নেতৃত্বের মোহ
মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
সারা জাহানের মালিকের জন্য সকল প্রশংসা। দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক নবী আল-আমীনের উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবীদের সকলের উপর। অতঃপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে মানুষের আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতাকে বিনষ্ট করে দেয়। এর ফলে দুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক গাঢ় হ’তে থাকে এবং আখিরাত হয়ে পড়ে উপেক্ষিত। এটা এক দুরারোগ্য মরণব্যাধি। এর জন্য ধন-সম্পদ ব্যয়িত হয় এবং রক্তারক্তি খুনোখুনি ঘটে। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভাইয়ে ভাইয়ে এমনকি পিতা-পুত্রের মাঝেও শত্রুতা সৃষ্টি হয়। এজন্যই এ ব্যাধিকে ‘সুপ্তবাসনা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ভয়াবহ ও মারাত্মক বিষয়টি একটু বিস্তারিতভাবে আমরা আলোচনা করব। প্রথমেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি লালসাকে অবচেতন মনের ‘সুপ্তবাসনা’ নামকরণের মূলভিত্তি কী তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তারপর একে একে শাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, এ বিষয়ে একজন মুসলিমের ভূমিকা, শাসন ব্যবস্থার প্রতি লালসার প্রকারভেদ, শাসন ক্ষমতা যাহির করার ক্ষেত্র, শাসন ক্ষমতা প্রীতির কারণ এবং এর চিকিৎসা বা প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করব। অবশ্য এ লেখা প্রস্ত্তত ও সুন্দরভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যারা যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আমি মোটেও কুণ্ঠাবোধ করছি না। সবার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট উপকারী ইলম এবং নেক আমলের তাওফীক কামনা করছি।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিকে সুপ্ত বাসনা নামকরণঃ
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিকে অবচেতন মনের সুপ্ত বাসনা নামকরণের মূলে রয়েছে শাদ্দাদ ইবনে আওস (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি মাওকূফ হাদীছ। তাঁর থেকে বর্ণিত আছে যে, একদিন বস্ত্রাচ্ছাদিত অবস্থায় তিনি অনবরত কাঁদছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তাঁকে বলল, হে আবু ইয়া‘লা, আপনি কাঁদছেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসের ভয় করছি তা হ’ল অবচেতন মনের মাঝে লালিত সুপ্তবাসনা এবং স্পষ্টভাবে লোক দেখানো কাজ। নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না, নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না, নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না। তারা এমন যে, ভাল কাজের আদেশ দিলেও তা পালিত হয়, আবার মন্দ কাজের আদেশ দিলেও তা পালিত হয়। আর মুনাফিকের অবস্থা কী? মুনাফিক তো আসলে সেই উটের মত, যাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে ফলে রশিতে ফাঁস লেগে সে মারা গেছে। মুনাফিক কখনই মুনাফিকীর ক্ষতি হ’তে নিজকে রক্ষা করতে পারবে না।[1]
ইমাম আবুদাঊদ সিজিসতানী (রহঃ) মনের সুপ্তবাসনা (الشهوة الخفية )-কে حب الرئاسة বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আবুদাঊদ (রহঃ)-এর পুত্র আবুবকর বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, شهوة خفية বা মনের সুপ্তবাসনা হ’ল حب الرياسة বা নেতৃত্বের মোহ।[2] আল্লাহই ভাল জানেন, দৃশ্যত এটা একটা উদাহরণমূলক ব্যাখ্যা। এজন্যই আবু উবায়েদ (রহঃ) বলেছেন, الشهوة الخفية বা মনের সুপ্তবাসনার অর্থ সম্পর্কে মনীষীগণ মতানৈক্য করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, الشهوة الخفية দ্বারা মেয়ে লোক ও অন্য কোন কিছুর কামনার কথা বলা হয়েছে। আমার (আবু উবায়েদ) মতে, এটি কোন একটি জিনিসের সাথে খাছ বা নির্দিষ্ট নয়; বরং সকল প্রকার পাপ কাজই সুপ্তবাসনা, যা পাপী ব্যক্তি করার জন্য মনের কোণে লুকিয়ে রাখে এবং তা করতে অনবরত সুযোগ খোঁজে, যদিও সে তা এখনো বাস্তবে রূপায়িত করেনি।[3] তবে শিক্ষিত সমাজে আবুদাঊদ (রহঃ) প্রদত্ত ব্যাখ্যাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ফলে الشهوة الخفية বা সুপ্তবাসনার ভিন্ন কোন অর্থ করার নিদর্শন বর্তমান না থাকলে তা দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিই বুঝাবে। বলা যায় এটি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি সুপ্তবাসনার একটি প্রতীকী নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, মানুষের মনে অনেক বাসনাই সুপ্ত থাকে, যা সে বুঝতে পারে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ অনেক মানুষের মনের মাঝে লুক্কায়িত তেমনি একটি সুপ্তবাসনা। লোকটা হয়ত খাঁটি মনে আল্লাহর ইবাদত করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমস্যাবলীই বা কী, আর দোষ-ত্রুটিই বা কোথায় তাও সে হয়ত জানত না। কিন্তু যেকোনভাবে তার সামনে ক্ষমতা লাভের কোন একটি সুযোগ এসে গেল অমনিই সে তা লুফে নিতে তৎপর হয়ে উঠল। অথচ তার মাঝে যে ক্ষমতার বাসনা ছিল তা সে এর আগ মুহূর্তেও বুঝে উঠতে পারেনি। পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় সেই সুপ্ত বাসনা এখন জেগে উঠেছে। ক্ষমতার সিঁড়িতে এভাবে বহু মানুষই পা রেখেছে। এজন্যই ক্ষমতার এই মোহকে ‘সুপ্তবাসনা’ বলা হয়।[4]
রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা (حاجة الناس إلى الولاية ) : ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, জনগণের শাসনভার গ্রহণ ও পরিচালনা দ্বীনের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। বরং দ্বীন ও দুনিয়ার অস্তিত্ব এই শাসন ব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র ছাড়া কোন মতে চলতে পারে না। কেননা মানুষ একটি সংঘবদ্ধ জীব। তাদের নানামুখী প্রয়োজন পূরণে সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন রয়েছে। আর সংঘবদ্ধ হ’লেই সেখানে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন নেতা থাকা আবশ্যক। এজন্যই নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا خَرَجَ ثَلاَثَةٌ فِىْ سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوْا أَحَدَهُمْ ‘যখন তিন জন মানুষ ভ্রমণে বের হবে তখন যেন তারা তাদের কোন একজনকে আমীর বা দলনেতা বানিয়ে নেয়’।[5] সফরের মত একটি ছোট্ট জোটবদ্ধতায় যেখানে নবী করীম (ছাঃ) নেতা নিয়োগকে আবশ্যিক বা ফরয ধার্য করেছেন, তখন সব রকমের সংঘবদ্ধতায় যে আমীর বা নেতা নিয়োগ করা ফরয তা বলাই বাহুল্য। আল্লাহ তা‘আলা সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ ফরয করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ছাড়া তা কার্যকরী হ’তে পারে না। অনুরূপভাবে জিহাদ, সুবিচার, হজ্জ পালন, জুম‘আ, দুই ঈদের ছালাত কায়েম, অত্যাচারিতের সাহায্য এবং আল্লাহ প্রদত্ত দন্ডবিধি কার্যকর ক্ষমতা ও সার্বভৌম কর্তৃত্ব ব্যতীত পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করা যায় না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, ‘কোন শাসক ব্যতীত একটি রাত কাটানো অপেক্ষা একজন যালেম সরকারের অধীনে ষাট বছর পার করাও অনেক ভাল’। অভিজ্ঞতাও সে কথা বলে।[6]
