Announcement

Collapse
No announcement yet.

"নেতৃত্বের মোহ"- শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-ম

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • "নেতৃত্বের মোহ"- শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-ম

    নেতৃত্বের মোহ

    মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ

    সারা জাহানের মালিকের জন্য সকল প্রশংসা। দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক নবী আল-আমীনের উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবীদের সকলের উপর। অতঃপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে মানুষের আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতাকে বিনষ্ট করে দেয়। এর ফলে দুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক গাঢ় হ’তে থাকে এবং আখিরাত হয়ে পড়ে উপেক্ষিত। এটা এক দুরারোগ্য মরণব্যাধি। এর জন্য ধন-সম্পদ ব্যয়িত হয় এবং রক্তারক্তি খুনোখুনি ঘটে। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভাইয়ে ভাইয়ে এমনকি পিতা-পুত্রের মাঝেও শত্রুতা সৃষ্টি হয়। এজন্যই এ ব্যাধিকে ‘সুপ্তবাসনা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ভয়াবহ ও মারাত্মক বিষয়টি একটু বিস্তারিতভাবে আমরা আলোচনা করব। প্রথমেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি লালসাকে অবচেতন মনের ‘সুপ্তবাসনা’ নামকরণের মূলভিত্তি কী তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তারপর একে একে শাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, এ বিষয়ে একজন মুসলিমের ভূমিকা, শাসন ব্যবস্থার প্রতি লালসার প্রকারভেদ, শাসন ক্ষমতা যাহির করার ক্ষেত্র, শাসন ক্ষমতা প্রীতির কারণ এবং এর চিকিৎসা বা প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করব। অবশ্য এ লেখা প্রস্ত্তত ও সুন্দরভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যারা যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আমি মোটেও কুণ্ঠাবোধ করছি না। সবার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট উপকারী ইলম এবং নেক আমলের তাওফীক কামনা করছি।

    রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিকে সুপ্ত বাসনা নামকরণঃ

    রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিকে অবচেতন মনের সুপ্ত বাসনা নামকরণের মূলে রয়েছে শাদ্দাদ ইবনে আওস (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি মাওকূফ হাদীছ। তাঁর থেকে বর্ণিত আছে যে, একদিন বস্ত্রাচ্ছাদিত অবস্থায় তিনি অনবরত কাঁদছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তাঁকে বলল, হে আবু ইয়া‘লা, আপনি কাঁদছেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসের ভয় করছি তা হ’ল অবচেতন মনের মাঝে লালিত সুপ্তবাসনা এবং স্পষ্টভাবে লোক দেখানো কাজ। নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না, নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না, নিশ্চয়ই তোমাদেরকে তোমাদের শাসকবর্গের পক্ষ থেকে ব্যতীত কিছুই দেওয়া হবে না। তারা এমন যে, ভাল কাজের আদেশ দিলেও তা পালিত হয়, আবার মন্দ কাজের আদেশ দিলেও তা পালিত হয়। আর মুনাফিকের অবস্থা কী? মুনাফিক তো আসলে সেই উটের মত, যাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে ফলে রশিতে ফাঁস লেগে সে মারা গেছে। মুনাফিক কখনই মুনাফিকীর ক্ষতি হ’তে নিজকে রক্ষা করতে পারবে না।[1]

    ইমাম আবুদাঊদ সিজিসতানী (রহঃ) মনের সুপ্তবাসনা (الشهوة الخفية )-কে حب الرئاسة বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আবুদাঊদ (রহঃ)-এর পুত্র আবুবকর বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, شهوة خفية বা মনের সুপ্তবাসনা হ’ল حب الرياسة বা নেতৃত্বের মোহ।[2] আল্লাহই ভাল জানেন, দৃশ্যত এটা একটা উদাহরণমূলক ব্যাখ্যা। এজন্যই আবু উবায়েদ (রহঃ) বলেছেন, الشهوة الخفية বা মনের সুপ্তবাসনার অর্থ সম্পর্কে মনীষীগণ মতানৈক্য করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, الشهوة الخفية দ্বারা মেয়ে লোক ও অন্য কোন কিছুর কামনার কথা বলা হয়েছে। আমার (আবু উবায়েদ) মতে, এটি কোন একটি জিনিসের সাথে খাছ বা নির্দিষ্ট নয়; বরং সকল প্রকার পাপ কাজই সুপ্তবাসনা, যা পাপী ব্যক্তি করার জন্য মনের কোণে লুকিয়ে রাখে এবং তা করতে অনবরত সুযোগ খোঁজে, যদিও সে তা এখনো বাস্তবে রূপায়িত করেনি।[3] তবে শিক্ষিত সমাজে আবুদাঊদ (রহঃ) প্রদত্ত ব্যাখ্যাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ফলে الشهوة الخفية বা সুপ্তবাসনার ভিন্ন কোন অর্থ করার নিদর্শন বর্তমান না থাকলে তা দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতিই বুঝাবে। বলা যায় এটি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি সুপ্তবাসনার একটি প্রতীকী নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, মানুষের মনে অনেক বাসনাই সুপ্ত থাকে, যা সে বুঝতে পারে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ অনেক মানুষের মনের মাঝে লুক্কায়িত তেমনি একটি সুপ্তবাসনা। লোকটা হয়ত খাঁটি মনে আল্লাহর ইবাদত করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমস্যাবলীই বা কী, আর দোষ-ত্রুটিই বা কোথায় তাও সে হয়ত জানত না। কিন্তু যেকোনভাবে তার সামনে ক্ষমতা লাভের কোন একটি সুযোগ এসে গেল অমনিই সে তা লুফে নিতে তৎপর হয়ে উঠল। অথচ তার মাঝে যে ক্ষমতার বাসনা ছিল তা সে এর আগ মুহূর্তেও বুঝে উঠতে পারেনি। পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় সেই সুপ্ত বাসনা এখন জেগে উঠেছে। ক্ষমতার সিঁড়িতে এভাবে বহু মানুষই পা রেখেছে। এজন্যই ক্ষমতার এই মোহকে ‘সুপ্তবাসনা’ বলা হয়।[4]

    রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা (حاجة الناس إلى الولاية ) : ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, জনগণের শাসনভার গ্রহণ ও পরিচালনা দ্বীনের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। বরং দ্বীন ও দুনিয়ার অস্তিত্ব এই শাসন ব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র ছাড়া কোন মতে চলতে পারে না। কেননা মানুষ একটি সংঘবদ্ধ জীব। তাদের নানামুখী প্রয়োজন পূরণে সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন রয়েছে। আর সংঘবদ্ধ হ’লেই সেখানে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন নেতা থাকা আবশ্যক। এজন্যই নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا خَرَجَ ثَلاَثَةٌ فِىْ سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوْا أَحَدَهُمْ ‘যখন তিন জন মানুষ ভ্রমণে বের হবে তখন যেন তারা তাদের কোন একজনকে আমীর বা দলনেতা বানিয়ে নেয়’।[5] সফরের মত একটি ছোট্ট জোটবদ্ধতায় যেখানে নবী করীম (ছাঃ) নেতা নিয়োগকে আবশ্যিক বা ফরয ধার্য করেছেন, তখন সব রকমের সংঘবদ্ধতায় যে আমীর বা নেতা নিয়োগ করা ফরয তা বলাই বাহুল্য। আল্লাহ তা‘আলা সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ ফরয করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ছাড়া তা কার্যকরী হ’তে পারে না। অনুরূপভাবে জিহাদ, সুবিচার, হজ্জ পালন, জুম‘আ, দুই ঈদের ছালাত কায়েম, অত্যাচারিতের সাহায্য এবং আল্লাহ প্রদত্ত দন্ডবিধি কার্যকর ক্ষমতা ও সার্বভৌম কর্তৃত্ব ব্যতীত পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করা যায় না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, ‘কোন শাসক ব্যতীত একটি রাত কাটানো অপেক্ষা একজন যালেম সরকারের অধীনে ষাট বছর পার করাও অনেক ভাল’। অভিজ্ঞতাও সে কথা বলে।[6]

    ফলে জনগণের সার্বিক কার্যাবলীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এমন একজন নির্বাহীর প্রয়োজন, যিনি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবেন, সকল বিভাগের নেতৃত্ব দিবেন এবং সকল কাজের দায়-দায়িত্ব বহন করবেন।

    শাসনক্ষমতা লাভের ক্ষেত্রে একজন মুসলমানের ভূমিকা (موقف المسلم من الولاية ) : হাদীছে এসেছে,
    عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنَّكَ إِنْ أُوْتِيْتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُوْتِِيْتَهَا مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا،
    আব্দুর রহমান ইবনু সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে আব্দুর রহমান, তুমি কখনো নেতৃত্ব চেয়ে নিও না। কেননা তুমি যদি চেয়ে নিয়ে তা লাভ কর, তাহ’লে তোমাকে ঐ দায়িত্বের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে (অর্থাৎ তুমি দায়িত্ব পালনে হিমশিম খাবে, কিন্তু কোন সহযোগিতা পাবে না)। আর না চাইতেই যদি তা পাও তাহ’লে তুমি সেজন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’।[7]

    আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসলাম। আমার সাথে ছিল আশ‘আরী গোত্রের দু’জন লোক। তাদের একজন ছিল আমার ডানে এবং অন্যজন ছিল আমার বামে। তারা দু’জনেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কার্যভার চেয়ে বসল। নবী করীম (ছাঃ) সে সময় মেসওয়াক করছিলেন। আমি তাঁর ঠোঁটের নিচে মেসওয়াক কীভাবে রয়েছে আর ঠোঁট সঙ্কুচিত হয়ে আসছে সে দৃশ্য এখনো যেন দেখতে পাচ্ছি। তিনি বললেন, হে আবু মূসা বা হে আব্দুল্লাহ বিন কায়েস! ব্যাপার কি? ওদের কথা শুনে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তার শপথ, তারা দু’জন যেমন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি তেমনি এখানে এসে তারা যে কার্যভার চেয়ে বসবে তাও আমি বুঝতে পারিনি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যেসব পদ আমাদের রয়েছে তা যে চেয়ে নেয় আমরা কখনই তাকে সে পদে নিযুক্ত করব না। তবে হে আবু মূসা, আব্দুল্লাহ ইবনু কায়েস! তুমি (অমুক পদে দায়িত্ব পালনের জন্য) যাও। তারপর তিনি তাঁকে ইয়ামান প্রদেশের শাসক করে পাঠালেন।[8]

    عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى الإِمَارَةِ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَتِ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ.
    আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য খুব আগ্রহী হবে। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তা লজ্জা (ও আফসোসের) কারণ হবে। দুধদানকারী হিসাবে (ক্ষমতার দিনগুলোতে নানান সুযোগ সুবিধা ভোগের দিক দিয়ে) ক্ষমতা কতই না ভাল। কিন্তু ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি কতই না নিকৃষ্ট পরিণামবহ’।[9]

    ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ক্ষমতা দুধদানকারী পশুতুল্য। কারণ ক্ষমতা থাকলে পদ, পদবী, সম্পদ, হুকুমজারী, নানা রকম ভোগ-বিলাসিতা ও মানসিক তৃপ্তি অর্জিত হয়। কিন্তু মৃত্যু কিংবা অন্য কোন কারণে ক্ষমতা যখন চলে যায়, তখন আর তা মোটেও সুখকর থাকে না। বিশেষত আখেরাতে যখন এজন্য নানা ভীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হ’তে হবে তখন ক্ষমতা মহাজ্বালা হয়ে দেখা দিবে।[10]

    আল্লামা আব্দুর রহমান সা‘দী বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা জনগণের উপর কর্তৃত্বমূলক যে কোন পদ মানুষের চেয়ে নেওয়া উচিত নয় এবং সে জন্য নিজেকে যোগ্য বলে উপস্থাপন করাও কাম্য নয়; বরং এজন্য আল্লাহর নিকট দায়িত্ব মুক্ত ও নির্ঝঞ্ঝাট জীবন প্রার্থনা করা উচিত। কেননা সে তো জানে না যে, শাসন ক্ষমতা তার জন্য কল্যাণকর হবে, না অকল্যাণকর। সে এও জানে না যে, এই দায়িত্ব সে পালন করতে পারবে কি-না? তারপরও যখন সে দায়িত্বের জন্য আবেদন-নিবেদন করে, তখন তো তা পেলে তার নিজের দিকেই তা সোপর্দ করে দেয়া হয়। আর যখন বান্দার দিকে দায়িত্ব সোপর্দ করে দেয়া হয়, তখন সেজন্য সে আল্লাহর সহায়তা পায় না। তার সব কাজ সুচারু রূপে করতে পারে না এবং সাহায্য-সহযোগিতাও পায় না। কেননা তার ক্ষমতা চেয়ে নেয়া দু’টি অবৈধ বিষয়ের বার্তা প্রদান করে।

    প্রথমতঃ পার্থিব সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতি লোভ। এ ধরনের লোভ আল্লাহর সম্পদে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে এবং আল্লাহর বান্দাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির পদক্ষেপে উদ্বুদ্ধ করে।

    দ্বিতীয়তঃ এতে নিজেকে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবার এবং আল্লাহর সাহায্যের দরকার না লাগার গন্ধ রয়েছে।

    কিন্তু যার ক্ষমতার প্রতি লোভ ও ঝোঁক নেই এমন ব্যক্তি বিনা আবেদনে ক্ষমতা পেলে এবং দায়িত্ব পালনে নিজেকে অক্ষম মনে করলেও তার যে কোন সমস্যায় আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করবেন, তাকে তার নিজের ক্ষমতার উপর ছেড়ে দিবেন না। কেননা সে তো এই বিপদ নিজ থেকে ডেকে আনেনি। যে স্বেচ্ছায় বিপদ ডেকে আনেনি তার ভার বহনের ব্যবস্থা করা হয় এবং তার দায়িত্ব পালনের যোগ্যতাও তৈরী করে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় আল্লাহর উপর তার ভরসা জোরদার হয়। আর বান্দা যখন আল্লাহর উপর ভরসা করে কোন কাজে আগুয়ান হয় তখন সফলতা তার হাতে এসে ধরা দেয়।

    রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী ‘তুমি সেজন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’ (اعنت عليها ) এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, ইমারত প্রভৃতি পার্থিব নেতৃত্ব দ্বীন ও দুনিয়া উভয়কে নিজের মধ্যে শামিল করে। কেননা সবরকম কর্তৃত্বের মূল উদ্দেশ্য মানুষের দ্বীন-ধর্ম এবং জাগতিক সংশোধন ও কল্যাণ সাধন করা। এজন্যই প্রশাসনিক নেতৃত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আদেশ, নিষেধ, ফরয বা আবশ্যিক কার্যাবলী সম্পাদনে চাপ প্রয়োগ, হারাম বা নিষিদ্ধ কার্যাবলী না করতে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ, নানা প্রকার অধিকার আদায়ে বাধ্যকরণ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে যে বা যারা আল্লাহকে রাযী-খুশি করার নিয়তে যথাযথ দায়িত্ব পালনের মানসে রাজনীতি[11] ও যুদ্ধ-জিহাদ করবে তার বা তাদের জন্য এসব কাজ উত্তম ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু যারা এরূপ নিয়ত ও সদিচ্ছা ছাড়া রাজনীতি ও যুদ্ধ ইত্যাদি করবে, তাদের জন্য তা মারাত্মক বিপদ হিসাবে গণ্য হবে। আর যেহেতু বহু ফরয ও আবশ্যিক বিষয় বাস্তবায়ন শাসনক্ষমতার উপর নির্ভরশীল সেহেতু এই ক্ষমতা অর্জন ও পরিচালনা ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভুক্ত।[12]

