই কয়েক জায়গা থেকে তাহরীরুশ শামের মুজাহিদগণ সারেন্ডার করে ও ইদলিবে চলে আসে।
২০২২ সালে শাইখ যাওয়াহিরি এর সম্ভাব্য শাহাদাতের নিউজ প্রকাশ পাওয়ার পর তার এক টেলিগ্রাম চ্যানেলে আবু মারিয়া আল কাহতানী আল কায়েদার হাতে বাইআত দেয়া মুজাহিদ ও তাদের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে একটি নসীহাহ প্রেরণ করেন। এই নসীহাতে তিনি বলেন যে আল কায়েদার নেতা নাকি ইরানে আছেন। এই কারনে আল কায়েদা নাকি ইরান কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। তিনি এই নসীহাহতে আল কায়েদাকে ভেঙ্গে দেয়ার প্রস্তাবনা দেন। তিনি আল কায়েদা ইন জাযীরাতুল আরব সহ বিভিন্ন জিহাদী জামাআতের প্রতি আহবান জানান যেনো এই জিহাদী জামাআতকে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়।
তখন বিভিন্ন ইয়ামান সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মুজাহিদগণ তার এই মতামতের বিরোধিতা করেন এবং আল কায়েদা ইরান কর্তৃক পরিচালিত হওয়ার দাবিকে তারা মিথ্যা অপবাদ হিসেবে সাব্যস্ত করেন। তার এই আহবানকে হাস্যকর ও অযৌক্তিক সাব্যস্ত করেন।
২০২২ সালের শেষের দিকে সাংবাদিক ওয়াসিম নাসর ইদলিব সফরে যান। আল কায়েদার বিরুদ্ধে নিজেদের যুদ্ধের বিষয়টা তিনি খোলাসাই প্রকাশ করেন। ওয়াসিম নাসরের কাছে তিনি আল কায়েদার ব্যাপারে বলেন, "আমরা তরুণদেরকে এর আল কায়েদা বা আইএসে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখছি। সেটা শুধু জোর করেই না, তাদেরকে এটাও দেখাচ্ছি যে আমাদের সিস্টেমও যথেষ্ট।"
কিন্তু তিনি তো এক যুগ ধরে আল কায়েদার অধীনে যুদ্ধ করেছেন। এটার ব্যাপারে কি হবে? তিনি এই ব্যাপারে বলেন, "we made a mistake!"
"ভুল করেছিলাম। আমরা দশকের পর দশক কাটিয়েছি যুদ্ধে। আমার যৌবন যুদ্ধের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। এখন আমরা অন্য কিছুর সন্ধানে আছি। আমরা আর পশ্চিমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই যারা আমাদের ভুমিকে ব্যবহার করে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে।"
আল কায়েদাকে ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারে তার বিভিন্ন সময়ে করা মতামতের ব্যাপারে জানতে চান সাংবাদিক ওয়াসিম নাসর। এর জবাবে আবু মারিয়া আল কাহতানি বলেন, "আমি প্রকাশ্যেই এই আহবান করেছি। এমনকি আমি আল কায়েদা ইয়েমেনের কাছেও এই বার্তা পাঠিয়েছিলাম যে, আপনাদের এবার থামতে হবে।"
এসব কাজের কারণ হিসেবে বলেন, "এর কারণ হলো আল কায়েদার নেতা সাইফ আল আদল, ইরানে আছে। এর দ্বারা কি প্রমাণ হয়? আমরা আমাদের সুন্নি সংগঠনকে ইরান দ্বারা পরিচালিত করতে চাই না।"
তিনি সাংবাদিক ওয়াসিম নাসরকে এই বার্তাগুলো পাবলিকে প্রকাশ করতেও বলেন।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে তার নিজ সংগঠন হাইআত তাহরীর শামের আমির জাওলানী তাকে গ্রেফতার করে, যদিও তিনি জাওলানীর সেকেন্ড কমান্ড ইন হ্যান্ড হিসেবে পরিচিত। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিলো যে তাহরীর শামের বিরুদ্ধে তিনি আমেরিকান-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন জোটের পক্ষ হয়ে গোয়েন্দাবৃত্তি করছেন! কারণ তার পার্সোনাল সহকারীর কাছে কোয়ালিশন জোটের কাছে এসপিওনাজ একটিভিটির প্রমাণ নাকি পাওয়া যায়।
কারাগারে থাকতেই রিউমার ছড়ায় যে তিনি অত্যাধিক নির্যাতনের মুখে মারা গেছেন। এই সংবাদ চাউর হলে জাওলানী তার সহযোগীদের অসন্তোষের মুখে পড়েন। তাহরীরুশ শামের আরেক উচ্চপর্যয়ায়ের কমান্ডার আবু আহমেদ আল যাকুর তাহরীর শাম পরিত্যাগ করেন এই অভিযোগে যে জাওলানী তার ক্ষমতা অপব্যবহার করছেন। কিন্তু পরে জানা যায় এখনো বেঁচে আছেন। এই বছরের মার্চ মাসে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
মুক্তি দেয়ার পরপরই ৪ এপ্রিল ২০২৪ ইদলিবে তার এক বাসায় তাকে বোমা হামলা করে হত্যা করা হয়। যদিও এর কারণ হিসেবে অনেকে আইএসকে দায়ী করছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ তার দায় স্বীকার করেনি। ষড়যন্ত্রতত্ববিদরা তার হত্যার জন্য খোদ তাহরীরুশ শামকেই দায়ী করছেন।
[বিঃদ্রঃ আমি তার ব্যাপারে পার্সোনাল মন্তব্য যোগ করা থেকে বিরত থাকছি। তার কাজের সমালোচনা যা করার মুজাহিদদের পক্ষ থেকে অতীতে করা হয়েছে। এখানে যা বর্ণনা করলাম তা এক দীর্ঘশ্বাস সৃষ্টিকারী দাস্তান মাত্র। আল্লাহ পাক পৃথিবীর সকল মুজাহিদ জামাআতসমুহকে বিজয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে দ্বীনকায়েমের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার মতো হালত থেকে হেফাজত করুন]
[সিরিয়ান জিহাদী জামাআতগুলোর তুর্কীর দখলে চলে যাওয়ার ঘটনা বেশ সাড়া জাগানো ছিলো এবং জিহাদের পথের পথিক সকল ভাইয়ের জন্যই তা জেনে রাখা জরুরী বলে মনে করি। কাজে যাদের পক্ষে সম্ভব ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত শামের জিহাদে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাপঞ্জি অধ্যয়ন করে রাখা উচিত। এটা ইনশাআল্লাহ ভাইদের জিহাদী জীবনের ক্ষেত্রে খুব কাজে দেবে বলে মনে করি। কারণ এখানে যারা এখন পাঠক তাদের সবাই তো আর সবসময় পাঠক থাকবেন না! একদিন তাদের কেউ হয়তো ঝানু মুজাহিদ কমান্ডার হবেন।]
[আমার পক্ষে সম্ভব হলে ওই সময়কার দাস্তান ও তার প্রভাব-পরিণতি নিয়ে লিখবো ইনশাআল্লাহ।]
Comment