ফলে জনগণের সার্বিক কার্যাবলীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এমন একজন নির্বাহীর প্রয়োজন, যিনি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবেন, সকল বিভাগের নেতৃত্ব দিবেন এবং সকল কাজের দায়-দায়িত্ব বহন করবেন।
শাসনক্ষমতা লাভের ক্ষেত্রে একজন মুসলমানের ভূমিকা (موقف المسلم من الولاية ) : হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنَّكَ إِنْ أُوْتِيْتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُوْتِِيْتَهَا مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا،
আব্দুর রহমান ইবনু সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে আব্দুর রহমান, তুমি কখনো নেতৃত্ব চেয়ে নিও না। কেননা তুমি যদি চেয়ে নিয়ে তা লাভ কর, তাহ’লে তোমাকে ঐ দায়িত্বের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে (অর্থাৎ তুমি দায়িত্ব পালনে হিমশিম খাবে, কিন্তু কোন সহযোগিতা পাবে না)। আর না চাইতেই যদি তা পাও তাহ’লে তুমি সেজন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’।[7]
আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসলাম। আমার সাথে ছিল আশ‘আরী গোত্রের দু’জন লোক। তাদের একজন ছিল আমার ডানে এবং অন্যজন ছিল আমার বামে। তারা দু’জনেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কার্যভার চেয়ে বসল। নবী করীম (ছাঃ) সে সময় মেসওয়াক করছিলেন। আমি তাঁর ঠোঁটের নিচে মেসওয়াক কীভাবে রয়েছে আর ঠোঁট সঙ্কুচিত হয়ে আসছে সে দৃশ্য এখনো যেন দেখতে পাচ্ছি। তিনি বললেন, হে আবু মূসা বা হে আব্দুল্লাহ বিন কায়েস! ব্যাপার কি? ওদের কথা শুনে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তার শপথ, তারা দু’জন যেমন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি তেমনি এখানে এসে তারা যে কার্যভার চেয়ে বসবে তাও আমি বুঝতে পারিনি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যেসব পদ আমাদের রয়েছে তা যে চেয়ে নেয় আমরা কখনই তাকে সে পদে নিযুক্ত করব না। তবে হে আবু মূসা, আব্দুল্লাহ ইবনু কায়েস! তুমি (অমুক পদে দায়িত্ব পালনের জন্য) যাও। তারপর তিনি তাঁকে ইয়ামান প্রদেশের শাসক করে পাঠালেন।[8]
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى الإِمَارَةِ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَتِ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য খুব আগ্রহী হবে। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তা লজ্জা (ও আফসোসের) কারণ হবে। দুধদানকারী হিসাবে (ক্ষমতার দিনগুলোতে নানান সুযোগ সুবিধা ভোগের দিক দিয়ে) ক্ষমতা কতই না ভাল। কিন্তু ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি কতই না নিকৃষ্ট পরিণামবহ’।[9]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ক্ষমতা দুধদানকারী পশুতুল্য। কারণ ক্ষমতা থাকলে পদ, পদবী, সম্পদ, হুকুমজারী, নানা রকম ভোগ-বিলাসিতা ও মানসিক তৃপ্তি অর্জিত হয়। কিন্তু মৃত্যু কিংবা অন্য কোন কারণে ক্ষমতা যখন চলে যায়, তখন আর তা মোটেও সুখকর থাকে না। বিশেষত আখেরাতে যখন এজন্য নানা ভীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হ’তে হবে তখন ক্ষমতা মহাজ্বালা হয়ে দেখা দিবে।[10]
আল্লামা আব্দুর রহমান সা‘দী বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা জনগণের উপর কর্তৃত্বমূলক যে কোন পদ মানুষের চেয়ে নেওয়া উচিত নয় এবং সে জন্য নিজেকে যোগ্য বলে উপস্থাপন করাও কাম্য নয়; বরং এজন্য আল্লাহর নিকট দায়িত্ব মুক্ত ও নির্ঝঞ্ঝাট জীবন প্রার্থনা করা উচিত। কেননা সে তো জানে না যে, শাসন ক্ষমতা তার জন্য কল্যাণকর হবে, না অকল্যাণকর। সে এও জানে না যে, এই দায়িত্ব সে পালন করতে পারবে কি-না? তারপরও যখন সে দায়িত্বের জন্য আবেদন-নিবেদন করে, তখন তো তা পেলে তার নিজের দিকেই তা সোপর্দ করে দেয়া হয়। আর যখন বান্দার দিকে দায়িত্ব সোপর্দ করে দেয়া হয়, তখন সেজন্য সে আল্লাহর সহায়তা পায় না। তার সব কাজ সুচারু রূপে করতে পারে না এবং সাহায্য-সহযোগিতাও পায় না। কেননা তার ক্ষমতা চেয়ে নেয়া দু’টি অবৈধ বিষয়ের বার্তা প্রদান করে।
প্রথমতঃ পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতি লোভ। এ ধরনের লোভ আল্লাহর সম্পদে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে এবং আল্লাহর বান্দাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির পদক্ষেপে উদ্বুদ্ধ করে।
দ্বিতীয়তঃ এতে নিজেকে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবার এবং আল্লাহর সাহায্যের দরকার না লাগার গন্ধ রয়েছে।
কিন্তু যার ক্ষমতার প্রতি লোভ ও ঝোঁক নেই এমন ব্যক্তি বিনা আবেদনে ক্ষমতা পেলে এবং দায়িত্ব পালনে নিজেকে অক্ষম মনে করলেও তার যে কোন সমস্যায় আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করবেন, তাকে তার নিজের ক্ষমতার উপর ছেড়ে দিবেন না। কেননা সে তো এই বিপদ নিজ থেকে ডেকে আনেনি। যে স্বেচ্ছায় বিপদ ডেকে আনেনি তার ভার বহনের ব্যবস্থা করা হয় এবং তার দায়িত্ব পালনের যোগ্যতাও তৈরী করে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় আল্লাহর উপর তার ভরসা জোরদার হয়। আর বান্দা যখন আল্লাহর উপর ভরসা করে কোন কাজে আগুয়ান হয় তখন সফলতা তার হাতে এসে ধরা দেয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী ‘তুমি সেজন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’ (اعنت عليها ) এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, ইমারত প্রভৃতি পার্থিব নেতৃত্ব দ্বীন ও দুনিয়া উভয়কে নিজের মধ্যে শামিল করে। কেননা সবরকম কর্তৃত্বের মূল উদ্দেশ্য মানুষের দ্বীন-ধর্ম এবং জাগতিক সংশোধন ও কল্যাণ সাধন করা। এজন্যই প্রশাসনিক নেতৃত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আদেশ, নিষেধ, ফরয বা আবশ্যিক কার্যাবলী সম্পাদনে চাপ প্রয়োগ, হারাম বা নিষিদ্ধ কার্যাবলী না করতে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ, নানা প্রকার অধিকার আদায়ে বাধ্যকরণ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে যে বা যারা আল্লাহকে রাযী-খুশি করার নিয়তে যথাযথ দায়িত্ব পালনের মানসে রাজনীতি[11] ও যুদ্ধ-জিহাদ করবে তার বা তাদের জন্য এসব কাজ উত্তম ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু যারা এরূপ নিয়ত ও সদিচ্ছা ছাড়া রাজনীতি ও যুদ্ধ ইত্যাদি করবে, তাদের জন্য তা মারাত্মক বিপদ হিসাবে গণ্য হবে। আর যেহেতু বহু ফরয ও আবশ্যিক বিষয় বাস্তবায়ন শাসনক্ষমতার উপর নির্ভরশীল সেহেতু এই ক্ষমতা অর্জন ও পরিচালনা ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভুক্ত।[12]
