হে বোন! আপনার স্বামী যখন বন্দী, আপনার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জেনে নিন-
বন্দীত্ব বড়ই কষ্টের জীবন। বন্দীত্বের কষ্ট পুরোমাত্রায় অনুধাবন করা কেবল একজন বন্দীর পক্ষেই সম্ভব। আর আল্লাহ তো সর্বজ্ঞানী। বন্দীত্ব একজনের জীবনে বড় এক বিপদের অধ্যায়। নৈকট্যের ক্রমানুসারে একজন বন্দীর পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই- বোন ও অন্যান্য স্বজনরা এই বিপদে কম বা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। কারাগারে একজন বন্দীর দিন যত বাড়তে থাকে উক্ত ক্ষতির পরিধিও ততই বেড়ে যায়। তবে সার্বিক বিচারে দেখা যায়, একজন নারী তার স্বামীর বন্দীতে সবচেয়ে বেশী পারিপার্শ্বিক জটিলতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। এজন্যই এ পর্বের নাসীহা এ সকল বোনদের উদ্দেশ্যে, যাদের স্বামীগণ কারাগারে বন্দী।
প্রথমেই মনে রাখতে হবে, কেউ স্বেচ্ছায় বন্দী হতে বা কোন বিপদে পতিত হতে চায় না। জীবন চলার পথে এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। সুতরাং বিপদ যখন এসেই গেল এ সম্পর্কে আল্লাহর বাণী দেখে নেই, আল্লাহ বলেন:
مَاۤ اَصَابَ مِنۡ مُّصِیۡبَۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا فِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ نَّبۡرَاَہَا ؕ اِنَّ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرٌ
পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।
لِّکَیۡلَا تَاۡسَوۡا عَلٰی مَا فَاتَکُمۡ وَ لَا تَفۡرَحُوۡا بِمَاۤ اٰتٰىکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یُحِبُّ کُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرِۣ
এটা এজন্যে বলে দেয়া হল যাতে তোমরা যা হারাও তার জন্যে দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তার জন্যে উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা হাদীদ-৫৭: ২২-২৩)
সুতরাং,বিপদের শুরুতেই-
১. ইমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে এই বিশ্বাসের পূর্ণতায় “যে বিপদ এসেছে তা আসারই ছিল, যা হারিয়েছে তা হারানোরই ছিল”|
২. আল্লাহর উপর সন্তুষ্টি জানাতে হবে, অন্তর থেকেই বলতে হবে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”| আল্লাহর রহমতের সূচনা হবে এখান থেকেই, আল্লাহ বলেন:
الَّذِیۡنَ اِذَاۤ اَصَابَتۡہُمۡ مُّصِیۡبَۃٌ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّا لِلّٰہِ وَ اِنَّاۤ اِلَیۡہِ رٰجِعُوۡنَ
যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।(সূরা বাকারাহ-০২: ১৫৬)
اُولٰٓئِکَ عَلَیۡہِمۡ صَلَوٰتٌ مِّنۡ رَّبِّہِمۡ وَ رَحۡمَۃٌ ۟ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُہۡتَدُوۡنَ
তারাই সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। (সূরা বাকারাহ-০২: ১৫৭)
৩. আল্লাহর নিকট সবরের দু‘আ শুরু করতে হবে।
৪. এই বিপদের প্রতিটি মুহূর্তের বিনিময়ে আমার জন্য যেন প্রতিদান লিখা হয়, মুহূর্তগুলো যেন আমার গুনাহের কাফফারা হয়; তার জন্য নিয়াতকে খাটি করতে হবে এ মর্মে যে, আমার সবর ও কষ্ট কেবল আল্লাহরই সন্তুষ্টির জন্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَعنْ أَبي سَعيدٍ وأَبي هُرَيْرة رضيَ اللَّه عَنْهُمَا عن النَّبيِّ صلّى الله عليه وسلّم قَالَ: مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حَزَن وَلاَ أَذًى وَلاَ غمٍّ، حتَّى الشَّوْكَةُ يُشَاكُها إِلاَّ كفَّر اللَّه بهَا مِنْ خطَايَاه متفقٌ عَلَيهِ.
আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুসলিমকে যে কোনো ক্লান্তি, অসুখ, চিন্তা, শোক এমন কি (তার পায়ে) কাঁটাও লাগে, আল্লাহ তা'আলা এর মাধামে তার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।' " সহীহুল বুখারী ৫৬৪২, মুসলিম ২৫৭৩, তিরমিযী ৯৬৬, আহমাদ ৭৯৬৯, ৮২১৯, ৮৯৬৬, ১০৬২৪
عَنْ أبي يَحْيَى صُهَيْبِ بْنِ سِنَانٍ عن رسول الله -صلّى الله عليه وسلّم- أنّه قال: (عَجَبًا لأَمْرِ المُؤْمِنِ، إنَّ أمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وليسَ ذاكَ لأَحَدٍ إلَّا لِلْمُؤْمِنِ، إنْ أصابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ، فَكانَ خَيْرًا له، وإنْ أصابَتْهُ ضَرَّاءُ، صَبَرَ فَكانَ خَيْرًا له)
আবু ইয়াহিয়া সুহাইব ইবনু সিনান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মুমিনের ব্যাপারটাই আশ্চর্যজনক! তাঁর প্রতিটি কাজে তাঁর জন্য মঙ্গল রয়েছে। এটা মুমিন ব্যতীত অন্য কারো জন্য নয়। সুতরাং তাঁর সুখ এলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ফলে এটা তার জন্য মঙ্গলময় হয়। আর দুঃখ পৌঁছলে সে ধৈর্য্য ধারণ করে। ফলে এটাও তাঁর জন্য মঙ্গলময় হয়। ”মুসলিম ২৯৯৯, আহমাদ ১৮৪৫৫, ১৮৪৬০, ২৩৪০৬,২৩৪১৯, দারেমী ২৭৭৭
৫. স্বামীর অবর্তমানে নিজের সতীত্ব-সৌন্দর্য, ইজ্জত-সম্মান, মাল-সম্পদ, গোপনীয়তা; এসবের হিফাজত করুন যেভাবে আল্লাহর নির্দেশনাও স্বামীর পছন্দ। আল্লাহ বলেন:
اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوۡنَ عَلَی النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰہُ بَعۡضَہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ وَّ بِمَاۤ اَنۡفَقُوۡا مِنۡ اَمۡوَالِہِمۡ ؕ فَالصّٰلِحٰتُ قٰنِتٰتٌ حٰفِظٰتٌ لِّلۡغَیۡبِ بِمَا حَفِظَ اللّٰہُ
পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে। (সূরা নিসা: ৩৪)
৬. নিজেকে অধিক পরিমাণ দু‘আ, যিকর, ইস্তেগফার, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন চর্চা, তাফসীর অধ্যয়ন নফল সালাত, নফল সিয়াম, নফল সাদাকা ও অন্যান্য সৎকর্মে নিয়োজিত করুন, এসবকে দু‘আ কবুলের ওসীলায় পরিণত করুন।
৭. কষ্ট হলেও স্বামীর সাথে নিয়মিত বিরতিতে সাক্ষাত করুন। যে কোন সমস্যা তাঁর সাথে শেয়ার করুন। পারিপার্শ্বিক কোন সমস্যাই তার নিকট গোপন করবেন না। এই পরামর্শে আছে বরকত ও রহমত।
৮. স্বামীর কোন বন্ধু বা গাইরে মাহরাম কারও সাথে লেনদেনজনিত দেখা-সাক্ষাত, মোবাইল কল, কথা-বার্তা এসব অবশ্যই স্বামীর সাথে শেয়ার করবেন।
৯. মোবাইল-কম্পিউটার ব্যবহারের বিষয়ে সাবধান হবেন। কুরআন তিলাওয়াত-ইসলামিক অডিও শোনা, ইসলামিক বিষয়াবলী প্রয়োজনানুসারে ভিজিট ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুন। ফেইসবুক থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ।
১০. মামলা, জামিন এসবের তদবির সম্পর্কে নিজের বুঝ বা কারও পরামর্শে সামান্য পদক্ষেপও নেয়ার পূর্বে স্বামীর সাথে শেয়ার করুন। অন্যথায় অতিরিক্ত বিপদের সম্ভাবনা থেকে যায়।
১১. সন্তানের মৌলিক শিক্ষার জন্য নিজেই শিক্ষক হোন। স্বামীর অবর্তমানে সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করুন। আল্লাহর নিকট থাকবে অতিরিক্ত মর্যাদা ও প্রতিদান।
১২. বাড়ীতে ও পর্দার মধ্যে থেকে অর্থ উপার্জনের বিষয়ে আপনার উদ্যোগ ও ইচ্ছা স্বামীর সাথে শেয়ার করুন।
১৩. যদি কখনো ব্যক্তিগত পারিপার্শ্বিক চাপের মুখে সবর করা অসম্ভব হয়ে যায়, সেটাও স্বামীর জানার অধিকার আছে,তার সাথে শেয়ার করুন, আল্লাহর দ্বীনে অবশ্যই আপনার জন্য সুস্পষ্ট করণীয় বলে দেয়া আছে।
সাবধান! সেই হতভাগা নারীর মত হবেন না, যে স্বামীকে আশ্বাস দিয়েছে আজীবন সবর করবে। অত:পর আল্লাহর বিধানে খুলা বা তালাক নেয়ার সুযোগ থাকলেও তা না নিয়েই অন্যত্র বিবাহে রাজি হয়ে গেছেন। কতইনা প্রতারণা, আর দুনিয়া আখিরাতের কত বড় এক ক্ষতি। আল্লাহর নিকটেই চাই হিফাজত।
১৪. প্রত্যেক সাক্ষাতেই আপনার স্বামীকে দ্বীন-দুনিয়া সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়ে তাওবা-ইস্তিগফার ও সংশোধনের নাসীহা দিন।
১৫. মাঝে মধ্যে চিঠি বিনিময় করুন। এটা অতীত সুখস্মৃতি ও ভালোবাসা স্বামীকরণের উপায় হয়ে থাকে ।
Collected
Comment