    এজন্যই বিশেষ প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় পদ চেয়ে নেওয়া জায়েয আছে। যেমন মিসর রাজার নিকট ইউসুফ (আঃ) এমনই একটি পদ প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন, قَالَ اجْعَلْنِيْ عَلَى خَزَآئِنِ الأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيْمٌ ‘ইউসুফ বলল, (হে রাজা) আপনি আমাকে দেশের খাদ্য ভান্ডার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিন। আমি অবশ্যই একজন বিশ্বস্ত রক্ষক ও (এ কাজ পরিচালনায়) বিজ্ঞ বটে’ (ইউসুফ ১২/৫৫)।

    আল্লামা সা‘দী বলেন, তিনি বিশেষ কিছু দিক লক্ষ্য করে পদ চেয়েছিলেন যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ পারবে না বলে তার মনে হয়েছিল। যেমন শস্য ভান্ডার পরিপূর্ণরূপে সংরক্ষণ এবং শস্য ভান্ডারের সাথে সম্পর্কিত সকল দিকের জ্ঞান, যথা : উন্নত উৎপাদন, সুষ্ঠু বিলিবণ্টন ও এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ইনছাফ প্রতিষ্ঠা। এ কারণেই রাজা তাঁকে একান্ত নিজের লোক করে নেন এবং তাঁকে তার অগ্রবর্তী লোকদের তালিকায় ঠাঁই দেন। আবার একইভাবে ইউসুফ (আঃ)-এর উপরও রাজা ও তার প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়। তাইতো দেখা যায়, তিনি যখন খাদ্য দপ্তরের দায়িত্ব নেন তখন অধিক খাদ্য ফলানোর জন্য চাষাবাদের উপর জোর দেন।[13]

    আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি এবং আল্লাহর পথে দাওয়াতের জন্য নেতৃত্বপ্রীতিحب) الرئاسة وحب الإمارة للدعوة إلى الله )-র মধ্যে পার্থক্য হ’ল নিজ জীবনের প্রতি গুরুত্বারোপ ও নিজের অধিকার ও প্রাপ্য আদায়ে সচেষ্ট হওয়া এবং আল্লাহর হুকুমের প্রতি গুরুত্বারোপ ও তার উপদেশ প্রদানের মাঝে পার্থক্যের মতই। কেননা যে আল্লাহর কল্যাণকামী সে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে, তাকে ভালবাসে, তার হুকুম সর্বক্ষেত্রে মেনে চলা হোক, কোন নাফরমানী করা না হোক সেটা সে প্রিয় মনে করে। সে চায় যে, আল্লাহর কথা (আইন) সর্বোচ্চ স্থানে থাকুক এবং দ্বীন সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যাক, সকল মানুষ আল্লাহর আদেশ মেনে চলুক, নিষেধ থেকে দূরে থাকুক। এভাবে সে দাসত্ব ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর কল্যাণ কামনা করে এবং আল্লাহর দিকে তার বান্দাদের দাওয়াত দানের মাধ্যমে মানুষ ও সৃষ্টির কল্যাণ কামনা করে। ফলে সে দ্বীন ইসলামের খাতিরে ইমামত বা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব পসন্দ করে। বরং সে তাকে মুমিন মুত্তাক্বীদের নেতা বানানোর জন্য তার রবের নিকট দো‘আ করে যাতে মুত্তাকীরা তার অনুসরণ করে, যেমন করে সে মুত্তাক্বীদের অনুসরণ করেছে। যেমন এরশাদ হচ্ছে, رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَاماً ‘হে আমাদের মালিক! তুমি আমাদের এমন জীবন সঙ্গিনী ও সন্তানাদি দাও যারা হবে নয়নপ্রীতিকর এবং তুমি আমাদেরকে মুত্তাক্বীদের নেতা বানাও’ (ফুরক্বান ২৫/৭৪)।

    পক্ষান্তরে যারা নিছক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লিপ্সু তারা এই ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে পৃথিবীতে উঁচু আসন লাভ করতে চায়। দেশের মানুষ যাতে তাদের দাসে পরিণত হয় এবং তাদের পেছনে থাকে সেজন্য তাদের চেষ্টার অন্ত থাকে না। জনগণ সর্বক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করবে কিন্তু তারা তাদের উপর খবরদারী করবে এবং বল প্রয়োগ করবে সেই লক্ষ্যেও তারা ক্ষমতা পেতে চায়। তাদের এসব উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে যে কত রকম অনিষ্ট সৃষ্টি হয়, তা স্রেফ আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। যেমন বিদ্রোহ, হিংসা, স্বেচ্ছাচারিতা, অন্তর্দাহ, যুলুম-অত্যাচার, ফিতনা-ফাসাদ, আল্লাহর হক আদায়ের ক্ষেত্রে আত্মম্ভরিতা ও উন্নলাসিকতা প্রদর্শন, আললাহর পক্ষ থেকে সম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা এবং অসম্মানপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সম্মানিত করা ইত্যাদি না হ’লে পার্থিব নেতৃত্ব যেন কখনই পূর্ণতা পায় না। আর এ ধরনের ক্ষমতার নাগাল পেতেও তাকে কয়েকগুণ বেশী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হ’তে হয়।[14]

    শাসন ক্ষমতার প্রতি লালসার প্রকারভেদ (صور وأحوال حب الرئاسة) :

    নেতৃত্বের বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শাসনক্ষমতা দুই প্রকার। যথা:

    এক. পার্থিব ক্ষমতা,
    দুই. দ্বীনী বিদ্যা বিজড়িত ক্ষমতা।

    ইবনু রজব বলেছেন, সম্মান লাভের প্রতি লালসা দু’প্রকার। প্রথম প্রকার- রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও ধন-সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে সম্মান লাভের প্রয়াস। এটি খুবই মারাত্মক। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা মানুষকে আখেরাতের কল্যাণ ও মান-সম্মান থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لاَ يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَاداً وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ ‘এটা পরকালের গৃহ যা আমরা নির্ধারিত করে রেখেছি তাদের জন্য, যারা দুনিয়ায় কোন রকম প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় না এবং কোন অশান্তিকর কিছু করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাক্বীদের জন্যই রয়েছে’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।[15]
    দ্বিতীয় প্রকার- ধর্মীয় বিষয়াদির মাধ্যমে সম্মান অর্জনের প্রয়াস। যেমন দ্বীনী বিদ্যা, আমল-আখলাক, তাক্বওয়া-পরহেযগারিতা, সংসারে অনাসক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের নযর নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করা। এটি প্রথম প্রকারের থেকেও জঘন্য ও কদর্য। এর বিপর্যয় ও ভয়াবহতা আরো মারাত্মক। কেননা দ্বীন-ইলম, আমল-আখলাক ও পরহেযগারিতা দ্বারা মহান আল্লাহর নিকট উঁচু মর্যাদা ও চিরস্থায়ী নে‘মত জান্নাত লাভ এবং তার খুব নিকটজনের মাঝে পরিগণিত হওয়াই একমাত্র কাম্য হওয়া উচিৎ। সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন, ইলমের মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করা হয় বলেই তার এত মর্যাদা, নতুবা তা অন্য আর পাঁচটা জিনিসের মতই। অতএব এই ইলমের অংশবিশেষ দ্বারাও যদি এই নশ্বর জগতের কোন বস্ত্ত তলব করা হয়, তাহ’লে তাও দু’শ্রেণীতে পড়বে।

    প্রথম শ্রেণী : ধনদৌলত কামাইয়ের জন্য দ্বীনী বিদ্যার ব্যবহার। এতে সম্পদের প্রতি এক ধরনের লোভ ফুটে উঠবে এবং হারাম উপায়ে তা উপার্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে প্রমাণিত হবে।
    দ্বিতীয় শ্রেণী : দ্বীনী বিদ্যা, আমল ও পরহেযগারিতা দ্বারা মানব জাতির উপর নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব যাহির করার ইচ্ছা। মানুষ যাতে তাদের অনুগত থাকে, তাদের সামনে মাথা নত করে এবং তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এই শ্রেণীর বিদ্বানরা সেটাই আশা করে। অধিকন্তু তারা মানুষের মাঝে অন্য আলেমদের তুলনায় তাদের জ্ঞান গরিমার আধিক্য যাহির করতে চায়, যাতে তাদের উপর এদের প্রাধান্য বজায় থাকে। এরূপ ইচ্ছা পোষণকারী বিদ্বানদের প্রতিশ্রুত স্থান জাহান্নাম। কেননা সৃষ্টিকুলের উপর বড়াই করার ইচ্ছা আপনা থেকেই হারাম, আর যখন তাতে (বড়াইয়ের ক্ষেত্রে) বিদ্যার মত একটি পারলৌকিক উপকরণ ব্যবহার করা হবে তখন তো তা অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার মত বড়াইয়ের পার্থিব উপকরণ ব্যবহার থেকেও ভীষণ কদর্য ও জঘন্য রূপ নিবে।

    কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ ‘বোকাদের সঙ্গে বিতর্ক করা কিংবা আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কিংবা জনগণের দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরানোর মানসে যে বিদ্যা অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন’।[16]

    শাসন ক্ষমতা প্রীতির দু’টি অবস্থা রয়েছে :

    প্রথম : ক্ষমতা লাভের পূর্বেকার অবস্থা। কিছু মানুষ এমন আছে যারা শাসন ক্ষমতা লোভী। এই লোভের লক্ষণ ও চিহ্নগুলো তাদের মাঝে ভালভাবে ফুটে ওঠে। অর্থাৎ ক্ষমতার জন্য তারা নানা রকম চেষ্টা-তদবির করে; তাতেই মানুষ বোঝে যে এরা ক্ষমতাপ্রত্যাশী। তারপর তাদের কারো কপালে ক্ষমতা জোটে, আবার কারো জোটে না। এ কথার সমর্থন মেলে আল্লাহর নিম্নের বাণীতে, مَّنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيْهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُّرِيْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاَهَا مَذْمُوماً مَّدْحُوراً ‘যারা দুনিয়া পেতে চায় তাদের মধ্যে আমি যাকে ইচ্ছা করি দুনিয়ার সম্পদ থেকে আমার ইচ্ছামাফিক তা দ্রুত দিয়ে দেই। তারপর তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করে রাখি। যেখানে সে প্রবেশ করবে একান্ত নিন্দিত ও ধিকৃত অবস্থায়’ (ইসরাঈল ১৭/১৮)।

    দ্বিতীয় : ক্ষমতা লাভের পরের অবস্থা। অনেক মানুষ ক্ষমতা লাভের ব্যাপারে কখনো কখনো অনাগ্রহ প্রকাশ করে, তারপর যখন তা লাভ করে তখন তার হৃদয়-মন তার সাথে গেঁথে যায়। আবার কখনো ক্ষমতার সাথে তার একটু-আধটু যোগ থাকে, তারপর তা হাতে আসার পর সে যোগ খুব বাড়তে থাকে। কেননা এ সময় সে ক্ষমতার স্বাদ এবং তা হারানোর ভয়ে তাকে আরো অাঁকড়ে ধরতে চায়। ইবনু রজব বলেছেন, ‘জেনে রাখ, মান-মর্যাদার লোভ মহাক্ষতি ডেকে আনে। মর্যাদা লাভের আগে তা অর্জনের পথ-পদ্ধতি বা কলাকৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ অনেক হীন ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। আবার মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে অন্যের উপর নিপীড়ন, ক্ষমতা প্রদর্শন, দাম্ভিকতা দেখানো ইত্যাদি ক্ষতিকর জিনিসের উদগ্র নেশায় পেয়ে বসে।[17]
    ________________________________________
    [1]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ, পৃঃ ১৬।
    [2]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১৬/৩৪৬।
    [3]. আবু উবায়েদ, গারীবুল হাদীছ ৪/১৭১।
    [4]. মাজমূউ ফাতাওয়া ১৬/৩৪৬।
    [5]. আবুদাঊদ হা/২৬০৮, আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন।
    [6]. আস-সিয়াসাতুশ শারঈয়্যাহ, পৃঃ ১২৯।
    [7]. বুখারী হা/৭১৪৭; মুসলিম হা/১৬৫২।
    [8]. মুসলিম হা/১৮২৪।
    [9]. বুখারী হা/৭১৪৮।
    [10]. ফাতহুল বারী ১৩/১২৬।
    [11]. ‘সিয়াসাত’ (السياسة) অর্থ প্রচলিত ক্ষমতা দখলের রাজনীতি নয়, বরং সমাজ সংশ্লিষ্ট সকল কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। সেখানে যে ব্যক্তি যে কাজের যোগ্য, সে ব্যক্তি সে কাজ করবে স্রেফ আল্লাহকে খুশী করার জন্য। নিজের বা নিজ দলের অন্যায় স্বার্থ হাছিলের জন্য নয়। দেশের নেতার কাছে নিজের যোগ্যতা তুলে ধরা ও তা ব্যবহারের মাধ্যমে জনকল্যাণের সুযোগ প্রার্থনা করা নিঃসন্দেহে জায়েয। যেমনটি ইউসুফ (আঃ) করেছিলেন। যেমনটি এ যুগেও যেকোন কর্মের ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা তুলে ধরা হয়। কিন্তু এই অজুহাতে প্রচলিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নেতৃত্বের জন্য প্রার্থী হওয়া যাবে না। কেননা এখানে নেতার কাছে দায়িত্ব চাওয়া হয় না। বরং লোকদের কাছে নিজের জন্য নেতৃত্ব চাওয়া হয়। তাছাড়া এখানে মানুষের মনগড়া আইন রচনার ও মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ভোট চাওয়া হয়। আল্লাহর আইন ও তাঁর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। (স.স.)।
    [12]. বাহজাতু কুলূবিল আবরার, পৃঃ ১০৫-১০৬।
    [13]. ঐ, পৃঃ ১০৬।
    [14]. আর-রূহু, পৃঃ ২৫২-২৫৩।
    [15]. দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাদীছ (২৯)-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
    [16]. তিরমিযী হা/২৬৫৪, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব ১/২৫ পৃঃ; ঈষৎ পরিবর্তনসহ দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ের হাদীছের ব্যাখ্যা ৪৭-৫৩ পৃঃ।
    [17]. ঐ, পৃঃ ৩২।
    =======================

  • #2
    ক্ষমতা প্রকাশের ক্ষেত্র (مظاهر حب الرئاسة) :

    শাসন ক্ষমতা যাহির করার নানাক্ষেত্র রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নোক্তগুলো অন্যতম।

    ১. আল্লাহর সার্বভৌম ও সার্বিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা :

    ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) বলেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার, তাঁর সঙ্গে শরীক করা, নিজেকে তাঁর সমকক্ষ দাবী করা কিংবা তাঁকে বাদ দিয়ে নিজেকে মা‘বূদ আখ্যা দেওয়া সবচেয়ে বড় পাপ। শেষোক্ত দু’টি পাপও মানুষ করেছে। মিশররাজ ফেরাঊন আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেকে মা‘বূদ বা উপাস্য বলে দাবী করেছিল। সে বলেছিল,مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَهٍ غَيْرِيْ ‘হে আমার পারিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের আর কোন উপাস্য আছে বলে তো আমি জানি না’ (ক্বাছাছ ২৮/৩৮)। সে আরো বলেছিল, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى ‘আমিই হচ্ছি তোমাদের সবচেয়ে বড় প্রভু’ (নাযি‘আত ৭৯/২৪)।