এজন্যই বিশেষ প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় পদ চেয়ে নেওয়া জায়েয আছে। যেমন মিসর রাজার নিকট ইউসুফ (আঃ) এমনই একটি পদ প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন, قَالَ اجْعَلْنِيْ عَلَى خَزَآئِنِ الأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيْمٌ ‘ইউসুফ বলল, (হে রাজা) আপনি আমাকে দেশের খাদ্য ভান্ডার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিন। আমি অবশ্যই একজন বিশ্বস্ত রক্ষক ও (এ কাজ পরিচালনায়) বিজ্ঞ বটে’ (ইউসুফ ১২/৫৫)।
আল্লামা সা‘দী বলেন, তিনি বিশেষ কিছু দিক লক্ষ্য করে পদ চেয়েছিলেন যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ পারবে না বলে তার মনে হয়েছিল। যেমন শস্য ভান্ডার পরিপূর্ণরূপে সংরক্ষণ এবং শস্য ভান্ডারের সাথে সম্পর্কিত সকল দিকের জ্ঞান, যথা : উন্নত উৎপাদন, সুষ্ঠু বিলিবণ্টন ও এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ইনছাফ প্রতিষ্ঠা। এ কারণেই রাজা তাঁকে একান্ত নিজের লোক করে নেন এবং তাঁকে তার অগ্রবর্তী লোকদের তালিকায় ঠাঁই দেন। আবার একইভাবে ইউসুফ (আঃ)-এর উপরও রাজা ও তার প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়। তাইতো দেখা যায়, তিনি যখন খাদ্য দপ্তরের দায়িত্ব নেন তখন অধিক খাদ্য ফলানোর জন্য চাষাবাদের উপর জোর দেন।[13]
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি এবং আল্লাহর পথে দাওয়াতের জন্য নেতৃত্বপ্রীতিحب) الرئاسة وحب الإمارة للدعوة إلى الله )-র মধ্যে পার্থক্য হ’ল নিজ জীবনের প্রতি গুরুত্বারোপ ও নিজের অধিকার ও প্রাপ্য আদায়ে সচেষ্ট হওয়া এবং আল্লাহর হুকুমের প্রতি গুরুত্বারোপ ও তার উপদেশ প্রদানের মাঝে পার্থক্যের মতই। কেননা যে আল্লাহর কল্যাণকামী সে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে, তাকে ভালবাসে, তার হুকুম সর্বক্ষেত্রে মেনে চলা হোক, কোন নাফরমানী করা না হোক সেটা সে প্রিয় মনে করে। সে চায় যে, আল্লাহর কথা (আইন) সর্বোচ্চ স্থানে থাকুক এবং দ্বীন সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যাক, সকল মানুষ আল্লাহর আদেশ মেনে চলুক, নিষেধ থেকে দূরে থাকুক। এভাবে সে দাসত্ব ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর কল্যাণ কামনা করে এবং আল্লাহর দিকে তার বান্দাদের দাওয়াত দানের মাধ্যমে মানুষ ও সৃষ্টির কল্যাণ কামনা করে। ফলে সে দ্বীন ইসলামের খাতিরে ইমামত বা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব পসন্দ করে। বরং সে তাকে মুমিন মুত্তাক্বীদের নেতা বানানোর জন্য তার রবের নিকট দো‘আ করে যাতে মুত্তাকীরা তার অনুসরণ করে, যেমন করে সে মুত্তাক্বীদের অনুসরণ করেছে। যেমন এরশাদ হচ্ছে, رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَاماً ‘হে আমাদের মালিক! তুমি আমাদের এমন জীবন সঙ্গিনী ও সন্তানাদি দাও যারা হবে নয়নপ্রীতিকর এবং তুমি আমাদেরকে মুত্তাক্বীদের নেতা বানাও’ (ফুরক্বান ২৫/৭৪)।
পক্ষান্তরে যারা নিছক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লিপ্সু তারা এই ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে পৃথিবীতে উঁচু আসন লাভ করতে চায়। দেশের মানুষ যাতে তাদের দাসে পরিণত হয় এবং তাদের পেছনে থাকে সেজন্য তাদের চেষ্টার অন্ত থাকে না। জনগণ সর্বক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করবে কিন্তু তারা তাদের উপর খবরদারী করবে এবং বল প্রয়োগ করবে সেই লক্ষ্যেও তারা ক্ষমতা পেতে চায়। তাদের এসব উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে যে কত রকম অনিষ্ট সৃষ্টি হয়, তা স্রেফ আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। যেমন বিদ্রোহ, হিংসা, স্বেচ্ছাচারিতা, অন্তর্দাহ, যুলুম-অত্যাচার, ফিতনা-ফাসাদ, আল্লাহর হক আদায়ের ক্ষেত্রে আত্মম্ভরিতা ও উন্নলাসিকতা প্রদর্শন, আললাহর পক্ষ থেকে সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা এবং অসম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সম্মানিত করা ইত্যাদি না হ’লে পার্থিব নেতৃত্ব যেন কখনই পূর্ণতা পায় না। আর এ ধরনের ক্ষমতার নাগাল পেতেও তাকে কয়েকগুণ বেশী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হ’তে হয়।[14]
শাসন ক্ষমতার প্রতি লালসার প্রকারভেদ (صور وأحوال حب الرئاسة) :
নেতৃত্বের বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শাসনক্ষমতা দুই প্রকার। যথা:
এক. পার্থিব ক্ষমতা,
দুই. দ্বীনী বিদ্যা বিজড়িত ক্ষমতা।
ইবনু রজব বলেছেন, সম্মান লাভের প্রতি লালসা দু’প্রকার। প্রথম প্রকার- রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও ধন-সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে সম্মান লাভের প্রয়াস। এটি খুবই মারাত্মক। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা মানুষকে আখেরাতের কল্যাণ ও মান-সম্মান থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لاَ يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَاداً وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ ‘এটা পরকালের গৃহ যা আমরা নির্ধারিত করে রেখেছি তাদের জন্য, যারা দুনিয়ায় কোন রকম প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় না এবং কোন অশান্তিকর কিছু করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাক্বীদের জন্যই রয়েছে’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।[15]
দ্বিতীয় প্রকার- ধর্মীয় বিষয়াদির মাধ্যমে সম্মান অর্জনের প্রয়াস। যেমন দ্বীনী বিদ্যা, আমল-আখলাক, তাক্বওয়া-পরহেযগারিতা, সংসারে অনাসক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের নযর নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করা। এটি প্রথম প্রকারের থেকেও জঘন্য ও কদর্য। এর বিপর্যয় ও ভয়াবহতা আরো মারাত্মক। কেননা দ্বীন-ইলম, আমল-আখলাক ও পরহেযগারিতা দ্বারা মহান আল্লাহর নিকট উঁচু মর্যাদা ও চিরস্থায়ী নে‘মত জান্নাত লাভ এবং তার খুব নিকটজনের মাঝে পরিগণিত হওয়াই একমাত্র কাম্য হওয়া উচিৎ। সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন, ইলমের মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করা হয় বলেই তার এত মর্যাদা, নতুবা তা অন্য আর পাঁচটা জিনিসের মতই। অতএব এই ইলমের অংশবিশেষ দ্বারাও যদি এই নশ্বর জগতের কোন বস্ত্ত তলব করা হয়, তাহ’লে তাও দু’শ্রেণীতে পড়বে।
প্রথম শ্রেণী : ধনদৌলত কামাইয়ের জন্য দ্বীনী বিদ্যার ব্যবহার। এতে সম্পদের প্রতি এক ধরনের লোভ ফুটে উঠবে এবং হারাম উপায়ে তা উপার্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে প্রমাণিত হবে।
দ্বিতীয় শ্রেণী : দ্বীনী বিদ্যা, আমল ও পরহেযগারিতা দ্বারা মানব জাতির উপর নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব যাহির করার ইচ্ছা। মানুষ যাতে তাদের অনুগত থাকে, তাদের সামনে মাথা নত করে এবং তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এই শ্রেণীর বিদ্বানরা সেটাই আশা করে। অধিকন্তু তারা মানুষের মাঝে অন্য আলেমদের তুলনায় তাদের জ্ঞান গরিমার আধিক্য যাহির করতে চায়, যাতে তাদের উপর এদের প্রাধান্য বজায় থাকে। এরূপ ইচ্ছা পোষণকারী বিদ্বানদের প্রতিশ্রুত স্থান জাহান্নাম। কেননা সৃষ্টিকুলের উপর বড়াই করার ইচ্ছা আপনা থেকেই হারাম, আর যখন তাতে (বড়াইয়ের ক্ষেত্রে) বিদ্যার মত একটি পারলৌকিক উপকরণ ব্যবহার করা হবে তখন তো তা অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার মত বড়াইয়ের পার্থিব উপকরণ ব্যবহার থেকেও ভীষণ কদর্য ও জঘন্য রূপ নিবে।
কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ ‘বোকাদের সঙ্গে বিতর্ক করা কিংবা আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কিংবা জনগণের দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরানোর মানসে যে বিদ্যা অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন’।[16]
শাসন ক্ষমতা প্রীতির দু’টি অবস্থা রয়েছে :
প্রথম : ক্ষমতা লাভের পূর্বেকার অবস্থা। কিছু মানুষ এমন আছে যারা শাসন ক্ষমতা লোভী। এই লোভের লক্ষণ ও চিহ্নগুলো তাদের মাঝে ভালভাবে ফুটে ওঠে। অর্থাৎ ক্ষমতার জন্য তারা নানা রকম চেষ্টা-তদবির করে; তাতেই মানুষ বোঝে যে এরা ক্ষমতাপ্রত্যাশী। তারপর তাদের কারো কপালে ক্ষমতা জোটে, আবার কারো জোটে না। এ কথার সমর্থন মেলে আল্লাহর নিম্নের বাণীতে, مَّنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيْهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُّرِيْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاَهَا مَذْمُوماً مَّدْحُوراً ‘যারা দুনিয়া পেতে চায় তাদের মধ্যে আমি যাকে ইচ্ছা করি দুনিয়ার সম্পদ থেকে আমার ইচ্ছামাফিক তা দ্রুত দিয়ে দেই। তারপর তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করে রাখি। যেখানে সে প্রবেশ করবে একান্ত নিন্দিত ও ধিকৃত অবস্থায়’ (ইসরাঈল ১৭/১৮)।
দ্বিতীয় : ক্ষমতা লাভের পরের অবস্থা। অনেক মানুষ ক্ষমতা লাভের ব্যাপারে কখনো কখনো অনাগ্রহ প্রকাশ করে, তারপর যখন তা লাভ করে তখন তার হৃদয়-মন তার সাথে গেঁথে যায়। আবার কখনো ক্ষমতার সাথে তার একটু-আধটু যোগ থাকে, তারপর তা হাতে আসার পর সে যোগ খুব বাড়তে থাকে। কেননা এ সময় সে ক্ষমতার স্বাদ এবং তা হারানোর ভয়ে তাকে আরো অাঁকড়ে ধরতে চায়। ইবনু রজব বলেছেন, ‘জেনে রাখ, মান-মর্যাদার লোভ মহাক্ষতি ডেকে আনে। মর্যাদা লাভের আগে তা অর্জনের পথ-পদ্ধতি বা কলাকৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ অনেক হীন ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। আবার মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে অন্যের উপর নিপীড়ন, ক্ষমতা প্রদর্শন, দাম্ভিকতা দেখানো ইত্যাদি ক্ষতিকর জিনিসের উদগ্র নেশায় পেয়ে বসে।[17]
________________________________________
[1]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ, পৃঃ ১৬।
[2]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৬/৩৪৬।
[3]. আবু উবায়েদ, গারীবুল হাদীছ ৪/১৭১।
[4]. মাজমূউ ফাতাওয়া ১৬/৩৪৬।
[5]. আবুদাঊদ হা/২৬০৮, আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন।
[6]. আস-সিয়াসাতুশ শারঈয়্যাহ, পৃঃ ১২৯।
[7]. বুখারী হা/৭১৪৭; মুসলিম হা/১৬৫২।
[8]. মুসলিম হা/১৮২৪।
[9]. বুখারী হা/৭১৪৮।
[10]. ফাতহুল বারী ১৩/১২৬।
[11]. ‘সিয়াসাত’ (السياسة) অর্থ প্রচলিত ক্ষমতা দখলের রাজনীতি নয়, বরং সমাজ সংশ্লিষ্ট সকল কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। সেখানে যে ব্যক্তি যে কাজের যোগ্য, সে ব্যক্তি সে কাজ করবে স্রেফ আল্লাহকে খুশী করার জন্য। নিজের বা নিজ দলের অন্যায় স্বার্থ হাছিলের জন্য নয়। দেশের নেতার কাছে নিজের যোগ্যতা তুলে ধরা ও তা ব্যবহারের মাধ্যমে জনকল্যাণের সুযোগ প্রার্থনা করা নিঃসন্দেহে জায়েয। যেমনটি ইউসুফ (আঃ) করেছিলেন। যেমনটি এ যুগেও যেকোন কর্মের ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা তুলে ধরা হয়। কিন্তু এই অজুহাতে প্রচলিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নেতৃত্বের জন্য প্রার্থী হওয়া যাবে না। কেননা এখানে নেতার কাছে দায়িত্ব চাওয়া হয় না। বরং লোকদের কাছে নিজের জন্য নেতৃত্ব চাওয়া হয়। তাছাড়া এখানে মানুষের মনগড়া আইন রচনার ও মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ভোট চাওয়া হয়। আল্লাহর আইন ও তাঁর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। (স.স.)।
[12]. বাহজাতু কুলূবিল আবরার, পৃঃ ১০৫-১০৬।
[13]. ঐ, পৃঃ ১০৬।
[14]. আর-রূহু, পৃঃ ২৫২-২৫৩।
[15]. দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাদীছ (২৯)-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[16]. তিরমিযী হা/২৬৫৪, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব ১/২৫ পৃঃ; ঈষৎ পরিবর্তনসহ দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাদীছের ব্যাখ্যা ৪৭-৫৩ পৃঃ।
[17]. ঐ, পৃঃ ৩২।
=======================
মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
সারা জাহানের মালিকের জন্য সকল প্রশংসা। দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক নবী আল-আমীনের উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবীদের সকলের উপর। অতঃপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে মানুষের আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতাকে বিনষ্ট করে দেয়। এর ফলে দুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক গাঢ় হ’তে থাকে এবং আখিরাত হয়ে পড়ে উপেক্ষিত। এটা এক দুরারোগ্য মরণব্যাধি। এর জন্য ধন-সম্পদ ব্যয়িত হয় এবং রক্তারক্তি খুনোখুনি ঘটে। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভাইয়ে ভাইয়ে এমনকি পিতা-পুত্রের মাঝেও শত্রুতা সৃষ্টি হয়। এজন্যই এ ব্যাধিকে ‘সুপ্তবাসনা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ভয়াবহ ও মারাত্মক বিষয়টি একটু বিস্তারিতভাবে আমরা আলোচনা করব। প্রথমেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি লালসাকে অবচেতন মনের ‘সুপ্তবাসনা’ নামকরণের মূলভিত্তি কী তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তারপর একে একে শাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, এ বিষয়ে একজন মুসলিমের ভূমিকা, শাসন ব্যবস্থার প্রতি লালসার প্রকারভেদ, শাসন ক্ষমতা যাহির করার ক্ষেত্র, শাসন ক্ষমতা প্রীতির কারণ এবং এর চিকিৎসা বা প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করব। অবশ্য এ লেখা প্রস্ত্তত ও সুন্দরভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যারা যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আমি মোটেও কুণ্ঠাবোধ করছি না। সবার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট উপকারী ইলম এবং নেক আমলের তাওফীক কামনা করছি।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিকে সুপ্ত বাসনা নামকরণঃ
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিকে অবচেতন মনের সুপ্ত বাসনা নামকরণের মূলে রয়েছে শাদ্দাদ ইবনে আওস (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি মাওকূফ হাদীছ। তাঁর থেকে বর্ণিত আছে যে, একদিন বস্ত্রাচ্ছাদিত অবস্থায় তিনি অনবরত কাঁদছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তাঁকে বলল, হে আবু ইয়া‘লা, আপনি কাঁদছেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসের ভয় করছি তা হ’ল অবচেতন মনের মাঝে লালিত সুপ্তবাসনা এবং স্পষ্টভাবে লোক দেখানো কাজ। নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না, নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না, নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না। তারা এমন যে, ভাল কাজের আদেশ দিলেও তা পালিত হয়, আবার মন্দ কাজের আদেশ দিলেও তা পালিত হয়। আর মুনাফিকের অবস্থা কী? মুনাফিক তো আসলে সেই উটের মত, যাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে ফলে রশিতে ফাঁস লেগে সে মারা গেছে। মুনাফিক কখনই মুনাফিকীর ক্ষতি হ’তে নিজকে রক্ষা করতে পারবে না।[1]
ইমাম আবুদাঊদ সিজিসতানী (রহঃ) মনের সুপ্তবাসনা (الشهوة الخفية )-কে حب الرئاسة বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আবুদাঊদ (রহঃ)-এর পুত্র আবুবকর বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, شهوة خفية বা মনের সুপ্তবাসনা হ’ল حب الرياسة বা নেতৃত্বের মোহ।[2] আল্লাহই ভাল জানেন, দৃশ্যত এটা একটা উদাহরণমূলক ব্যাখ্যা। এজন্যই আবু উবায়েদ (রহঃ) বলেছেন, الشهوة الخفية বা মনের সুপ্তবাসনার অর্থ সম্পর্কে মনীষীগণ মতানৈক্য করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, الشهوة الخفية দ্বারা মেয়ে লোক ও অন্য কোন কিছুর কামনার কথা বলা হয়েছে। আমার (আবু উবায়েদ) মতে, এটি কোন একটি জিনিসের সাথে খাছ বা নির্দিষ্ট নয়; বরং সকল প্রকার পাপ কাজই সুপ্তবাসনা, যা পাপী ব্যক্তি করার জন্য মনের কোণে লুকিয়ে রাখে এবং তা করতে অনবরত সুযোগ খোঁজে, যদিও সে তা এখনো বাস্তবে রূপায়িত করেনি।[3] তবে শিক্ষিত সমাজে আবুদাঊদ (রহঃ) প্রদত্ত ব্যাখ্যাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ফলে الشهوة الخفية বা সুপ্তবাসনার ভিন্ন কোন অর্থ করার নিদর্শন বর্তমান না থাকলে তা দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিই বুঝাবে। বলা যায় এটি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি সুপ্তবাসনার একটি প্রতীকী নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, মানুষের মনে অনেক বাসনাই সুপ্ত থাকে, যা সে বুঝতে পারে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ অনেক মানুষের মনের মাঝে লুক্কায়িত তেমনি একটি সুপ্তবাসনা। লোকটা হয়ত খাঁটি মনে আল্লাহর ইবাদত করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমস্যাবলীই বা কী, আর দোষ-ত্রুটিই বা কোথায় তাও সে হয়ত জানত না। কিন্তু যেকোনভাবে তার সামনে ক্ষমতা লাভের কোন একটি সুযোগ এসে গেল অমনিই সে তা লুফে নিতে তৎপর হয়ে উঠল। অথচ তার মাঝে যে ক্ষমতার বাসনা ছিল তা সে এর আগ মুহূর্তেও বুঝে উঠতে পারেনি। পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় সেই সুপ্ত বাসনা এখন জেগে উঠেছে। ক্ষমতার সিঁড়িতে এভাবে বহু মানুষই পা রেখেছে। এজন্যই ক্ষমতার এই মোহকে ‘সুপ্তবাসনা’ বলা হয়।[4]
রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা (حاجة الناس إلى الولاية ) : ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, জনগণের শাসনভার গ্রহণ ও পরিচালনা দ্বীনের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। বরং দ্বীন ও দুনিয়ার অস্তিত্ব এই শাসন ব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র ছাড়া কোন মতে চলতে পারে না। কেননা মানুষ একটি সংঘবদ্ধ জীব। তাদের নানামুখী প্রয়োজন পূরণে সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন রয়েছে। আর সংঘবদ্ধ হ’লেই সেখানে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন নেতা থাকা আবশ্যক। এজন্যই নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا خَرَجَ ثَلاَثَةٌ فِىْ سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوْا أَحَدَهُمْ ‘যখন তিন জন মানুষ ভ্রমণে বের হবে তখন যেন তারা তাদের কোন একজনকে আমীর বা দলনেতা বানিয়ে নেয়’।[5] সফরের মত একটি ছোট্ট জোটবদ্ধতায় যেখানে নবী করীম (ছাঃ) নেতা নিয়োগকে আবশ্যিক বা ফরয ধার্য করেছেন, তখন সব রকমের সংঘবদ্ধতায় যে আমীর বা নেতা নিয়োগ করা ফরয তা বলাই বাহুল্য। আল্লাহ তা‘আলা সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ ফরয করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ছাড়া তা কার্যকরী হ’তে পারে না। অনুরূপভাবে জিহাদ, সুবিচার, হজ্জ পালন, জুম‘আ, দুই ঈদের ছালাত কায়েম, অত্যাচারিতের সাহায্য এবং আল্লাহ প্রদত্ত দন্ডবিধি কার্যকর ক্ষমতা ও সার্বভৌম কর্তৃত্ব ব্যতীত পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করা যায় না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, ‘কোন শাসক ব্যতীত একটি রাত কাটানো অপেক্ষা একজন যালেম সরকারের অধীনে ষাট বছর পার করাও অনেক ভাল’। অভিজ্ঞতাও সে কথা বলে।[6]