    সে মূসা (আঃ)-কে বলেছিল,لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَهاً غَيْرِيْ لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِيْنَ ‘যদি তুমি আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মা‘বূদ হিসাবে গ্রহণ কর তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাকে জেলে ভরব’ (শু‘আরা ২৬/২৯)। তার জাতি এ কথা হাল্কাভাবে নিয়েছিল এবং তার প্রভুত্ব মেনে নিয়েছিল। ইবলীস শয়তানও চায় যে, মানুষ তার ইবাদত করুক এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার কথা মেনে চলুক; আনুগত্য ও ইবাদত কেবল সেই লাভ করুক, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য মোটেও না করা হোক। ফেরা‘ঊন ও ইবলীসের এহেন প্রবণতা বদমায়েশি ও মূর্খতার চূড়ান্ত পর্যায়ভুক্ত। সকল মানুষ ও জিনের অন্তরে এরূপ দাবীর মানসিকতা কিছু না কিছু বিরাজ করে। বান্দা আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য ও হেদায়াত না পেলে তার পক্ষে ফেরাঊন ও ইবলীসের মত একটা কিছু করে ফেলা অসম্ভব নয়।[1]

    ২. আমলের মাঝে একনিষ্ঠতার অভাব দেখা দেয়া : রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রার্থীর চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় আসীন হওয়া এবং বরাবরের মতো তা ধরে রাখা। ফলে তার মিত্রতা-শত্রুতা, দেয়া-না দেয়া, ঘৃণা-ভালবাসা সবকিছুই ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এমতাবস্থায় তার কোন কাজে ইখলাছ বা সদিচ্ছা থাকে না। ফলে সে ধ্বংসশীলদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে পড়ে।

    ৩. ক্ষমতা না পেলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা : ক্ষমতালোভী ব্যক্তি ক্ষমতা না পেলে কাজ না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দানে সে কৃপণতা করে। বরং
    অনেক সময় সে অপর পক্ষ যাতে ব্যর্থ হয় সে আশায় তাকে এড়িয়ে চলে। ব্যর্থ হ’লে সে তার স্থলে নেতৃত্ব দিতে পারবে সেজন্য।

    ৪. লোকের দোষ আলোচনা এবং অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করা : ক্ষমতাপ্রিয় প্রত্যেক ব্যক্তিই অন্যদের দোষ-ত্রুটি সমালোচনা করতে খুব ভালবাসে। সে বুঝাতে চায় পূর্ণ যোগ্যতা কেবল তার মধ্যেই আছে। তার সামনে কেউ অন্যের গুণগান করুক- তা সে মোটেও পসন্দ করে না। যে ক্ষমতার প্রেমে মাতোয়ারা হয় তার নিকট থেকে সৎ গুণগুলো বিদায় নেয়।

    ৫. দ্বীনদারী ও বিদ্যা-বুদ্ধিতে তার থেকে কেউ শ্রেয় আছে বলে সে মানতে নারায : সে অন্যদের যোগ্যতা ও মাহাত্ম্য লুকিয়ে রাখে, তাদের তথ্যাদি জানতে দিতে চায় না- যাতে মানুষ তাদের খোঁজ না পায়। কেননা তারা তাদের কথা জানতে পারলে তাকে ছেড়ে ওদের কাছে চলে যাবে। আবার পারস্পরিক তুলনা করে হয়তো তার মর্যাদা কম গণ্য করতে পারে।

    ৬. ক্ষমতা হারিয়ে গেলে কিংবা কেড়ে নেওয়া হ’লে আফসোস করা : ক্ষমতাই যার ধ্যান ও জ্ঞান তার হাত থেকে যখন ক্ষমতা অন্যের হাতে চলে যায়, তখন তার মন দুঃখ-বেদনায় কাতরাতে থাকে এবং আফসোস-অনুশোচনায় জ্বলে-পুড়ে যায়।

    ৭. জনগণের সামনে দাম্ভিকতা প্রকাশ এবং তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা : মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে একটি কাজের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। (তিনি তাঁকে এক এলাকার গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন।) আমি দায়িত্ব পালন শেষে মদীনায় ফিরে এলে তিনি বললেন, মিকদাদ, সরকারী দায়িত্ব কেমন অনুভব করলে? আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)! আমার কেবলই মনে হয়েছে, সকল মানুষ আমার অধীনস্ত দাস-দাসী। আল্লাহর কসম! আগামীতে আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আর কোন কাজের দায়িত্ব নেব না’।[2]

    ইবনু হিববান বলেন, ‘সুলতান বা ক্ষমতাধরদের নিকট যাদের আনাগোনা ও ওঠাবসার সুযোগ ঘটে তাদের অবশ্য কর্তব্য হ’ল ক্ষমতাসীনের গালিকে গালি মনে না করা, তার কড়া কথা ও ব্যবহারকে কড়া মনে না করা এবং তার অধিকার প্রদানে গড়িমসি করাকে অপরাধ মনে না করা। কেননা তার কথা ও কাজের কঠোরতা ও বাড়াবাড়ির মাঝেই ইয্যত প্রাপ্তির সুযোগ মিলবে’।[3]

    আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, কোন লোক ক্ষমতা লাভ করলে তার অনেক সঙ্গী-সাথী ক্ষমতা লাভের আগে সে তাদের সাথে যেমন আচরণ করত, ক্ষমতা লাভের পরেও তার থেকে তেমন আচরণ প্রত্যাশা করে। কিন্তু তা না পাওয়ার দরুন তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টুটে যায়। এটা ঐ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যাশী সঙ্গীর অজ্ঞতা। সে যেন একজন মাতাল সঙ্গী থেকে তার স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থার সময়কালীন আচরণ কামনা করছে। এটা তো কখনো হবার নয়। কেননা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মাদকের মতই এক প্রকার নেশা, এমনকি তার থেকেও মারাত্মক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যদি নেশাকর না হ’ত তবে এই ক্ষমতার পূজারীরা কখনই চিরস্থায়ী পরকালের বদলে তা গ্রহণ করত না। সুতরাং তার নেশা চা-কফির নেশা থেকেও অনেক অনেক বেশী। আর চরম নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ-সবল মানুষের আচরণ লাভ অসম্ভব।[4] তাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির মহান ব্যক্তিত্ব মূসা (আঃ)-কে মিশরের কিবতী (কপটিক) সম্প্রদায়ের প্রধান নেতা ফেরা‘ঊনের সাথে বিনয়-নম্র ভাষায় সম্ভাষণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন,فَقُوْلاَ لَهُ قَوْلاً لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى ‘তোমরা দু’জন তাকে নরম ভাষায় বুঝাও। হ’তে পারে সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে’ (ত্বা-হা ২০/৪৪)। সুতরাং রাষ্ট্রনায়ক বা ক্ষমতাসীনদের সাথে বিনম্র বচনে কথা বলা শরী‘আত, বিবেক, প্রথা ইত্যাদি সবকিছুরই দাবী। কিন্তু অনেক সময় লোকে তা করে উঠতে পারে না বলে সমস্যা সৃষ্টি হয়’।[5]

    ৮. অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনে আল্লাহর সাহায্য না পাওয়া : ইবনু রজব বলেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতালিপ্সু খুব কম লোকই এমন মেলে যার কাজে-কর্মে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য মেলে। বরং তাকে তার নিজের যিম্মায় সোপর্দ করা হয়। যেমনটা নবী করীম (ছাঃ) আব্দুর রহমান ইবনু সামুরা (রাঃ)-কে বলেছিলেন,يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ، لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا، ‘হে আব্দুর রহমান! তুমি ইমারত বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চেয়ো না। কেননা চাওয়ার দরুন তোমাকে যদি তা দেওয়া হয়, তবে তোমাকে তার নিকট সোপর্দ করা হবে; আর যদি না চাইতে তোমার তা মেলে তাহ’লে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’।[6]

    ইয়াযীদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মাওহিব ছিলেন একজন নেক্কার ও সুবিচারক। তিনি প্রায়শ বলতেন, যে সম্পদ ও সম্মান ভালবাসে, কিন্তু সেজন্য মুছীবতে পড়ার ভয় করে সে তাতে সুবিচার বজায় রাখতে পারে না।

    আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُوْنَ عَلَى الإِمَارَةِ، وَسَتَكُوْنُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَتِ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ ‘অচিরেই তোমরা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব লাভের জন্য অবশ্যই পাগলপারা হয়ে উঠবে। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তা আফসোসের কারণ হবে। তার সূচনা তো কত ভাল, কিন্তু তার পরিণতিটা কত মন্দ’![7]

    ৯. কাফির-মুশরিকদের সাথে সখ্যতা : কাফির-মুশরিকদের সঙ্গে মুসলিম রাজা-বাদশাহদের সখ্যতা ঐতিহাসিকভাবেই সুবিদিত। স্পেনের বাদশাহগণ এমনটা করে তাদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করেছিলেন। বর্তমান যুগে অমুসলিম নাস্তিক মূর্তিপূজকদের সঙ্গে সখ্যতা ও তাদের আদর্শ গ্রহণে প্রতিযোগিতা চলছে। তাদের কোন সংস্থার পদ লাভ, তাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডিগ্রী কিংবা তাদের কোন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের আশায় তারা নিজেদের স্বকীয়তা বিকিয়ে দেয়।

    ১০. সত্য দ্বীন ইসলাম গ্রহণে অনীহা এবং বিদ‘আত ও বাতিল মত অবলম্বন : কবি আবুল আতাহিয়া বলেছেন,
    أخي من عشق الرئاسة خفت أن *يطغى ويحدث بدعة وضلالة
    ‘ভাইয়া আমার, যে কি-না রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রেমে দিওয়ানা তার সম্পর্কে আমার ভয় হয় সে আল্লাহর দেয়া সীমালংঘন করবে অথবা বিদ‘আত ও বাতিল পথ অবলম্বন করবে’।

    আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও জীবিকা দ্বীন গ্রহণের অন্যতম বাধা। আমরা ও আরো অনেকে শাসকদের পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। তাদের সামনে যখন তাদের মতাদর্শ ভ্রান্ত বলে ধরা পড়েছে, তখন তারা বলেছে আমরা যদি ইসলাম গ্রহণ করি তাহ’লে নিম্ন শ্রেণীর মুসলমান বলে গণ্য হব, আমাদের মান-মর্যাদা বলে কিছুই থাকবে না। অথচ দেখ, আমাদের জাতির ধন-সম্পদ, পদ-পদবী সব কিছুর উপর আমরা কর্তৃত্ব করছি, তাদের মাঝে আমাদের মর্যাদা কত উঁচুতে। ফেরাঊন ও তার দলবলের মূসা (আঃ)-এর অনুসরণে এছাড়া আর কোন বাধা ছিল কি’?[8]

    তিনি আরো বলেছেন, মানবকুলে কিছু লোক সব সময়ই বাতিলকে গ্রহণ করে। কিছু লোক তা গ্রহণ করে অজ্ঞতা এবং ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সুধারণা হেতু তার অন্ধঅনুসরণ বশত। আবার কেউ বাতিলকে বাতিল জেনেও অহঙ্কার ও বাড়াবাড়ি বশত তা অবলম্বন করে। কেউবা আবার জীবিকা, পদ কিংবা ক্ষমতার লোভে পড়ে বাতিলকে অাঁকড়ে ধরে। কেউবা হিংসা ও বিদ্বেষবশত তা অবলম্বন করে। অনেকে আবার প্রেম-ভালবাসায় মজে গিয়ে তা গ্রহণ করে। কেউবা আবার ভয়ে এবং কেউবা আরাম-আয়েশে বিভোর হয়ে বাতিলকে বেছে নেয়। সুতরাং কুফর অবলম্বনের কারণ শুধুই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও জীবন-জীবিকার প্রতি ভালবাসা নয়’।[9]

    ১১. রাজা-বাদশাহদের প্রিয়পাত্র হওয়া এবং তাদের সাথে ওঠাবসা করা : ইবনু রজব বলেছেন, যালিম সরকারের নিকট যে বা যারা যাতায়াত করে তাদের বেলায় বড় ভয় যা জাগে তা হ’ল, তাদের মিথ্যা কথাকে এরা সত্য বলে সত্যায়ন করবে এবং তাদের যুলুম-অত্যাচারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। হ’তে পারে সে সাহায্য বাধা না দিয়ে নীরব থাকার মাধ্যমে। কেননা যে সম্মান ও ক্ষমতার মোহে ক্ষমতাধরদের দরবারে যাতায়াত করে, স্বভাবতই সে তাদের কোন কিছুতে নিষেধ করতে যাবে না। বরং অধিকাংশ সময় সে তাদের মন্দ কাজ-কর্ম খুব সুন্দর কাজ বলে আখ্যায়িত করে তাদের নৈকট্য লাভের জন্য। যাতে করে তাদের নিকট তার অবস্থান ভাল হয় এবং তার উদ্দেশ্য সাধনে তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

    কা‘ব ইবনু উজরা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, শীঘ্রই আমার পরে কিছু শাসকের আবির্ভাব ঘটবে। যারা তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করবে আর তাদের মিথ্যাকে সত্য গণ্য করবে এবং তাদের যুলুম-নিপীড়নে সাহায্য-সহযোগিতা করবে তারা না আমার দলভুক্ত থাকবে, না আমি তাদের দলভুক্ত থাকব। তারা (কিয়ামতের দিন) হাওযে কাওছারের তীরে অবতরণ করতে পারবে না। আর যারা তাদের সাথে ওঠা-বসা করবে না, তাদের যুলুম-নির্যাতনে সহযোগিতা করবে না এবং তাদের মিথ্যাকে সত্য গণ্য করবে না তারা আমার দলভুক্ত এবং আমিও তাদের দলভুক্ত। তারা হাওযে কাওছারে অবতরণ করবে’।[10]

    পূর্বসূরিদের অনেকেই এজন্য যারা রাজা-বাদশাহদের সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করতে আগ্রহ প্রকাশ করত তাদেরকে ওদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেই নিষেধ করতেন। এই নিষেধকারীদের মধ্যে রয়েছেন ওমর বিন আব্দুল আযীয, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, সুফিয়ান ছাওরী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেছেন, আমাদের মতে, যে শাসকদের নিকট যায় এবং তাদের আদেশ-নিষেধ করে সে আদেশদাতা ও নিষেধকর্তা নয়; বরং যে তাদের সংস্রব এড়িয়ে চলে সেই আদেশদাতা ও নিষেধকর্তা।

    এর কারণ, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও উঠা-বসায় ফিতনায় জড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। দূর থেকে মনে হয় শাসকদের সে ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করবে, মন্দ কাজের জন্য হম্বি তম্বি করবে। কিন্তু যখন কাছে আসে তখন আর এ সবের কোনটাই হয়ে ওঠে না; বরং মন তাদের দিকে ঝুঁকে যায়। কেননা পদ ও মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা তো মানুষের মনের মাঝে সুপ্ত থাকে। এসব পাবার পথ যখন সে খোলা দেখতে পায় তখন সে শাসকদের আদেশ-নিষেধ না করে বরং তাদের তেল মালিশ ও খয়েরখাঁ গিরি করতে থাকে। এমন করতে গিয়ে এক সময় সে ঐ অন্যায়-অপকর্মকারী যালিম শাসকদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং তাদের ভালবাসতে শুরু করে। বিশেষ করে শাসকরা যদি তার সম্মান দেয় এবং মূল্যায়ন করে তখন তো সে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ তাঁর পিতার উপস্থিতিতে জনৈক শাসকের স্ত্ততি করলে তার পিতা তাউস তাকে এজন্য ধমকান।

    সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) আববাদ ইবনু আববাদকে একটি পত্র লিখেছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, আমীর-উমারার কাছে ঘেঁষা থেকে সাবধান থাকবে। কোন ব্যাপারেই তাদের সাথে মাখামাখি করবে না। তুমি সুপারিশ করলে কাজ হবে। একজন মাযলূম বা নির্যাতিত ব্যক্তি তোমার কথায় রেহাই পাবে কিংবা তুমি কোন যুলুম রোধ করতে সক্ষম- এ জাতীয় কথায় কখনো বিভ্রান্ত হয়ো না। এসবই ইবলীসী ধোঁকা। জ্ঞানপাপীরা এগুলোকে তাদের উন্নতির সিঁড়ি বানায়। তোমার পক্ষে যদি মাসআলা ও ফৎওয়া জিজ্ঞাসার উত্তর না দিয়ে থাকা সম্ভব হয়, তাহ’লে তুমি সেটাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে কর। মুফতী আলেমদের সঙ্গে এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করতে যেয়ো না। আমার কথা মত কাজ হোক, আমার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ুক, আমার কথা শোনা হোক- ইত্যাকার বাসনাকে মনে প্রশ্রয় দেওয়া থেকে খুব সাবধান থেকো। এমনটা যাদের ইচ্ছে, তাদের ইচ্ছের ব্যত্যয় ঘটলে তারা আর সুস্থির থাকে না। আর রাষ্ট্রক্ষমতা প্রীতি থেকে তুমি অবশ্যই দূরে থেকো। কেননা সোনা-রূপা থেকেও লোকদের নিকট রাষ্ট্রক্ষমতার মোহ অনেক বেশী প্রিয়। এ এক অদৃশ্যমান দরজা। শিক্ষিত অভিজ্ঞজনদের ছাড়া কেউ তা দেখতে পায় না। সুতরাং অন্তর দিয়ে সত্যকে তালাশ কর এবং নিয়ত বেঁধে কাজ কর। জেনে রাখ মানুষের সামনে অবস্থা এমন ঘনিয়ে আসছে যে, তাতে সে মরণ বরণ করতে চাইবে। সালাম জানিয়ে এখানেই শেষ করছি’।[11]

    ওহাব বিন মুনাবিবহ বলেছেন, ধন-সম্পদ মজুদ করা এবং শাসকের সাথে উঠা-বসা মানুষের কোন পুণ্য অবশিষ্ট রাখে না। যেমন করে একটা ছাগলের খোয়াড়ে দু’টা ক্ষুধার্ত হিংস্র নেকড়েকে ছেড়ে দিলে তারা একটা ছাগলও আস্ত রাখে না। রাতারাতিই সব সাবাড় করে দেয়।[12]

    আবু হাযেম (রহঃ) বলেছেন, এক সময় আলেমরা শাসকদের থেকে পালিয়ে থাকত, আর তারা তাদের খুঁজে নিত। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আলেমরা শাসকদের দরজায় ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকে আর শাসকরা তাদের দেখা দিতে চায় না।[13]

    ১২. খ্যাতির মোহ:

    ইবনু রজব বলেছেন, বিদ্যা ও কর্মের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল/লাভের চেষ্টা একটি অনভিপ্রেত বিষয়। ব্যক্তির বিদ্যাবুদ্ধি, সাধনা ও দ্বীন-ধার্মিকতা চর্চার মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভের মোহ খুবই গর্হিত বিষয়। অনুরূপভাবে লোকেরা দো‘আ, বরকত লাভের আশায় কিংবা হাতে চুমু খাওয়ার উদ্দেশ্যে দলে দলে তার সাক্ষাতপ্রার্থী হবে বলে সেই লক্ষ্যে কাজ করা, কথা-বার্তা বলা এবং কারামত যাহির করাও গর্হিত কাজ। কিন্তু খ্যাতির মোহে অন্ধজন এসব গর্হিত ও অবাঞ্ছিত কাজ করতে ভালবাসে। নিষ্ঠার সাথে এগুলো করে এবং এসবের উপকরণ যোগাতে চেষ্টা করে। এতেই তার যত আনন্দ। এ কারণেই সালাফে ছালেহীন (পূর্বসূরি সৎকর্মশীল বান্দাগণ) খ্যাতিকে ভীষণভাবে অপসন্দ করতেন। তাঁদের মাঝে রয়েছেন আইয়ূব সাখতিয়ানী, ইবরাহীম নাখঈ, সুফিয়ান ছাওরী, আহমাদ বিন হাম্বল প্রমুখ আল্লাহওয়ালা আলেম এবং ফুযাইল বিন আইয়ায, দাঊদ তাঈ প্রমুখ সাধক ও দরবেশ। তাঁরা খুব করে আত্মনিন্দা করতেন এবং নিজেদের আমল সমূহকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখতেন।[14]

    ১৩. জনতার মুখ থেকে প্রশংসা ও সুখ্যাতি শোনার বাসনা :

    ইবনু রজব বলেছেন, ক্ষমতাবান ও প্রতিপত্তিশালীরা মানুষের মুখ থেকে প্রশংসা ও সুখ্যাতি শুনতে ভালবাসে। তারা জনগণের কাছে তা দাবীও করে। যারা তাদের প্রশংসা করে না তাদেরকে তারা নানাভাবে কষ্ট দেয়। অনেক সময় তারা একাজে এতটাই বাড়াবাড়ি করে বসে যে প্রশংসা থেকে নিন্দাই তাদের বেশী পাওনা হয়ে দাঁড়ায়। আবার কোন কোন সময় তারা তাদের দৃষ্টিতে ভাল কাজ করছে বলে যাহির করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাদের মন্দ অভিপ্রায় কাজ করে। এভাবে মিথ্যাকে সত্যের আবরণে আচ্ছাদিত করতে পেরে তারা উৎফুল্ল হয় এবং লোকদের থেকে প্রশংসা লাভ ও তাদের মাঝে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ার আকাঙ্খা পোষণ করে। এমন লোকদের প্রসঙ্গেই আল্লাহ বলেন,
    لاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوْا وَيُحِبُّونَ أَنْ يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا فَلاَ تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ-
    ‘যেসব লোকেরা তাদের মিথ্যাচারে খুশী হয় এবং তারা যা করেনি, এমন কাজে প্রশংসা পেতে চায়, তুমি ভাব না যে তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। বস্ত্ততঃ তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)।

    এ আয়াত এরূপ বিনাকাজে প্রশংসার জন্য লালায়িতদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ মানবকুল থেকে প্রশংসা তলব করা, প্রশংসা পেয়ে খুশি হওয়া এবং প্রশংসা না করার দরুন শাস্তি দেওয়া কেবলমাত্র লা শরীক আল্লাহর জন্যই মানায়। এজন্যই সৎপথপ্রাপ্ত ইমামগণ তাদের কাজ-কর্মের দরুন তাদের প্রশংসা করতে নিষেধ করতেন। মানুষের কোন কল্যাণ করার জন্য তাদের স্বত-স্ত্ততি করতে দিতেন না; বরং সেজন্য অংশীদার শূন্য এক আল্লাহর প্রশংসা করতে তারা বেশী বেশী উদ্বুদ্ধ করতেন। কেননা সকল প্রকার নে‘মত ও অনুগ্রহের মালিক তো তিনিই।
    খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয এ ব্যাপারে খুবই সংযত ছিলেন। একবার তিনি হজ্জে আগত লোকদের পড়ে শোনানোর জন্য একটি পত্র প্রেরণ করেন। তাতে তিনি তাদের উপকার করতে আদেশ দেন এবং তাদের উপর যে যুলুম-নিপীড়ন জারী ছিল তা বন্ধ করতে বলেন। ঐ পত্রে এও ছিল যে, এসব কল্যাণ প্রাপ্তির দরুন তোমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রশংসা কর না। কেননা তিনি যদি আমাকে আমার নিজের হাতে সোপর্দ করতেন তাহ’লে আমি অন্যদের মতই হ’তাম। তাঁর সঙ্গে সেই মহিলার ঘটনা তো সুপ্রসিদ্ধ, যে তার ইয়াতীম মেয়েদের জন্য খলীফার নিকট ভাতা বরাদ্দের আবেদন জানিয়েছিল। মহিলাটির চারটি মেয়ে ছিল। খলীফা তাদের দু’জনের ভাতা বরাদ্দ করেছিলেন। ঐ মহিলা আল্লাহর প্রশংসা করে। কিছুকাল পর তিনি তৃতীয়জনের জন্য ভাতা নির্ধারণ করেন। এবারও মহিলা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। তার শুকরিয়া প্রকাশের কথা জেনে খলীফা তাকে বলেন, আমরা তাদের জন্য ভাতা বরাদ্দ করতে পেরেছি। আপনার এভাবে প্রশংসার প্রকৃত হকদারের প্রশংসা করার জন্যেই। এখন আপনি ঐ তিনজনকে বলবেন, তারা যেন চতুর্থজনের প্রতি সহমর্মিতা দেখায়। তিনি এর দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন যে, রাষ্ট্রের নির্বাহী পদাধিকারী কেবলই আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নে নিযুক্ত। তিনি আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর আনুগত্যের হুকুমদাতা এবং তাঁর নিষিদ্ধ জিনিসগুলো থেকে নিষেধকারী মাত্র। আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর মাধ্যমে তিনি তাদের কল্যাণকামী। তার বিশেষ চাওয়া-পাওয়া যে, দ্বীন সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে থাক এবং ইয্যত-সম্মান সব আল্লাহর হোক। তারপরও তার সদাই ভয় হ’ত যে, তিনি আল্লাহর হক আদায়ে কতইনা ত্রুটি করে ফেলছেন।[15]

    ১৪. আল্লাহর নামে মিথ্যাচার ও মনগড়া কথা বলা :

    ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, যেসব শিক্ষিত লোক পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয় এবং দুনিয়াকে ভালবাসে তারা নিজেদের ফৎওয়া, আদেশ, বার্তা, বিধি-বিধান জারী করতে আল্লাহ তা‘আলার নামে নাহক কথা বলে। কেননা মহান প্রভুর বিধি-বিধান বহুক্ষেত্রে মানুষের উদ্দেশ্য ও আকাঙ্খার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। বিশেষতঃ রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী এবং খেয়াল-খুশির অনুসারীদের তো তা মোটেই হয় না। তাদের আশা-উদ্দেশ্য তো সত্যের বিরোধিতা এবং তাকে বাধা না দেওয়া অবধি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূরণই হয় না। সুতরাং আলেম ও শাসক যখন ক্ষমতালিপ্সু ও খেয়াল-খুশির অনুসারী হবে, তখন তাদের সে আশা হক বা ন্যায়নীতিকে পদদলিত না করে করায়ত্ব হবে না। বিশেষতঃ যখন সে তার উদ্দেশ্যের পেছনে একটা প্যাঁচঘোচ দাঁড় করাতে পারে, তখন সে ঐ সন্দেহের পথে এগিয়ে যায় এবং খেয়াল-খুশিকে উষ্কে দেয়। ফলে যা ছিল সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত তা ঢাকা পড়ে যায়। আর যদি হক এতটাই স্পষ্ট হয় যে, তাতে কোন রকম কোন অস্পষ্টতা ও সন্দেহের অবকাশ নেই তাহ’লে সে তার বিরোধিতা শুরু করে। মুখে সে বলে, সময়কালে তওবা করলেই মুক্তির রাস্তা খুলে যাবে। এদেরই মত লোকদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন,فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا ‘তাদের পরে এলো তাদের অপদার্থ উত্তরসূরিরা। তারা ছালাত বিনষ্ট করল ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। ফলে তারা অচিরেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’ (মারিয়াম ১৯/৫৯)। তাদের প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন,
    فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُوا الْكِتَابَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَذَا الْأَدْنَى وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِنْ يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مِثْلُهُ يَأْخُذُوهُ أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِمْ مِيثَاقُ الْكِتَابِ أَنْ لَا يَقُولُوا عَلَى اللهِ إِلاَّ الْحَقَّ وَدَرَسُوا مَا فِيهِ وَالدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
    ‘অতঃপর তাদের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত হয় এমনসব অপদার্থ লোক, যারা কিতাবের (তাওরাতের) উত্তরাধিকারী হয়েছে। যার মাধ্যমে তারা তুচ্ছ পার্থিব উপকরণ হাছিল করে (অর্থাৎ ঘুষ খায়) আর বলে যে, আমাদের ক্ষমা করা হবে (কেননা আমরা নবীদের বংশধর ও আল্লাহর প্রিয়পাত্র)। এমনি ধরনের পার্থিব উপকরণ যদি তাদের নিকট পুনরায় আসে, তাহ’লে তারা তা নিয়ে নিবে (অর্থাৎ পুনরায় একই পাপ করবে)। তাদের নিকট থেকে কি তাদের কিতাবে এই অঙ্গীকার নেওয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর নামে সত্য ব্যতীত কিছুই বলবে না? আর সেখানে যা (প্রতিশ্রুতি) লিখিত আছে তাতো তারা পাঠ করেছে। বস্ত্ততঃ আললাহভীরুদের জন্য পরকালের গৃহ উত্তম, তোমরা কি তা বুঝ না’? (আ‘রাফ ৭/১৬৯)।
    আল্লাহ তা‘আলা উক্ত আয়াতে অবগত করছেন যে, প্রবৃত্তির পূজারীরা পার্থিব সম্পদ তাদের জন্য হারামের কথা জেনেও কুক্ষিগত করছে। আর বলছে, আমাদেরকে সামনের দিনে মাফ করে দেওয়া হবে। অনুরূপ হারাম সম্পদ হাতে পেলে তারা আবারও তা গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে তারা সব সময়ে চার হাত-পায়ে খাড়া। তারা বলে, আমাদের এ কথাই আল্লাহর বিধান, আল্লাহর শরী‘আত এবং আল্লাহর দ্বীন। অথচ তারা খুব ভাল করেই জানে যে, আল্লাহর বিধান, শরী‘আত ও দ্বীন-এর উল্টোটা। তারা কি জানে না কোনটা আল্লাহর হুকুম, শরী‘আত ও দ্বীন? ফলত তারা কখনও না জেনে, না বুঝে আল্লাহর নামে মিথ্যা বলে। আবার কখনও বাতিলের কথা জেনে-বুঝে তার নামে মিথ্যা বলে। কিন্তু যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা জানে পরকাল ইহকাল থেকে শ্রেষ্ঠ। তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি ও পাশবিক লালসা তাদেরকে আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে উৎসাহিত করে না। তাদের পন্থা এই যে, তারা কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরবে, ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাইবে। দুনিয়ার নশ্বরতা ও নিকৃষ্টতা নিয়ে ভাববে এবং আখিরাতের সৌভাগ্য ও স্থায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করবে। ঐ দুনিয়াপূজারীরা পাপাচারিতার সাথে সাথে দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আতও উদ্ভাবন করে। ফলে তাদের পাশে দু’টো জিনিস জমা হয়। কেননা খেয়াল-খুশির অনুসরণের ফলে মানুষের দিলের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ফলে সে সুন্নাত ও বিদ‘আতের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। অথবা উল্টো বুঝে বিদ‘আতকে সুন্নাত এবং সুন্নাতকে বিদ‘আত বলে। এটাই আলেমদের বিপদ। তারা যখন দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয় এবং ক্ষমতাপ্রীতি ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তখন তারা উক্ত আচরণই করে। তাই তো আল্লাহ বলেন,
    وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ، وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ-
    ‘আর তুমি তাদেরকে সেই ব্যক্তির কথা শুনিয়ে দাও, যাকে আমরা আমাদের অনেক নিদর্শন (নে‘মত) প্রদান করেছিলাম। কিন্তু সে তা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ সুপথ ছেড়ে বিপথে গিয়েছিল)। ফলে শয়তান তার পিছু নেয় এবং সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’। ‘যদি আমরা চাইতাম তাহ’লে উক্ত নিদর্শনাবলী অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমে অবশ্যই তার মর্যাদা আরও উন্নত করতে পারতাম। কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ল ও স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসারী হ’ল’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫-৭৬)। এই তো মন্দ আলেমের উদাহরণ যে তার ইলমের উল্টো কাজ করে।[16] ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে নেতৃত্বের লোভ একটি।[17]