ফলে জনগণের সার্বিক কার্যাবলীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এমন একজন নির্বাহীর প্রয়োজন, যিনি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবেন, সকল বিভাগের নেতৃত্ব দিবেন এবং সকল কাজের দায়-দায়িত্ব বহন করবেন।
শাসনক্ষমতা লাভের ক্ষেত্রে একজন মুসলমানের ভূমিকা (موقف المسلم من الولاية ) : হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنَّكَ إِنْ أُوْتِيْتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُوْتِِيْتَهَا مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا،
আব্দুর রহমান ইবনু সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে আব্দুর রহমান, তুমি কখনো নেতৃত্ব চেয়ে নিও না। কেননা তুমি যদি চেয়ে নিয়ে তা লাভ কর, তাহ’লে তোমাকে ঐ দায়িত্বের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে (অর্থাৎ তুমি দায়িত্ব পালনে হিমশিম খাবে, কিন্তু কোন সহযোগিতা পাবে না)। আর না চাইতেই যদি তা পাও তাহ’লে তুমি সেজন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’।[7]
আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসলাম। আমার সাথে ছিল আশ‘আরী গোত্রের দু’জন লোক। তাদের একজন ছিল আমার ডানে এবং অন্যজন ছিল আমার বামে। তারা দু’জনেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কার্যভার চেয়ে বসল। নবী করীম (ছাঃ) সে সময় মেসওয়াক করছিলেন। আমি তাঁর ঠোঁটের নিচে মেসওয়াক কীভাবে রয়েছে আর ঠোঁট সঙ্কুচিত হয়ে আসছে সে দৃশ্য এখনো যেন দেখতে পাচ্ছি। তিনি বললেন, হে আবু মূসা বা হে আব্দুল্লাহ বিন কায়েস! ব্যাপার কি? ওদের কথা শুনে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তার শপথ, তারা দু’জন যেমন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি তেমনি এখানে এসে তারা যে কার্যভার চেয়ে বসবে তাও আমি বুঝতে পারিনি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যেসব পদ আমাদের রয়েছে তা যে চেয়ে নেয় আমরা কখনই তাকে সে পদে নিযুক্ত করব না। তবে হে আবু মূসা, আব্দুল্লাহ ইবনু কায়েস! তুমি (অমুক পদে দায়িত্ব পালনের জন্য) যাও। তারপর তিনি তাঁকে ইয়ামান প্রদেশের শাসক করে পাঠালেন।[8]
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى الإِمَارَةِ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَتِ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য খুব আগ্রহী হবে। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তা লজ্জা (ও আফসোসের) কারণ হবে। দুধদানকারী হিসাবে (ক্ষমতার দিনগুলোতে নানান সুযোগ সুবিধা ভোগের দিক দিয়ে) ক্ষমতা কতই না ভাল। কিন্তু ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি কতই না নিকৃষ্ট পরিণামবহ’।[9]
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ক্ষমতা দুধদানকারী পশুতুল্য। কারণ ক্ষমতা থাকলে পদ, পদবী, সম্পদ, হুকুমজারী, নানা রকম ভোগ-বিলাসিতা ও মানসিক তৃপ্তি অর্জিত হয়। কিন্তু মৃত্যু কিংবা অন্য কোন কারণে ক্ষমতা যখন চলে যায়, তখন আর তা মোটেও সুখকর থাকে না। বিশেষত আখেরাতে যখন এজন্য নানা ভীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হ’তে হবে তখন ক্ষমতা মহাজ্বালা হয়ে দেখা দিবে।[10]
আল্লামা আব্দুর রহমান সা‘দী বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা জনগণের উপর কর্তৃত্বমূলক যে কোন পদ মানুষের চেয়ে নেওয়া উচিত নয় এবং সে জন্য নিজেকে যোগ্য বলে উপস্থাপন করাও কাম্য নয়; বরং এজন্য আল্লাহর নিকট দায়িত্ব মুক্ত ও নির্ঝঞ্ঝাট জীবন প্রার্থনা করা উচিত। কেননা সে তো জানে না যে, শাসন ক্ষমতা তার জন্য কল্যাণকর হবে, না অকল্যাণকর। সে এও জানে না যে, এই দায়িত্ব সে পালন করতে পারবে কি-না? তারপরও যখন সে দায়িত্বের জন্য আবেদন-নিবেদন করে, তখন তো তা পেলে তার নিজের দিকেই তা সোপর্দ করে দেয়া হয়। আর যখন বান্দার দিকে দায়িত্ব সোপর্দ করে দেয়া হয়, তখন সেজন্য সে আল্লাহর সহায়তা পায় না। তার সব কাজ সুচারু রূপে করতে পারে না এবং সাহায্য-সহযোগিতাও পায় না। কেননা তার ক্ষমতা চেয়ে নেয়া দু’টি অবৈধ বিষয়ের বার্তা প্রদান করে।
প্রথমতঃ পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতি লোভ। এ ধরনের লোভ আল্লাহর সম্পদে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে এবং আল্লাহর বান্দাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির পদক্ষেপে উদ্বুদ্ধ করে।
দ্বিতীয়তঃ এতে নিজেকে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবার এবং আল্লাহর সাহায্যের দরকার না লাগার গন্ধ রয়েছে।
কিন্তু যার ক্ষমতার প্রতি লোভ ও ঝোঁক নেই এমন ব্যক্তি বিনা আবেদনে ক্ষমতা পেলে এবং দায়িত্ব পালনে নিজেকে অক্ষম মনে করলেও তার যে কোন সমস্যায় আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করবেন, তাকে তার নিজের ক্ষমতার উপর ছেড়ে দিবেন না। কেননা সে তো এই বিপদ নিজ থেকে ডেকে আনেনি। যে স্বেচ্ছায় বিপদ ডেকে আনেনি তার ভার বহনের ব্যবস্থা করা হয় এবং তার দায়িত্ব পালনের যোগ্যতাও তৈরী করে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় আল্লাহর উপর তার ভরসা জোরদার হয়। আর বান্দা যখন আল্লাহর উপর ভরসা করে কোন কাজে আগুয়ান হয় তখন সফলতা তার হাতে এসে ধরা দেয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী ‘তুমি সেজন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’ (اعنت عليها ) এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, ইমারত প্রভৃতি পার্থিব নেতৃত্ব দ্বীন ও দুনিয়া উভয়কে নিজের মধ্যে শামিল করে। কেননা সবরকম কর্তৃত্বের মূল উদ্দেশ্য মানুষের দ্বীন-ধর্ম এবং জাগতিক সংশোধন ও কল্যাণ সাধন করা। এজন্যই প্রশাসনিক নেতৃত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আদেশ, নিষেধ, ফরয বা আবশ্যিক কার্যাবলী সম্পাদনে চাপ প্রয়োগ, হারাম বা নিষিদ্ধ কার্যাবলী না করতে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ, নানা প্রকার অধিকার আদায়ে বাধ্যকরণ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে যে বা যারা আল্লাহকে রাযী-খুশি করার নিয়তে যথাযথ দায়িত্ব পালনের মানসে রাজনীতি[11] ও যুদ্ধ-জিহাদ করবে তার বা তাদের জন্য এসব কাজ উত্তম ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু যারা এরূপ নিয়ত ও সদিচ্ছা ছাড়া রাজনীতি ও যুদ্ধ ইত্যাদি করবে, তাদের জন্য তা মারাত্মক বিপদ হিসাবে গণ্য হবে। আর যেহেতু বহু ফরয ও আবশ্যিক বিষয় বাস্তবায়ন শাসনক্ষমতার উপর নির্ভরশীল সেহেতু এই ক্ষমতা অর্জন ও পরিচালনা ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভুক্ত।[12]