    ১৫. মন শক্ত হয়ে যাওয়া, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সঙ্গে মনের সম্পর্ক যুক্ত হওয়া এবং আল্লাহর যিকির থেকে বিরত থাকা :

    ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি লালসার ন্যূনতম ক্ষতি এই যে, তা আল্লাহর ভালবাসা ও যিকির থেকে মনকে অন্য দিকে সরিয়ে দেয়। আর যার ধন-সম্পদ, ক্ষমতালিপ্সা তাকে আল্লাহর যিকির থেকে বিমুখ করে দেয়, সে ক্ষতিগ্রস্তদের শ্রেণীভুক্ত। আর মন যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল হয়ে পড়ে, তখন শয়তান সেখানে বাসা বাঁধে এবং যেদিকে খুশি তাকে পরিচালিত করে’।[18]

    ১৬. শত্রুতা এবং পারস্পরিক অনৈক্য সৃষ্টি :

    রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি আগ্রহী ব্যক্তি মানেই প্রতিপক্ষকে অযোগ্য, অথর্ব ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তাকে সে রাজনীতির ময়দান থেকে উৎখাত করতে বা দূরে ঠেলে দিতে চেষ্টা করে। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব ও শত্রুতা। তখন ব্যর্থতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এজন্যই আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَنَازَعُوْا فَتَفْشَلُوْا وَتَذْهَبَ رِيْحُكُمْ ‘আপোষে ঝগড়া করো না। তাহ’লে তোমরা হীনবল হবে ও তোমাদের শক্তি উবে যাবে’ (আনফাল ৮/৪৬)।

    ________________________________________
    [1]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊ ফাতাওয়া ১৪/৩২৩ পৃঃ।
    [2]. মুস্তাদরাকে হাকিম ৩/৩৪৯, হাকিম হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।
    [3]. রাওযাতুল উকালা ওয়া নুযহাতুল ফুযালা, পৃঃ ২৬৭।
    [4]. এজন্যই সরকারী ক্ষমতা লাভকারীদের বিরোধী শক্তির উপর যুলুমের স্টীম-রোলার চালাতে দেখা যায় এবং সরকারী সম্পদ ও জনগণের জান-মাল তছরুফের তারা কোনই পরোয়া করে না। বিনয়-নম্র আচরণের মাধ্যমে হয়তো তাদের পথে আনা যেতে পারে।-অনুবাদক
    [5]. বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ ৩/৬৫২।
    [6]. বুখারী হা/৭১৪৭; মুসলিম হা/১৬৫২।
    [7]. বুখারী হা/৭১৪৮; শারহু হাদীছ মাযেবানে জা‘য়েআনে, পৃঃ ২৯।
    [8]. হিদায়াতুল হায়ারা, পৃঃ ২৩।
    [9]. ঐ, পৃঃ ২৩।
    [10]. তিরমিযী হা/২২৫৯, হাদীছ ছহীহ।
    [11]. শারহু হাদীছ মাযেবানে জা‘য়েআনে, পৃঃ ৬৪-৬৮।
    [12]. জামেউ বায়ানিল ইলম, পৃঃ ২০২।
    [13]. ঐ, পৃঃ ১৯৯।
    [14]. শারহু হাদীছ মাযেবানে জায়ে‘আনে, পৃঃ ৬৮।
    [15]. ঐ, পৃঃ ৪১-৪৩।
    [16]. আল-ফাওয়াইদ, পৃঃ ১০০।
    [17]. মাজমূঊ ফাতাওয়া ১৮/৪৬।
    [18]. উদ্দাতুছ ছাবিরীন, পৃঃ ১৮৬।

    Comment


    • #3
      রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতির কারণ (أسباب حب الرئاسة) :

      পৃথিবীর সকল কাজের পেছনেই কারণ রয়েছে। এটা মহান আল্লাহরই কৌশল ও ব্যবস্থাপনার অংশ। তাই এমন কোন কাজ নেই যার পেছনে কারণ নেই। এই কার্যকারণের কথা যে জানে সে জানে। আর যে জানে না সে জানে না। জানা-অজানা এ বিষয়ের একটি হ’ল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতির রোগ। নিম্নে এ রোগের প্রধান প্রধান কারণ উল্লেখ করা হ’ল।

      ১. অন্যের অধীনতা থেকে মুক্ত থাকার ইচ্ছা :

      রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পেতে ইচ্ছুক ব্যক্তি কখনই চায় না যে তার উপরে কেউ থাকুক। বরং তার একান্ত আগ্রহ হয়ে দাঁড়ায় যে, সেই সকলের জন্য একমাত্র আদেশদাতা ও নিষেধকারী হবে। এজন্যই সে ছোট-বড়, ইতর-ভদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের দিকে লক্ষ্য রাখে এবং ছোট-বড় প্রতিটি কাজে সে হস্তক্ষেপ করে। যা তার অধিকারে পড়ে না।

      ২. ক্ষমতালিপ্সা মনের আবেগ ও কামনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া :

      মানুষ আদেশদাতা ও নিষেধকর্তা হ’তে ভালবাসে। সে আদেশ-নিষেধের মুখোমুখি হ’তে চায় না। মানুষের উপর ক্ষমতা খাটাতে ও তাদের প্রশংসা পেতে সে ভালবাসে। এছাড়া আরো অনেক বিষয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের সাথে সম্পৃক্ত।

      সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন, তুমি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যাপারে যত কম ছাড় দেওয়া দেখতে পাবে, তত কম ছাড় প্রদান আর কোন ক্ষেত্রে দেখতে পাবে না। তুমি দেখতে পাবে কোন ব্যক্তি খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, অর্থ ইত্যাদি বিষয়ে ছাড় দিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হ’লে তা লাভের জন্য সে হামলে পড়ে এবং শত্রুতা শুরু করে দেয়।[1]

      ইউসুফ বিন আসবাত্ব বলেন,الزهد في الرياسة أشد من الزهد في الدنيا ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি আসক্তি থেকে মুক্তি পৃথিবীর প্রতি আসক্তি থেকে মুক্তি অপেক্ষাও অনেক বেশী কঠিন’।[2]
      ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, উচ্চমর্যাদা ও ক্ষমতা লাভের মোহে মানুষের মন যথাসম্ভব পরিপূর্ণ থাকে।[3]

      ইবনু হিববান বলেন যে, মুনতাছির বিন বেলাল আমাকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন,
      بلاء الناس مذ كانوا * إلى أن ةأةي الساعة
      بحب الأمر والنهي * وحب السمع والطاعة
      ‘আমি আদেশ করব এবং নিষেধ করব, আর অন্যেরা তা শুনবে ও মানবে- এমন মানসিকতা সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানুষের উপর মুছীবত রূপে চেপে রয়েছে’।[4]

      ৩. ঈমানী দুর্বলতা:

      মানব মন ঈমান বিবর্জিত হওয়া অথবা তাদের মাঝে ঈমানী দুর্বলতা দেখা দেওয়া পৃথিবীর প্রতি মোহ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। তবে যাদের অন্তর ঈমানে পরিপূর্ণ, ঈমানী শক্তি যাদের মাঝে বেশী ক্রিয়াশীল তারা নশ্বর দুনিয়ার সম্পদের মোহ থেকে বিমুখ। তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মব্যস্ততা কেবল আখেরাতকে ঘিরে। আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لاَ يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ- ‘এটা হচ্ছে আখেরাতের ঘর। আমি এটা তাদের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছি যারা দুনিয়ায় কোন রকম প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় না এবং বিশৃংখলাও সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম তো আল্লাহভীরুদের জন্য রয়েছে’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।

      আল্লামা সা‘দী বলেছেন, তাদের তো (প্রাধান্য লাভের) ইচ্ছাই নেই। সুতরাং পৃথিবীতে আল্লাহর বান্দাদের উপর বড়ত্ব দেখানো, তাদের উপর অহংকার ও সত্যের প্রতি নাক সিটকানোর মত কাজ তারা কেন করবে?[5]

      ৪. আমানত বা দায়িত্ব বহনের ঝুঁকি বুঝে উঠতে না পারা :

      [রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও তার অধীন যে কোন দাপ্তরিক নির্বাহী দায়িত্ব একটি বড় আমানত। এ আমানত ঠিক মত রক্ষা করা যেমন অতীব সম্মানের, তেমনি এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিণামও ভয়াবহ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ সম্পর্কে সচেতন নয়। বরং তারা উদাসীনতা দেখায়।-অনুবাদক] আল্লাহ তা‘আলা মানুষের এহেন আচরণ সম্পর্কে বলেছেন,
      إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولاً-
      ‘অবশ্যই আমরা (এক সময় কুরআনের দায়িত্ব বহনের) আমানত আসমান সমূহ, পৃথিবী এবং পর্বতমালার সামনে তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এবং সবাই ভীত হয়ে পড়েছিল। অবশেষে মানুষ তা বহন করে নিল। নিঃসন্দেহে মানুষ খুবই যালিম এবং (আমানত বহন সম্পর্কে) একান্তই অজ্ঞ’ (আহযাব ৩৩/৭২)।

      عَنْ أَبِىْ أُمَامَةَ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مَا مِنْ رَجُلٍ يَلِى أَمْرَ عَشَرَةٍ فَمَا فَوْقَ ذَلِكَ إِلاَّ أَتَى اللهَ عَزَّ وَجَلَّ مَغْلُوْلاً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَدُهُ إِلَى عُنُقِهِ فَكَّهُ بِرُّهُ أَوْ أَوْبَقَهُ إِثْمُهُ أَوَّلُهَا مَلاَمَةٌ وَأَوْسَطُهَا نَدَامَةٌ وَآخِرُهَا خِزْىٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ-
      ‘আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘এমন কোন ব্যক্তি নেই যে দশ কিংবা তার বেশী লোকের উপর কর্তৃত্ব করে। কিন্তু সে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সামনে তার গলার সাথে স্বীয় হাত শৃঙ্খলিত অবস্থায় উপস্থিত হবে। তার নেকী তাকে মুক্ত করবে অথবা তার গোনাহ তাকে ধ্বংস করবে। ক্ষমতার প্রথম পর্ব ভৎর্সনাযুক্ত, মধ্যপর্ব অনুশোচনাযুক্ত এবং শেষ পর্ব ক্বিয়ামত দিবসে লাঞ্ছনাকর’।[6]

      ৫. কাল্পনিক তৃপ্তি লাভের অনুভূতি :

      ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রীতি, সম্পদের মোহ এবং ক্রোধের উসকানি নেশার অন্তর্ভুক্ত। মানুষের মাঝে যখন এসব চিন্তা শক্তিশালী রূপ নেয়, তখন তাকে নেশায় পেয়ে বসে। এ জিনিসগুলো এজন্য নেশাকর যে, নেশা এমন কঠিন তৃপ্তির সাথে তুলনীয় যা বিবেক-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তৃপ্তির মূলে রয়েছে প্রিয় জিনিস প্রাপ্তির অনুভূতি। সুতরাং যখন ভাল লাগা প্রচন্ড রূপ নেয় এবং প্রেমিকের অনুভূতিও কাম্যবস্ত্ত পাওয়ার জন্য তীব্র হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিবেক এবং ভাল-মন্দের পার্থক্য শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ক্ষমতার মোহ মাদকের মতই নেশায় রূপ নেয়। এক্ষেত্রে বিবেক-বুদ্ধির দুর্বলতা কখনো ক্ষমতা প্রেমিকের মানসিক দুর্বলতার কারণে হ’তে পারে। আবার কখনো উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে হ’তে পারে। আসলে ক্ষমতা, অর্থ, প্রেম, মদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নবীনরা এমনই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যা পুরাতন ও অভ্যস্তদের বেলায় হয় না।[7]

      ৬. দুনিয়াপ্রীতি :

      আব্দুল্লাহ ইবনু ছালেহ বলেন যে, ঈসা বলেছেন, ‘হে কুরআন পাঠক ও বিদ্বানমন্ডলী! জানা-বোঝার পরেও তোমরা কিভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে গেলে? চোখ থাকতেও তোমরা কিভাবে অন্ধ হয়ে গেলে? আসলে নিকৃষ্ট দুনিয়া ও কুৎসিত লালসা তোমাদের এরূপ গোমরাহ ও অন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং দুনিয়ার জন্য তোমাদের দুর্ভোগ আর তোমাদের জন্য দুনিয়ার পরিতাপ’।[8]
      ইবনু রজব বলেছেন, وأصل محبة المال والشرف حب الدنيا وأصل حب الدنيا اتباع الهوى- ‘ধন-সম্পদ ও মান-মর্যাদার লালসার মূলে রয়েছে দুনিয়াপ্রীতি। আর দুনিয়াপ্রীতির মূলে রয়েছে খেয়াল-খুশির পেছনে চলা।

      ওহাব ইবনু মুনাবিবহ বলেছেন, দুনিয়ার মোহ খেয়াল-খুশির অনুসরণের অন্তর্গত। আর দুনিয়ার মোহের মধ্যে রয়েছে ধন-সম্পদ ও মান-মর্যাদা প্রাপ্তির আকর্ষণ ও ভালবাসা। আর ধন-সম্পদ ও মান-মর্যাদার ভালবাসায় হারামকে হালাল করা হয়। দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ জন্ম নেয় অর্থ-সম্পদ ও খেয়াল-খুশির পেছনে ছোটার কারণে। খেয়াল-খুশির অনুসরণই দুনিয়ার প্রতি অনুরাগ এবং অর্থ লালসা ও মর্যাদাপ্রীতির দিকে মানুষকে আহবান জানায়। কিন্তু তাক্বওয়া খেয়াল-খুশির অনুসরণে বাধা দেয় এবং দুনিয়ার ভালবাসার বিরোধিতা করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
      فَأَمَّا مَنْ طَغَى، وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا، فَإِنَّ الْجَحِيْمَ هِيَ الْمَأْوَى، وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى-
      ‘অনন্তর যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে এবং (পরকালের তুলনায়) দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছে অবশ্যই জাহান্নাম হবে তার ঠিকানা। আর যে ব্যক্তি তার মালিকের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করেছে এবং নিজেকে নফসের কামনা-বাসনা থেকে বিরত রেখেছে, অবশ্যই জান্নাত হবে তার ঠিকানা’ (নাযি‘আত ৭৯/৩৭-৪১)।

      এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় জাহান্নামবাসীদের ধন-দৌলত ও ক্ষমতা নিয়ে আক্ষেপের কথা বলেছেন। তিনি বলেন,
      وَأَمَّا مَنْ أُوْتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُوْلُ يَا لَيْتَنِيْ لَمْ أُوْتَ كِتَابِيَهْ، وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِيَهْ، يَا لَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ، مَا أَغْنَى عَنِّيْ مَالِيَهْ، هَلَكَ عَنِّيْ سُلْطَانِيَهْ-
      ‘আর যার আমলনামা সেদিন তার বাম হাতে দেওয়া হবে (দুঃখ ও অপমানে) সে বলতে থাকবে, হায় আফসোস! (আজ যদি) আমাকে কোন আমলনামা না দেওয়া হ’ত। আমি যদি আমার হিসাবের খাতা না জানতাম। হায়! আমার প্রথম মৃত্যুই যদি আমার জন্য চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী হয়ে যেত! হায়! আমার ধন-সম্পদ আজ কোনই কাজে লাগল না। আমার সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আজ নিঃশেষ হয়ে গেল’ (হাক্কাহ ৬৯/২৫-২৯)।[9]

      ইসহাক ইবনু খালাফ বলেছেন, الورع في المنطق أشد منه في الذهب والفضة، والزهد في الرئاسة أشد منه في الذهب والفضة، لأنهما يبذلان في طلب الرئاسة- ‘কথা-বার্তায় সতর্কতা সোনা-রূপার ক্ষেত্রে সতর্কতা থেকেও বেশী কঠিন। আর রাষ্ট্র ক্ষমতার লালসা সোনা-রূপার প্রতি সাবধানতা থেকেও বেশী কঠিন। কেননা সোনা-রূপাতো রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনেই ব্যয় করা হয়’।[10]

      ৭. আত্মম্ভরিতা :

      عن بن عمر قال قال النبى صلى الله عليه وسلم ثلاث مهلكات، وثلاث منجيات، وثلاث كفارات، وثلاث درجات، فأما المهلكات : فشح مطاع وهوى متبع وإعجاب المرء بنفسه. وأما المنجيات : فالعدل في الغضب والرضا والقصد في الفقر والغنى خشية الله في السر والعلانية.
      ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিনটি জিনিস ধ্বংসাত্মক এবং তিনটি জিনিস মুক্তিদাতা, তিনটি জিনিস পাপ মোচক এবং তিনটি জিনিস মর্যাদা বৃদ্ধিকারী। ধ্বংসাত্মক তিনটি হ’ল অনুসরণীয় কৃপণতা, অনুসৃত খেয়ালখুশি এবং আত্মম্ভরিতা। আর মুক্তিদাতা তিনটি হ’ল) রাগ ও শান্ত অবস্থায় ইনছাফ বজায় রাখা, দরিদ্রতা ও ধনাঢ্যতায় মিতব্যয়িতা এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা।[11]

      ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, অন্তরের আরও অনেক ব্যাধি রয়েছে। যেমন লৌকিকতা, অহংকার, আত্মম্ভরিতা, হিংসা, গর্ব, নেতৃত্বের মোহ, যমীনে প্রাধান্য বিস্তার ইত্যাদি। এ সকল রোগ সন্দেহ ও লালসা যোগে সৃষ্ট। কেননা এতে অবশ্যই নষ্ট ভাবনা ও বাতিল ইচ্ছা বর্তমান রয়েছে। যেমন আত্মম্ভরিতা, গর্ব, অহংকার ও গৌরবের মত রোগ নিজেকে বড় ভাবা এবং মানুষের নিকট থেকে শ্রদ্ধা ও প্রশংসা পাওয়ার মানসিকতা থেকে সৃষ্ট। সুতরাং অন্তরের কোন রোগই লালসা অথবা সন্দেহ কিংবা উভয়ের সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত নয়। আবার উল্লিখিত সকল রোগ অজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট। আর অজ্ঞতার ঔষধ হ’ল বিদ্যা।[12]

      রাষ্ট্র ক্ষমতাপ্রীতির প্রতিকার :

      রোগের সাথে সাথে তার ঔষধ বা প্রতিকারের ব্যবস্থা বান্দাদের উপর মহান আল্লাহ তা‘আলার অসীম অনুগ্রহের অন্যতম। কাজেই রাষ্ট্র ক্ষমতাপ্রীতির ক্ষেত্রেও এমনটা প্রযোজ্য। নিম্নে তার কিছু প্রধান প্রধান চিকিৎসা উল্লেখ করা হ’ল।

      ১. আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য খাঁটি মনে কাজ করা:

      ইবনু রজব বলেন, ওয়াহহাব ইবনু মুনাবিবহ মাকহূলের নিকট একটি পত্রে লিখেছিলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও নবী করীম (ছাঃ)-কে ছালাত ও সালাম জানানোর পর তোমাকে বলছি, তুমি তো তোমার প্রকাশ্য বিদ্যা দ্বারা মানব সমাজে বেশ নাম-কাম ও মর্যাদা লাভ করেছ, এখন তোমার অপ্রকাশ্য বিদ্যা দ্বারা আল্লাহর নিকট মর্যাদা ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করো। জেনে রাখ, উল্লিখিত দু’টি অবস্থানের একটি অন্যের জন্য বাধা স্বরূপ’।

      প্রকাশ্য বিদ্যা বলতে এখানে শরী‘আতের বিধি-বিধান, ফাতাওয়া, কিচ্ছা-কাহিনী, ওয়ায-নছীহত ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। এগুলো দ্বারা ঐ বিদ্বান ব্যক্তি মানব সমাজে একটি বিশেষ স্থান ও মর্যাদা তৈরী করতে পারে। পক্ষান্তরে অপ্রকাশ্য বিদ্যা মানুষের অন্তরে গচ্ছিত থাকে। যেমন মহান আল্লাহর পরিচয়, তাঁর ভয়, তাঁকে ভালবাসা, তাঁকে মুরাকাবা বা ধ্যান করা, তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় করা, তাঁর সাথে সাক্ষাতে আগ্রহী হওয়া, তাঁর উপর ভরসা করা, তাঁর ফায়ছালার উপর সন্তুষ্ট থাকা, নশ্বর দুনিয়ার সম্পদকে উপেক্ষা করা, অবিনশ্বর আখিরাতের প্রতি মনোনিবেশ করা ইত্যাদি। এসবই এ ধরনের বিদ্যার মালিককে আল্লাহর নিকট বিশেষ স্থান ও মর্যাদার অধিকারী করে দেয়। কিন্তু দু’টি অবস্থানের একটি অন্যের জন্য বাধা। সুতরাং যে তার প্রকাশ্য বিদ্যা দ্বারা পৃথিবীতে মর্যাদা বা উচ্চাসন চাইবে, তার লক্ষ্য হবে কী করে মানব সমাজে তার সম্মানের মুকুট ধরে রাখা যায়। সে পৃথিবীতে তার সম্মান ধরে রাখতে যা যা করার করবে এবং এ সম্মান কোন সময় চলে যায় তার আশঙ্কায় সে শঙ্কিত থাকবে। কিন্তু এতে করে মহান আল্লাহর নিকট তার কোন মূল্য থাকবে না; বরং আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। এজন্যই জনৈক বিদ্বান বলেছেন, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বদলে যে দুনিয়া গ্রহণ করে তার জন্য বড়ই দুর্ভোগ।[13]

      ২. দায়িত্ব লাভের আবেদন মঞ্জুর না করা :

      عَنْ أَبِى مُوسَى رضى الله عنه قَالَ دَخَلْتُ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَا وَرَجُلاَنِ مِنْ بَنِىْ عَهِّيْ فَقَالَ أَحَدُ الرَّجُلَيْنِ يَا رَسُولَ اللهِ أَمِّرْنَا عَلَى بَعْضِ مَا وَلاَّكَ اللهُ عَزَّوَجَلَّ وَقَالَ الآخَرُ مِثْلَ ذَلِكَ. فَقَالَ إِنَّا وَللهِ لاَ نُوَلِّى عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ، وَلاَ أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ-
      আবু মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি ও আমার চাচার সন্তানদের দু’জন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করি। ঐ দু’জনের একজন বলে বসে, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ আপনাকে যে ক্ষমতা প্রদান করেছেন, তার কোন একটা দায়িত্ব আমাদের দিন। অন্যজনও তার মত বলে ওঠে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা তো এই কাজের দায়িত্ব তাকে দেই না যে তার আবেদন করে এবং তাকে দেই না যে তা পাওয়ার লোভ করে’।[14]

      তাঁর থেকে আরও বর্ণিত আছে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, اتقوا الله فإن أخْوَنَكُمْ عندنا من طلب العمل সাবধান! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। কেননা আমাদের হিসাবে তোমাদের মধ্যকার ঐ লোকই সবচেয়ে বড় খিয়ানতকারী, যে (সরকারী) পদ লাভের আবেদন করে।[15]

      ৩. পরামর্শ গ্রহণ করা :

      রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করবে কি করবে না এ প্রসঙ্গে পরামর্শ করার দু’টি জায়গা রয়েছে।

      প্রথম জায়গা : যখন রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয় কিংবা তা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন হিতাকাঙ্খী সত্যপন্থী লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে যে, সে এ কাজের যোগ্য কি-না?
      عَنْ أَبِى ذَرٍّ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَلاَ تَسْتَعْمِلُنِى؟ قَالَ فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِىْ ثُمَّ قَالَ يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيْفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْىٌ وَنَدَامَةٌ إِلاَّ مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِىْ عَلَيْهِ فِيْهَا-
      আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি আমাকে আমেল বা কর্মকর্তা নিয়োগ করবেন না? তখন তিনি আমার কাঁধে আঘাত করে বললেন, ‘আবু যার তুমি দুর্বল মানুষ। আর (রাষ্ট্রীয়) পদ একটি আমানত। ক্বিয়ামতের দিন এ আমানত অপমান ও অনুশোচনার কারণ হবে। কেবল তারাই রক্ষা পাবে, যারা যথাযথভাবে আমানত রক্ষা করবে এবং স্বীয় কর্তব্য পালন করবে’।[16]

      অন্য বর্ণনায় এসেছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, يَا أَبَا ذَرٍّ إِنِّى أَرَاكَ ضَعِيفًا وَإِنِّى أُحِبُّ لَكَ مَا أُحِبُّ لِنَفْسِى لاَ تَأَمَّرَنَّ عَلَى اثْنَيْنِ وَلاَ تَوَلَّيَنَّ مَالَ يَتِيمٍ ‘আবু যার! আমার নযরে তুমি একজন দুর্বল মানুষ। আর আমি নিজের জন্য যা ভালবাসি তা তোমার জন্যও ভালবাসি। তুমি কখনই দু’জন লোকেরও শাসক হ’তে যেও না এবং কখনই ইয়াতীমের মালের অভিভাবকত্ব করো না’।[17]

      ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবু যার (রাঃ)-কে শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন। কেননা তিনি তাকে দুর্বল মনে করেছিলেন। অথচ তিনি নিজে তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন,مَا أَظَلَّتِ الْخَضْرَاءُ وَلاَ أَقَلَّتِ الْغَبْرَاءُ أَصْدَقَ مِنْ أَبِىْ ذَرٍّ- ‘আকাশের নীচে মাটির উপরে আবু যার থেকে অধিক সত্যভাষী আর কেউ নেই’।[18]
      দ্বিতীয় জায়গা : রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর পরামর্শ গ্রহণ করা। যাতে করে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি স্বৈরাচারী না হয়ে যায় এবং তার চিন্তা-চেতনাকে সে তীক্ষ্ণ করতে পারে। আল্লাহ বলেন, وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ‘আর কাজে-কর্মে তাদের পরামর্শ গ্রহণ কর’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।

      ৪. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার খারাপ ফল স্মরণ করা :

      ইবনু হিববান বলেছেন, ‘দেশ ও জাতির নেতার দুশ্চিন্তা সবার চেয়ে বেশী। তার দুঃখের মাত্রা সর্বাধিক। তাকেই সবচেয়ে বেশী ব্যস্তমনা থাকতে হয়। তার বদনামও দেশজোড়া। শত্রুর সংখ্যা তার সবার উপরে পেরেশানীও তাকে বেশী পেয়ে বসে। বিব্রতকর পরিস্থিতিও তাকে বেশী সামলাতে হয়। ক্বিয়ামতে তাকেই সবচেয়ে বেশী হিসাব দিতে হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা মাফ না করলে সেই ক্বিয়ামতে কঠিন আযাব ভোগ করবে’।[19]

      ইবনু রজব বলেছেন, ‘মানুষের কোন ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। কাজেই অস্থায়ী ও বিচ্ছিন্ন ক্ষমতা যা আগামী দিনে তার মালিকের জন্য আফসোস, অনুশোচনা, অপমান, লাঞ্ছনা ও অপদস্থতা বয়ে আনবে তার ভাবনাই ক্ষমতা লাভের চিন্তা থেকে মানুষকে দূরে রাখতে পারে।

      এভাবে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার অনেক উপায় ভেবে বের করা যায়। যেমন, যে মানুষ পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা লাভের পর শাসনকেন্দ্রিক ইসলাম নির্দেশিত দায়িত্ব পালন করে না, ক্বিয়ামতে তার ভয়াবহ পরিণতি কী হবে তা ভাবা যেতে পারে। আবার পৃথিবীতেও অত্যাচারী, স্বৈরাচারী, অহঙ্কারী শাসকদের পরিণতি লক্ষ্য করা যেতে পারে।
      عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِىْ صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَيُسَاقُوْنَ إِلَى سِجْنٍ فِىْ جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُوْلَسَ تَعْلُوْهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِيْنَةِ الْخَبَالِ-
      আমর ইবনু শু‘আইব কর্তৃক তার পিতা হ’তে তিনি তার দাদা হ’তে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামত দিবসে অহঙ্কারীদেরকে পিঁপড়ার মত ক্ষুদ্র করে মানুষের আকৃতিতে তোলা হবে। চারদিক থেকে অপমান তাদের ঘিরে ধরবে। তারপর তদেরকে জাহান্নামের একটি জেলখানার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যার নাম বুলাস। আগুন তাদের ঘিরে ধরবে। জাহান্নামীদের রক্ত, পুঁজ তাদের পান করতে দেওয়া হবে’।[20]

      এক ব্যক্তি ওমর (রাঃ)-এর নিকট জনগণের মাঝে কিচ্ছা-কাহিনী বলে বেড়ানোর অনুমতি চাইল। তিনি তাকে বললেন, আমার ভয় হয় যে, তুমি তাদের মাঝে কিচ্ছা বা ইতিহাস বলতে গিয়ে নিজেকে তাদের থেকে বড় মনে করবে। তারপর ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে তাদের পায়ের তলা দিয়ে পিষবেন।[21]

      ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, পৃথিবীতে ক্ষমতাধর শাসকরা তাদের ক্ষমতা লাভে সাহায্যকারীদের প্রতি অনুগত দাস হয়ে থাকে। তাদের নেতা ও গণ্যমান্য মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তারা তাদের অধীনস্ত সহযোগীদের সহযোগিতা আশা করে এবং অসহযোগিতার ভয়ে ভীত থাকে। এ কারণে তাদের জন্য তারা অর্থকড়ি, রাষ্ট্রীয় পদ ও সুযোগ-সুবিধা ব্যয় করে। তাদের সকল দোষ ও অপরাধ তারা মাফ করে দেয়। যাতে তাদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও সহযোগিতা বজায় থাকে। সুতরাং খোলা চোখে তাদের রাষ্ট্র প্রধান ও মহামান্য মনে হ’লেও প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের অনুগত দাস ছাড়া কিছু নয়।

      মোটকথা, শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা একে অপরের দাস। তারা উভয়েই আল্লাহর প্রকৃত ইবাদত বর্জনকারী। তারা যেহেতু যমীনের বুকে নাহকভাবে ক্ষমতা লাভে একে অপরের সহযোগী তাই উভয় পক্ষই অশ্লীল কাজে কিংবা চুরি-ডাকাতিতে পরস্পর সাহায্যকারীর মত। ফলে উভয় শ্রেণীই খেয়াল-খুশির দাসত্ব করতে গিয়ে পরস্পরের দাস হয়ে যায়।[22]

      ৫. সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা, তওবা ও আত্মসমালোচনা করতে থাকা :

      ইবনু হিববান বলেছেন, যে মুসলমানদের শাসনকাজের দায়িত্ব বহন করে প্রতি মুহূর্তে তার আল্লাহর নিকট ধর্ণা দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। যাতে ক্ষমতার ব্যাপারে তার কোন বাড়াবাড়ি হয়ে না যায়। সে আল্লাহর বড়ত্ব, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির কথা স্মরণ করবে। আল্লাহ্ই তো যালিমের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী এবং নেককারদের প্রতিদান প্রদানকারী। সুতরাং শাসক তার কাজে অবশ্যই এমন আচরণ করবে, যাতে তার ইহলোক-পরলোক সবলোকেই কল্যাণ হয়। সে যেন তার পূর্ববর্তী শাসকদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। কেননা সে যে দায়িত্ব পেয়েছে সেজন্য অবশ্যই তাকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে। একইভাবে এজন্য তাকে ক্বিয়ামতে অবশ্যই আল্লাহর দরবারে হিসাব দিতে হবে।[23]