এজন্যই বিশেষ প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় পদ চেয়ে নেওয়া জায়েয আছে। যেমন মিসর রাজার নিকট ইউসুফ (আঃ) এমনই একটি পদ প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন, قَالَ اجْعَلْنِيْ عَلَى خَزَآئِنِ الأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيْمٌ ‘ইউসুফ বলল, (হে রাজা) আপনি আমাকে দেশের খাদ্য ভান্ডার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিন। আমি অবশ্যই একজন বিশ্বস্ত রক্ষক ও (এ কাজ পরিচালনায়) বিজ্ঞ বটে’ (ইউসুফ ১২/৫৫)।
আল্লামা সা‘দী বলেন, তিনি বিশেষ কিছু দিক লক্ষ্য করে পদ চেয়েছিলেন যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ পারবে না বলে তার মনে হয়েছিল। যেমন শস্য ভান্ডার পরিপূর্ণরূপে সংরক্ষণ এবং শস্য ভান্ডারের সাথে সম্পর্কিত সকল দিকের জ্ঞান, যথা : উন্নত উৎপাদন, সুষ্ঠু বিলিবণ্টন ও এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ইনছাফ প্রতিষ্ঠা। এ কারণেই রাজা তাঁকে একান্ত নিজের লোক করে নেন এবং তাঁকে তার অগ্রবর্তী লোকদের তালিকায় ঠাঁই দেন। আবার একইভাবে ইউসুফ (আঃ)-এর উপরও রাজা ও তার প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়। তাইতো দেখা যায়, তিনি যখন খাদ্য দপ্তরের দায়িত্ব নেন তখন অধিক খাদ্য ফলানোর জন্য চাষাবাদের উপর জোর দেন।[13]
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি এবং আল্লাহর পথে দাওয়াতের জন্য নেতৃত্বপ্রীতিحب) الرئاسة وحب الإمارة للدعوة إلى الله )-র মধ্যে পার্থক্য হ’ল নিজ জীবনের প্রতি গুরুত্বারোপ ও নিজের অধিকার ও প্রাপ্য আদায়ে সচেষ্ট হওয়া এবং আল্লাহর হুকুমের প্রতি গুরুত্বারোপ ও তার উপদেশ প্রদানের মাঝে পার্থক্যের মতই। কেননা যে আল্লাহর কল্যাণকামী সে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে, তাকে ভালবাসে, তার হুকুম সর্বক্ষেত্রে মেনে চলা হোক, কোন নাফরমানী করা না হোক সেটা সে প্রিয় মনে করে। সে চায় যে, আল্লাহর কথা (আইন) সর্বোচ্চ স্থানে থাকুক এবং দ্বীন সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যাক, সকল মানুষ আল্লাহর আদেশ মেনে চলুক, নিষেধ থেকে দূরে থাকুক। এভাবে সে দাসত্ব ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর কল্যাণ কামনা করে এবং আল্লাহর দিকে তার বান্দাদের দাওয়াত দানের মাধ্যমে মানুষ ও সৃষ্টির কল্যাণ কামনা করে। ফলে সে দ্বীন ইসলামের খাতিরে ইমামত বা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব পসন্দ করে। বরং সে তাকে মুমিন মুত্তাক্বীদের নেতা বানানোর জন্য তার রবের নিকট দো‘আ করে যাতে মুত্তাকীরা তার অনুসরণ করে, যেমন করে সে মুত্তাক্বীদের অনুসরণ করেছে। যেমন এরশাদ হচ্ছে, رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَاماً ‘হে আমাদের মালিক! তুমি আমাদের এমন জীবন সঙ্গিনী ও সন্তানাদি দাও যারা হবে নয়নপ্রীতিকর এবং তুমি আমাদেরকে মুত্তাক্বীদের নেতা বানাও’ (ফুরক্বান ২৫/৭৪)।
পক্ষান্তরে যারা নিছক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লিপ্সু তারা এই ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে পৃথিবীতে উঁচু আসন লাভ করতে চায়। দেশের মানুষ যাতে তাদের দাসে পরিণত হয় এবং তাদের পেছনে থাকে সেজন্য তাদের চেষ্টার অন্ত থাকে না। জনগণ সর্বক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করবে কিন্তু তারা তাদের উপর খবরদারী করবে এবং বল প্রয়োগ করবে সেই লক্ষ্যেও তারা ক্ষমতা পেতে চায়। তাদের এসব উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে যে কত রকম অনিষ্ট সৃষ্টি হয়, তা স্রেফ আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। যেমন বিদ্রোহ, হিংসা, স্বেচ্ছাচারিতা, অন্তর্দাহ, যুলুম-অত্যাচার, ফিতনা-ফাসাদ, আল্লাহর হক আদায়ের ক্ষেত্রে আত্মম্ভরিতা ও উন্নলাসিকতা প্রদর্শন, আললাহর পক্ষ থেকে সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা এবং অসম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সম্মানিত করা ইত্যাদি না হ’লে পার্থিব নেতৃত্ব যেন কখনই পূর্ণতা পায় না। আর এ ধরনের ক্ষমতার নাগাল পেতেও তাকে কয়েকগুণ বেশী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হ’তে হয়।[14]
শাসন ক্ষমতার প্রতি লালসার প্রকারভেদ (صور وأحوال حب الرئاسة) :
নেতৃত্বের বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শাসনক্ষমতা দুই প্রকার। যথা:
এক. পার্থিব ক্ষমতা,
দুই. দ্বীনী বিদ্যা বিজড়িত ক্ষমতা।
ইবনু রজব বলেছেন, সম্মান লাভের প্রতি লালসা দু’প্রকার। প্রথম প্রকার- রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও ধন-সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে সম্মান লাভের প্রয়াস। এটি খুবই মারাত্মক। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা মানুষকে আখেরাতের কল্যাণ ও মান-সম্মান থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لاَ يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَاداً وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ ‘এটা পরকালের গৃহ যা আমরা নির্ধারিত করে রেখেছি তাদের জন্য, যারা দুনিয়ায় কোন রকম প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় না এবং কোন অশান্তিকর কিছু করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাক্বীদের জন্যই রয়েছে’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।[15]