      ৬. বিদ্যা চর্চায় ব্যস্ত থাকা, কোন সময় তা বন্ধ করে না দেওয়া :

      ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন,تَفَقَّهُوْا قَبْلَ أَنْ تُسَوَّدُوْا ‘নেতা হওয়ার আগে তোমরা বিদ্যা অর্জন কর’। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, নেতা হওয়ার পরেও তোমরা বিদ্যা অর্জন করতে থাক। নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ তো বৃদ্ধ বয়সে বিদ্যা শিখেছেন।[24]

      হাসান বিন মানছূর আল-জাচ্ছাছ বলেন, আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কত বছর পর্যন্ত একজন মানুষ লেখা পড়া শিখবে? তিনি বললেন, মৃত্যু পর্যন্ত।[25]

      ৭. দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হয়ে আখেরাতের প্রতি আসক্ত হওয়া এবং আখেরাতের কাজে প্রতিযোগিতা করা :

      ইবনু রজব বলেছেন, জেনে রাখ মানুষের মন সমকালীন সকল মানুষের উপর উঠতে ও তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে ভালবাসে। এখান থেকেই উৎপত্তি ঘটে অহঙ্কার ও হিংসার। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ স্থায়ী উচ্চতা লাভের চেষ্টা চালিয়ে যায়। যাতে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি, নৈকট্য ও সাহচর্য। নশ্বর ও অস্থায়ী উচ্চতায় তার কোনই আগ্রহ থাকে না। যার পেছনে থাকে আল্লাহর অসন্তোষ, ক্রোধ তার থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং মানুষের অবনতি। এই দ্বিতীয় প্রকার উচ্চতারই নিন্দা করা হয়েছে। এ উচ্চতা অবাধ্যতামূলক এবং ভূপৃষ্ঠে নাহকভাবে অহংকার প্রদর্শন মাত্র।
      পক্ষান্তরে প্রথম প্রকার উচ্চতা লাভের জন্য লোভ করা প্রশংসার যোগ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَفِيْ ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُوْنَ ‘এতে বিজয়ী হওয়ার জন্য সকল প্রতিযোগী যেন প্রতিযোগিতা করে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/২৬)।[26]

      ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, দুনিয়া বিষয়টাই তুচ্ছ। তার বড়ও ছোট। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং ধন-সম্পদ লাভ। আর রাষ্ট্রের কর্ণধারের চূড়ান্ত লক্ষ্য ফেরাঊনের মত (খোদায়ী দাবী) যাকে কিনা প্রতিশোধ স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন এবং সম্পদশালীর লক্ষ্য কারূনের মত হওয়া। তাকে আল্লাহ মাটির নীচে পুঁতে দেবেছিলেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির নীচে যেতে থাকবে।[27]

      ৮. রাষ্ট্রক্ষমতা ত্যাগের বদলে আল্লাহ যে নে‘মত দেবেন তা নিয়ে চিন্তা করা :

      ইবনু রজব বলেছেন, মহান আল্লাহ তাঁর আধ্যাত্মিক সাধক বান্দাদেরকে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সম্পদ ও মর্যাদার বদলে দুনিয়াতেই তাক্বওয়া ও আধ্যাত্মিক শক্তি দান করেন। যার ফলে অন্য সব মানুষ তাদের সমীহ করে চলে। এতো গেল তাদের বাইরের দিক, আর ভিতর দিক থেকে আল্লাহর মা‘রেফাত, ঈমান ও আনুগত্যের মজা উপভোগ করেন। এটাই সেই পবিত্র জীবন যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নর-নারীকে দিয়েছেন। এ জীবনের স্বাদ দুনিয়াতে কোন রাজা-বাদশাহ ও রাষ্ট্রীয় পদাধিকারীরা কখনো পায়নি। এজন্যই ইবরাহীম ইবনু আদহাম (রহঃ) বলেছেন, لو يعلم الملوك وأبناء الملوك ما نحن فيه لجالدونا عليه بالسيوف-‘রাজা-বাদশাহ ও তাদের সন্তানেরা যদি আমরা কী মজা ও সুখে-শান্তিতে আছি তা জানত, তাহ’লে তারা তা লাভের জন্য তলোয়ার নিয়ে আমাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হ’ত।[28]


      ________________________________________
      [1]. আবু নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া ৭/৩৯।
      [2]. ঐ, ৮/২৩৮।
      [3]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊ ফাতাওয়া ৮/২১৮।
      [4]. রাওযাতুল উকালা ওয়া নুযাহাতুল ফুযালা, পৃঃ ২৭৩।
      [5]. তাফসীরে সা‘দী, পৃঃ ৬২৪।
      [6]. আহমাদ হা/২২৩৫৪। আলবানী বলেছেন এর সনদ জাইয়িদ। দ্রঃ সিলসিলা ছহীহা হা/৩৪৯।
      [7]. আল-ইস্তিক্বামাত ২/১৪৬।
      [8]. জামেউ বায়ানিল ইলম ১/২৩৩।
      [9]. শারহু হাদীছ মাযেবানে জায়ে‘আনে, পৃঃ ৭১।
      [10]. ইবনুল ত্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ২/২২।
      [11]. ত্বাবারানী হা/৫৭৫৪। আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন, ছহীহাহ হা/১৮০২।
      [12]. ইবনুল কাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ ১/১১১।
      [13]. শারহু হাদীছ মাযেবানে জায়ে‘আনে, ৮০ পৃঃ।
      [14]. বুখারী হা/৭১৪৯।
      [15]. ত্বাবারাণী। আলবানী একে হাসান বলেছেন। দ্রঃ ছহীহুল জামে হা/১০৩।
      [16]. মুসলিম হা/১৮২৫।
      [17]. ঐ হা/১৮২৬।
      [18]. তিরমিযী হা/৩৮০১। আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। ইবনু তায়মিয়া, আস-সিয়াসাতুশ শারঈয়াহ পৃঃ ১৬।
      [19]. রাওযাতুল উকালা ওয়া নুযহাতুল ফুযালা, পৃঃ ২৭৫।
      [20]. তিরমিযী হা/২৪৯২। তিনি হাদীছটিকে হাসান ছহীহ বলেছেন।
      [21]. শারহু হাদীছ মাযেবালে জায়ে‘আনে, পৃঃ ৭৩-৭৫।
      [22]. আল-ফাতাওয়া ১০/১৮৯।
      [23]. রাওযাতুল উকালা ওয়া নুযহাতুল ফুযালা, পৃঃ ২৭৭।
      [24]. বুখারী তালীকান ১/৩৯।
      [25]. ত্বাবাকাতুল হানাবিলাহ ১/১৪০।
      [26]. শারহু হাদীছ মাযেবানে জায়ে‘আনে, পৃঃ ৭২।
      [27]. মাজমূউ ফাতাওয়া ২৮/৬১৫ পৃঃ।
      [28]. শারহু হাদীছ মাযেবালে জায়ে‘আনে, পৃঃ ৭৬।

      ============================


      ৯. মানুষের লক্ষ্য হবে দ্বীনের খেদমত এবং সর্বাবস্থায় সৃষ্টির কল্যাণ সাধন করা :

      عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ وَعَبْدُ الْخَمِيصَةِ، إِنْ أُعْطِىَ رَضِىَ، وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ، تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيكَ فَلاَ انْتَقَشَ، طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِى سَبِيلِ اللهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ، إِنْ كَانَ فِى الْحِرَاسَةِ كَانَ فِى الْحِرَاسَةِ، وَإِنْ كَانَ فِى السَّاقَةِ كَانَ فِى السَّاقَةِ، إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ-
      আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘দীনারের দাস ধ্বংস হোক, দিরহামের দাস ধ্বংস হোক, রেশমী বস্ত্রের দাস ধ্বংস হোক। তাকে দেওয়া হ’লে সে খুশী হয়। আর না দেওয়া হ’লে নাখোশ হয়। সে ধ্বংস হোক, ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তার পায়ে কাঁটা ফুটলে তা বের করা না যাক। সুখময় হোক সেই মানুষের জীবন, যে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার মাথার চুলগুলো হয়ে যায় আলু থালু, আর পা দু’টো হয়ে যায় ধূলিমাখা। যদি সে নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকে তো সেই দলেই থাকে, আবার পশ্চাৎবাহিনীতে থাকে তো পশ্চাৎবাহিনীতেই থাকে। (সে এতটাই অখ্যাত যে) সে কোন কিছুর অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় না এবং কোন সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গৃহীত হয় না’।[1]

      ইবনু হাজার বলেছেন, ‘যদি নিরাপত্তারক্ষী দলে প্রয়োজন বেশী দেখা দেয় তাহ’লে সে সেখানে কাজ করে। আর যদি পশ্চাৎ বাহিনীতে প্রয়োজন বেশী পড়ে তো সে সেখানে কাজে লেগে যায়’।
      ইবনুল জাওযী বলেছেন, إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ কথাটির অর্থ সে অখ্যাত-অজ্ঞাত মানুষ। কোন সময় সে বড় বা উঁচু পদ চায় না। সুতরাং তাকে সফর করতে বলা হলে, সফর করে। অর্থাৎ যখন যে কাজের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সে সে কাজ করতে শুরু করে। অতএব যেন সে বলে, যদি নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকা প্রয়োজন হয়, তো আমি নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকব। আর যদি পশ্চাৎবাহিনীতে থাকার প্রয়োজন হয়, তো আমি সেখানেই অবস্থান করব। রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী, إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ ‘এ কথার মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রীতি, খ্যাতি লাভের মানসিকতা পরিত্যাগ করা এবং অখ্যাতি ও বিনয়-নম্র জীবনের মাহাত্ম্য ফুটে উঠেছে’।[2]

      ১০. রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করতে চেষ্টা করা :

      عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَسْتَرْعِى اللهُ عَبْداً رَعِيَّةً قَلَّتْ أَوْ كَثُرَتْ إِلاَّ سَأَلَهُ اللهُ عَنْهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَقَامَ فِيهِمْ أَمْرَ اللهِ أَمْ أَضَاعَهُ حَتَّى يَسْأَلَهُ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ خَاصَّةً-
      ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা কোন বান্দাকে কোন জাতির- চাই তাদের সংখ্যা কম হোক কিংবা বেশী হোক শাসক বানালে ক্বিয়ামতের দিন তিনি অবশ্যই তাকে তাদের সম্পর্কে একথা জিজ্ঞেস করবেন যে, সে কি তাদের মধ্যে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করেছিল, না করেনি? এমনিভাবে শেষ পর্যন্ত তিনি তাকে বিশেষভাবে তার বাড়ীর লোকদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন’।[3]

      আওফ ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (ছাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে) বলেন, إن شئتم أنبأتكم عن الإمارة وما هي؟ أولها ملامة وثانيها ندامة وثالثها عذاب يوم القيامة إلا من عدل ‘তোমরা চাইলে আমি তোমাদেরকে রাষ্ট্রনায়কের প্রদত্ত দায়িত্ব ও তার অবস্থা বর্ণনা করতে পারি। এ পদের প্রথমে রয়েছে তিরষ্কার। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে অনুশোচনা এবং তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ক্বিয়ামত দিবসের মহাশাস্তি। তবে যে ইনছাফ বা ন্যায়নীতি অবলম্বন করবে সে এসব থেকে রেহাই পাবে’।[4]
      আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَيَتَمَنَّيَنَّ أَقْوَامٌ وُلُّوْا هَذَا الأَمْرَ أَنَّهُمْ خَرُّوْا مِنَ الثُّرَيَّا وَأَنَّهُمْ لَمْ يَلُوْا شَيْئاً ‘শাসকের দায়িত্ব পালনকারী বহু মানুষ (ক্বিয়ামত দিবসে) এই কামনা করবে যে, শাসকের কিছুমাত্র দায়িত্ব পালন না করার জন্য যদি তাদের সপ্তর্ষিমন্ডল থেকেও নীচে ফেলে দেওয়া হয়। তাহ’লে সেটাও তাদের জন্য অনেক ভাল’।[5]

      ১১. ব্যক্তির নিজের মর্যাদা জানা :

      ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি যদি নিজের মর্যাদা বা যোগ্যতা যাচাই করতে পারে, তাহ’লে সে বুঝতে পারবে যে, এই কাজের ভার বহনের ক্ষমতা তার আছে কি-না? যদি সে বুঝতে পারে যে, সে এ দায়িত্ব পালনের যোগ্য নয়, তাহ’লে সে অগ্রসর হবে না।
      عَنْ أَبِى ذَرٍّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَا أَبَا ذَرٍّ إِنِّى أَرَاكَ ضَعِيفًا وَإِنِّى أُحِبُّ لَكَ مَا أُحِبُّ لِنَفْسِى لاَ تَأَمَّرَنَّ عَلَى اثْنَيْنِ وَلاَ تَوَلَّيَنَّ مَالَ يَتِيْمٍ-
      আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘হে আবু যার! আমার দৃষ্টিতে তুমি একজন দুর্বল মানুষ। আর আমি তোমার জন্য ভালবাসি, যা নিজের জন্য ভালবাসি। সুতরাং তুমি কখনই দু’জন লোকেরও নেতা বা শাসক হয়ো না এবং কখনই ইয়াতীমের মালের তত্ত্বাবধায়ক হয়ো না’।[6]

      ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেছেন, এখানে দুর্বল অর্থ আমীরের উপর জনগণের জাগতিক ও দ্বীনী কল্যাণমূলক যে যে দায়িত্ব রয়েছে তা পালন সম্পর্কিত দুর্বলতা। তাঁর এ দুর্বলতার কারণ দুনিয়ার প্রতি তাঁর অনাসক্তি এবং ইবাদত-বন্দেগীতে অধিক মনোনিবেশ। এ ধরনের লোক জনকল্যাণ ও দুনিয়ার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হ’তে পারে না। অথচ এই দু’টি জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণের উপর দ্বীন ইসলামের কার্যকারিতা (বহুলাংশে) নির্ভর করে। নবী করীম (ছাঃ) যখন তাঁর এ অবস্থা জানলেন তখন তাঁকে নছীহত করলেন এবং নিষেধ করলেন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ও ইয়াতীমের মালের তত্ত্বাবধান করতে।[7]

      ১২. শাসক নিজে আল্লাহর অধিক প্রশংসা ও গুণগান করবেন এবং অন্যদেরও তা করতে আদেশ দিবেন :