দ্বিতীয় প্রকার- ধর্মীয় বিষয়াদির মাধ্যমে সম্মান অর্জনের প্রয়াস। যেমন দ্বীনী বিদ্যা, আমল-আখলাক, তাক্বওয়া-পরহেযগারিতা, সংসারে অনাসক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের নযর নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করা। এটি প্রথম প্রকারের থেকেও জঘন্য ও কদর্য। এর বিপর্যয় ও ভয়াবহতা আরো মারাত্মক। কেননা দ্বীন-ইলম, আমল-আখলাক ও পরহেযগারিতা দ্বারা মহান আল্লাহর নিকট উঁচু মর্যাদা ও চিরস্থায়ী নে‘মত জান্নাত লাভ এবং তার খুব নিকটজনের মাঝে পরিগণিত হওয়াই একমাত্র কাম্য হওয়া উচিৎ। সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন, ইলমের মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করা হয় বলেই তার এত মর্যাদা, নতুবা তা অন্য আর পাঁচটা জিনিসের মতই। অতএব এই ইলমের অংশবিশেষ দ্বারাও যদি এই নশ্বর জগতের কোন বস্ত্ত তলব করা হয়, তাহ’লে তাও দু’শ্রেণীতে পড়বে।
প্রথম শ্রেণী : ধনদৌলত কামাইয়ের জন্য দ্বীনী বিদ্যার ব্যবহার। এতে সম্পদের প্রতি এক ধরনের লোভ ফুটে উঠবে এবং হারাম উপায়ে তা উপার্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে প্রমাণিত হবে।
দ্বিতীয় শ্রেণী : দ্বীনী বিদ্যা, আমল ও পরহেযগারিতা দ্বারা মানব জাতির উপর নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব যাহির করার ইচ্ছা। মানুষ যাতে তাদের অনুগত থাকে, তাদের সামনে মাথা নত করে এবং তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এই শ্রেণীর বিদ্বানরা সেটাই আশা করে। অধিকন্তু তারা মানুষের মাঝে অন্য আলেমদের তুলনায় তাদের জ্ঞান গরিমার আধিক্য যাহির করতে চায়, যাতে তাদের উপর এদের প্রাধান্য বজায় থাকে। এরূপ ইচ্ছা পোষণকারী বিদ্বানদের প্রতিশ্রুত স্থান জাহান্নাম। কেননা সৃষ্টিকুলের উপর বড়াই করার ইচ্ছা আপনা থেকেই হারাম, আর যখন তাতে (বড়াইয়ের ক্ষেত্রে) বিদ্যার মত একটি পারলৌকিক উপকরণ ব্যবহার করা হবে তখন তো তা অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার মত বড়াইয়ের পার্থিব উপকরণ ব্যবহার থেকেও ভীষণ কদর্য ও জঘন্য রূপ নিবে।
কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ ‘বোকাদের সঙ্গে বিতর্ক করা কিংবা আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কিংবা জনগণের দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরানোর মানসে যে বিদ্যা অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন’।[16]
শাসন ক্ষমতা প্রীতির দু’টি অবস্থা রয়েছে :
প্রথম : ক্ষমতা লাভের পূর্বেকার অবস্থা। কিছু মানুষ এমন আছে যারা শাসন ক্ষমতা লোভী। এই লোভের লক্ষণ ও চিহ্নগুলো তাদের মাঝে ভালভাবে ফুটে ওঠে। অর্থাৎ ক্ষমতার জন্য তারা নানা রকম চেষ্টা-তদবির করে; তাতেই মানুষ বোঝে যে এরা ক্ষমতাপ্রত্যাশী। তারপর তাদের কারো কপালে ক্ষমতা জোটে, আবার কারো জোটে না। এ কথার সমর্থন মেলে আল্লাহর নিম্নের বাণীতে, مَّنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيْهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُّرِيْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاَهَا مَذْمُوماً مَّدْحُوراً ‘যারা দুনিয়া পেতে চায় তাদের মধ্যে আমি যাকে ইচ্ছা করি দুনিয়ার সম্পদ থেকে আমার ইচ্ছামাফিক তা দ্রুত দিয়ে দেই। তারপর তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করে রাখি। যেখানে সে প্রবেশ করবে একান্ত নিন্দিত ও ধিকৃত অবস্থায়’ (ইসরাঈল ১৭/১৮)।
দ্বিতীয় : ক্ষমতা লাভের পরের অবস্থা। অনেক মানুষ ক্ষমতা লাভের ব্যাপারে কখনো কখনো অনাগ্রহ প্রকাশ করে, তারপর যখন তা লাভ করে তখন তার হৃদয়-মন তার সাথে গেঁথে যায়। আবার কখনো ক্ষমতার সাথে তার একটু-আধটু যোগ থাকে, তারপর তা হাতে আসার পর সে যোগ খুব বাড়তে থাকে। কেননা এ সময় সে ক্ষমতার স্বাদ এবং তা হারানোর ভয়ে তাকে আরো অাঁকড়ে ধরতে চায়। ইবনু রজব বলেছেন, ‘জেনে রাখ, মান-মর্যাদার লোভ মহাক্ষতি ডেকে আনে। মর্যাদা লাভের আগে তা অর্জনের পথ-পদ্ধতি বা কলাকৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ অনেক হীন ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। আবার মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে অন্যের উপর নিপীড়ন, ক্ষমতা প্রদর্শন, দাম্ভিকতা দেখানো ইত্যাদি ক্ষতিকর জিনিসের উদগ্র নেশায় পেয়ে বসে।[17]
________________________________________
[1]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ, পৃঃ ১৬।
[2]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৬/৩৪৬।
[3]. আবু উবায়েদ, গারীবুল হাদীছ ৪/১৭১।
[4]. মাজমূউ ফাতাওয়া ১৬/৩৪৬।
[5]. আবুদাঊদ হা/২৬০৮, আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন।
[6]. আস-সিয়াসাতুশ শারঈয়্যাহ, পৃঃ ১২৯।
[7]. বুখারী হা/৭১৪৭; মুসলিম হা/১৬৫২।
[8]. মুসলিম হা/১৮২৪।
[9]. বুখারী হা/৭১৪৮।
[10]. ফাতহুল বারী ১৩/১২৬।
[11]. ‘সিয়াসাত’ (السياسة) অর্থ প্রচলিত ক্ষমতা দখলের রাজনীতি নয়, বরং সমাজ সংশ্লিষ্ট সকল কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। সেখানে যে ব্যক্তি যে কাজের যোগ্য, সে ব্যক্তি সে কাজ করবে স্রেফ আল্লাহকে খুশী করার জন্য। নিজের বা নিজ দলের অন্যায় স্বার্থ হাছিলের জন্য নয়। দেশের নেতার কাছে নিজের যোগ্যতা তুলে ধরা ও তা ব্যবহারের মাধ্যমে জনকল্যাণের সুযোগ প্রার্থনা করা নিঃসন্দেহে জায়েয। যেমনটি ইউসুফ (আঃ) করেছিলেন। যেমনটি এ যুগেও যেকোন কর্মের ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা তুলে ধরা হয়। কিন্তু এই অজুহাতে প্রচলিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নেতৃত্বের জন্য প্রার্থী হওয়া যাবে না। কেননা এখানে নেতার কাছে দায়িত্ব চাওয়া হয় না। বরং লোকদের কাছে নিজের জন্য নেতৃত্ব চাওয়া হয়। তাছাড়া এখানে মানুষের মনগড়া আইন রচনার ও মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ভোট চাওয়া হয়। আল্লাহর আইন ও তাঁর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। (স.স.)।
[12]. বাহজাতু কুলূবিল আবরার, পৃঃ ১০৫-১০৬।
[13]. ঐ, পৃঃ ১০৬।
[14]. আর-রূহু, পৃঃ ২৫২-২৫৩।
[15]. দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাদীছ (২৯)-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[16]. তিরমিযী হা/২৬৫৪, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব ১/২৫ পৃঃ; ঈষৎ পরিবর্তনসহ দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাদীছের ব্যাখ্যা ৪৭-৫৩ পৃঃ।
[17]. ঐ, পৃঃ ৩২।
=======================
Comment