      ইবনু রজব বলেছেন, রাসূলগণের খলীফাগণ এবং তাঁদের অধীনস্থ ন্যায়পরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিচারকমন্ডলী কখনই নিজেদের সম্মান-ইয্যত করার দাবী করতেন না। বরং মানুষ যাতে এক আল্লাহর তা‘যীম করে; একমাত্র তাঁরই ইবাদত-বন্দেগী করে সে দাবীই জানাতেন। বরং অনেকে তো কেবলমাত্র আল্লাহর দিকে আহবান জানাতে সহযোগিতা লাভের মানসে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করতেন।
      কোন কোন ন্যায়পরায়ণ লোক বিচারকের পদ গ্রহণ করতেন এবং বলতেন, আমি কেন বিচারকের পদ গ্রহণ করব না? আমি তো এ পদের দ্বারা সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধে সাহায্য করতে পারি।
      এ কারণে রাসূলগণ ও তাঁদের অনুসারীরা আল্লাহর রাস্তায় মানুষকে আহবান জানাতে সকল প্রকার কষ্টে ধৈর্যধারণ করতেন। তাঁরা আল্লাহর বিধানাবলী বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানুষের দেওয়া সীমাহীন কষ্ট বরদাশত করতেন এবং তারা ধৈর্যধারণ করতেন। বরং তাতে তাঁরা খুশীই হ’তেন। প্রেমিক তো প্রেমাস্পদের সন্তোষ লাভ করতে গিয়ে যে কষ্ট পায় তাতে সে মজাই উপভোগ করে। যেমনটা ওমর ইবনু আব্দুল আযীয তাঁর খিলাফতকালে আল্লাহর অধিকার ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হন তখন তাঁর পুত্র আব্দুল মালিক তাঁকে বলেন, ‘আববু, আমার মন চাই যে, আল্লাহর ভালবাসায় আমি ও আপনি ডেগচিতে সিদ্ধ হই’। [অর্থাৎ আল্লাহর জন্য আগুনে পোড়ার মত কষ্টও সহ্য করি। আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে নানাবিধ বাঁধার মুকাবিলা করতে গিয়ে তিনি এমনটা বলেছিলেন]।[8]

      ১৩. নিজের পদ ও সুনাম-সুখ্যাতিকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা :

      আর সেটা মুখাপেক্ষী মানুষদের জন্য সুপারিশ এবং তাদের প্রয়োজন পূরণের চেষ্টার মাধ্যমে। ইবনু আবু ইয়া‘লা বলেন, আবু মুযাহিম মূসা ইবনু ওবায়দুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে খাক্বান বলেছেন যে, আমাকে আমার পিতা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি হাসান ইবনু সাহলের নিকট উপস্থিত ছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি এসে তার একটি প্রয়োজন পূরণার্থে হাসানকে সুপারিশ করতে বলল। হাসান তার প্রয়োজন পূরণ করলেন। লোকটি তখন তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেল। তখন হাসান ইবনু সাহল তাকে বললেন, কি জন্য তুমি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছ? আমরা তো মনে করি পদ-পদবীর যাকাত রয়েছে। যেমন করে অর্থ-কড়ির যাকাত রয়েছে। তারপর তিনি আবৃত্তি করলেন,
      فرضت علي زكاة ما ملكت يدي * وزكاة جاهي أن أعين وأشفعا
      فإذا ملكت فجد فإن لم تستطع * فاجهد بوسعك كله أن تنفعا
      ‘আমার সম্পদে আমার উপর যাকাত ফরয করা হয়েছে। অন্যদিকে আমার পদের যাকাত হ’ল অন্যের সহযোগিতা ও সুপারিশ করা। সুতরাং তুমি যখন রাজা-বাদশাহ হবে তখন দান করবে। তা না পারলে তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বতোভাবে অন্যের উপকার করতে চেষ্টা করবে’।[9]

      ১৪. আল্লাহ বান্দার অন্তরে পদের প্রতি যে ভালবাসা সৃষ্টি করেছেন তা সঠিক ক্ষেত্রে ব্যয় করা :

      আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, পদের ক্ষমতা কাজে লাগানোর যথার্থ স্থান রয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহর বিধি-বিধান ব্যস্তবায়নে কাজ করা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, অত্যাচারিত ব্যক্তির সহযোগিতা, দুর্বলদের সাহায্য করা, আল্লাহর শত্রুদের উৎখাত করা ইত্যাদি। এরূপ হ’লে রাষ্ট্রক্ষমতা ও পদ প্রীতি ইবাদত বলে গণ্য হবে।[10]

      ১৫. পূর্বসূরি নেককারদের জীবনী অধ্যয়ন ও শিক্ষা গ্রহণ :

      আমের ইবনু সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) তাঁর উটের পাল চরাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর ছেলে ওমর তাঁর কাছে আসল। তাকে দেখে সা‘দ বলে উঠলেন, এই আরোহীর অনিষ্টতা থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি। সে বাহন থেকে নেমে বলল, আপনি ছাগল, উট নিয়ে পড়ে আছেন। আর জনগণকে ছেড়ে দিয়েছেন, যারা রাষ্ট্র নিয়ে ঝগড়া করছে? সা‘দ (রাঃ) তার বুকে তখন করাঘাত করে বললেন, চুপ কর। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْعَبْدَ التَّقِىَّ الْغَنِىَّ الْخَفِىَّ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সেই বান্দাকে ভালবাসেন, যে পরহেযগার, ধনী এবং নির্ঝন্ঝাট জীবন যাপন করে’।[11]

      ইমাম নববী (এ হাদীছের ব্যাখ্যায়) বলেছেন, এখানে ঐশ্বর্য বলতে মনের ঐশ্বর্যকে বুঝানো হয়েছে। এই ঐশ্বর্যই কাম্য। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ অর্থাৎ ‘মনের প্রাচুর্যই আসল প্রাচুর্য’।[12] আর الخفي শব্দের অর্থ অপরিচিত, অজ্ঞাত মানুষ যে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল আল্লাহর ইবাদতে এবং নিজের ব্যক্তিগত কাজকর্মে মশগূল থাকে।[13]

      কখনও কেউ বড় কোন কল্যাণার্থে নিজে পদত্যাগ করেন এবং অন্যকে পদ লাভের সুযোগ করে দেন। যেমন হাসান ইবনু আলী (রাঃ) খিলাফতের দাবী মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর অনুকূলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এক ভবিষ্যদ্বাণীতে নবী করীম (ছাঃ) এজন্য তার প্রশংসা করে গিয়েছেন।
      عَنْ أَبِيْ بَكْرَةَ قَال رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى الْمِنْبَرِ وَالْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ إِلَى جَنْبِهِ، وَهْوَ يُقْبِلُ عَلَى النَّاسِ مَرَّةً وَعَلَيْهِ أُخْرَى وَيَقُولُ إِنَّ ابْنِى هَذَا سَيِّدٌ، وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ-
      আবু বাকরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মিম্বরের উপর দেখেছি। এমতাবস্থায় হাসান ইবনু আলী তার পাশে ছিলেন। একবার তিনি জনতার দিকে তাকাচ্ছিলেন, আরেকবার তার দিকে। এমতাবস্থায় তিনি বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমার এই পুত্র একজন নেতা। সম্ভবতঃ আল্লাহ তার মাধ্যমে মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে সমঝোতা করে দিবেন’।[14]
      আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেছেন, এটি নবী করীম (ছাঃ)-এর একটি বড় মু‘জিযা। তিনি যেমনটা বলে গিয়েছিলেন, তেমনই ঘটেছিল।[15]
      পূর্বসুরি নেককারদের কেউ কেউ তার থেকে উপযুক্ত কাউকে দেখলে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া থেকে বহু বহু দূরে রাখতেন। যেমন আবুবকর (রাঃ)-এর খলীফা হওয়া এবং ছাহাবীদের তাঁর হাতে বায়‘আত হওয়ার ঘটনার মধ্যে এর বড় প্রমাণ রয়েছে।

      ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আবুবকর (রাঃ) ভাষণ দিলেন। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য খলীফা হিসাবে এই দু’জনকে পসন্দ করছি। তোমরা তাদের যাকে পসন্দ কর তার হাতে বায়‘আত কর। তিনি আমার ও আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ-এর হাত ধরলেন। এর আগে তিনি আমাদের (দু’জনের) মাঝে বসা ছিলেন। তিনি যদি এ কথা বাদে অন্য কিছু বলতেন তাহ’লে হয়ত আমার তা অপসন্দ হ’ত না। আল্লাহর কসম! যে জাতির মধ্যে আবুবকর রয়েছেন সেই জাতির আমীর বা রাষ্ট্রপ্রধান আমাকে নির্বাচন করার তুলনায় যদি আমার গর্দানও কাটা যায় আর তাতে আমার কোন পাপ না হয়, তবে সেটাই আমার নিকট সবচেয়ে ভাল লাগত।[16]

      এমনই আরেকটি ঘটনা- ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) যখন খলীফার আসনে আসীন হ’লেন, তখন পুলিশ প্রধান ভূতপূর্ব খলীফাদের যেভাবে বর্শা হাতে কর্ডন করে মসজিদে নিয়ে যেতেন নিয়মমাফিক তাকেও সেভাবে নিতে এলেন। ওমর (রহঃ) তাকে দেখে বললেন, আমাকে তোমার কী প্রয়োজন? তুমি আমার নিকট থেকে সরে যাও। আমি তো একজন সাধারণ মুসলিম বৈ কিছুই নই। তারপর তিনি যাত্রা শুরু করলেন। তারাও তাঁর সাথে সাথে চলল। অবশেষে মসজিদে ঢুকে তিনি মিম্বরে দাঁড়ালেন। লোকেরা তাঁর পাশে জমা হ’লে তিনি বললেন, হে লোক সকল! খিলাফতের এ গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে চেপে বসেছে। অথচ এ ব্যাপারে আমার কোন মতামত নেয়া হয়নি। আমার পক্ষ থেকে কোন দাবীও তোলা হয়নি। আবার মুসলমানদের সাথেও কোন পরামর্শ করা হয়নি। আমি আমার প্রতি তোমাদের বায়‘আতের যে বাধ্যবাধকতা আছে তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সুতরাং তোমাদের ইচ্ছামত একজনকে তোমরা তোমাদের নিজেদের ও দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করে নাও। সমবেত মুসলমানরা তখন চিৎকার করে এক বাক্যে বলল, আমরা আপনাকেই আমাদের জন্য ও দেশ পরিচালনার জন্য নির্ধারণ করলাম। আমরা সবাই আপনার প্রতি রাযী-খুশী। তখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং তাদের সামনে ভাষণ দিলেন।[17]

      একবার খলীফা ওমর ইবনু আব্দুল আযীযের স্ত্রী ফাতিমা তাঁর সাথে দেখা করেন। তিনি তখন তাঁর ছালাতের পাটিতে গালে হাত দিয়ে বসা ছিলেন। তাঁর দু’গাল বেয়ে চোখের পানি ঝরে পড়ছিল। তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন, আমীরুল মুমিনীন, কোন কারণ বশত কি এরূপ করছেন? তিনি বললেন, হে ফাতিমা! মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মাতের শাসনের গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে নিয়েছি। আমি ভাবছি দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র কত ক্ষুধার্ত, অভাবী, মুমূর্ষু রোগী, কষ্ট-ক্লেশভোগী বস্ত্রহীন, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, পরদেশী বন্দী, বৃদ্ধ, পোষ্যভারাক্রান্ত ইত্যাদি কত অসহায় মানুষ যে আছে! আমি জানি যে, আমার প্রভু অচিরেই আমাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। আর তাদের পক্ষে আমার বিরুদ্ধে বাদী হবেন স্বয়ং নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আমার ভয় হচ্ছে- তাঁর এই মামলার সময় আমার পক্ষ থেকে জবাব দেওয়ার মত কোনই দলীল-প্রমাণ আমার থাকবে না। তাই আমার নিজের উপর করুণা করে আমি কাঁদছি।[18]

      ১৬. দো‘আ :

      عَنْ مَعْقَلِ بْنِ يَسَارٍ قال: انْطَلَقْتُ مَعَ أَبِيْ بَكْرٍ الصِّدِّيقِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَقَالَ: يَا أَبَا بَكْرٍ! لَلشِّرْكُ فِيكُمْ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ. فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: وَهَلِ الشِّرْكُ إِلَّا مَنْ جَعَلَ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَلشِّرْكُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ، أَلَا أَدُلُّكَ عَلَى شَيْءٍ إِذَا قُلْتَهُ ذَهَبَ عَنْكَ قَلِيلُهُ وَكَثِيرُهُ؟
      হযরত মা‘কাল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর সাথে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনি বললেন, হে আবুবকর! পিঁপড়ার গতির ক্ষীণ শব্দ থেকেও অতি সংগোপনে শিরক তোমাদের মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারে। আবুবকর (রাঃ) বললেন, শিরক তো কেবল তারাই করে যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে মা‘বূদ বা প্রভু গণ্য করে। নবী করীম (ছাঃ) তখন বললেন, যার হাতে আমার জীবন তার শপথ! পিঁপড়ার ক্ষীণ শব্দ থেকেও অতি সংগোপনে শিরক তোমাদের মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারে। আমি কি তোমাকে এমন কিছু বাতলে দেব, যাতে তোমার কাছ থেকে তার কম-বেশী সবই দূর হয়ে যাবে? তারপর তিনি বললেন, তুমি বলবে اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি আমার জ্ঞাতসারে তোমার সঙ্গে শিরক করা থেকে এবং তোমার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি আমার অজ্ঞাতসারে শিরক করা থেকে’।[19]
      কথা এ পর্যন্তই। আর আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে আমাদের জন্য যে কাজটা যথাযথ তা করতে ক্ষমতা দেন। আমাদেরকে যেন তিনি তাদের দলভুক্ত করেন, যারা তাকে মান্য করে এবং তার সন্তোষ লাভের আশায় কাজ করে। সকল প্রশংসা তো আল্লাহরই, যিনি তামাম সৃষ্টির প্রতিপালক।

      শেষ কথা :

      বড়ই আফসোস! আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানে বহু লোক রাষ্ট্রক্ষমতা, উঁচু পদ ও মর্যাদা লাভের জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-লড়াইয়ে লিপ্ত। তাদের এখন একটাই চিন্তা দাঁড়িয়েছে কী করে তারা প্রেসিডেন্ট, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি শীর্ষপদ অধিকার করবে। এসব লাভ করতে তারা এমন সব হীন কৌশল অবলম্বন করছে যাতে মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা, বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে।

      রাষ্ট্রক্ষমতা প্রীতির এহেন ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ায় নিঃসন্দেহে জাতির শক্তি ক্ষয় হচ্ছে। বিরোধের সীমা বেড়ে চলেছে। ব্যক্তিগত কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধার চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ গৌণ হয়ে পড়ছে। যার ফলে আজ ব্যক্তি, সমাজ ও মুসলিম উম্মাহ বড়ই দুর্ভোগ ও মহাক্ষতির শিকার হয়ে পড়েছে।
      এহেন পতনদশা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে আল্লাহ তা‘আলার গ্রন্থ আল-কুরআন, তাঁর নবীর সুন্নাত এবং প্রথম যুগের নেককার মানুষদের জীবনধারায় ফিরে যেতে হবে।
      আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমরা সত্যপথ ও সঠিক কর্মপন্থার জন্য প্রার্থনা জানাই। আল্লাহ যেন রহমত ও শান্তি বর্ষণ করেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ), তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর ছাহাবীদের সকলের উপর।


      ________________________________________
      [1]. বুখারী হা/২৮৮৭।
      [2]. ফাৎহুল বারী ৬/৮২-৮৩, হা/২৮৮৬-এর আলোচনা।
      [3]. আহমাদ হা/৪৬২৩। শু‘আইব আরনাঊত হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
      [4]. ত্বাবারাণী হা/৬৭৪৭। আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ছহীহুল জামে‘ হা/১৪২০; ছহীহাহ হা/১৫৬২।
      [5]. আহমাদ হা/১০৩৫ ৯। আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন। দ্রঃ ছহীহ তারগীব হা/২১৮০; ছহীহাহ হা/২৬২০।
      [6]. মুসলিম হা/১৮২৬।
      [7]. সুনানুন নাসাঈ (সুয়ূত্বীর টীকা সহ) ৬/২৫৫।
      [8]. শারহু হাদীছে মা যি’বানে জায়ে‘আনে, পৃঃ ৪৫-৪৬।
      [9]. ওফায়াতুল আ‘য়ান ২/১২০।
      [10]. আত-তিবইয়ান ফী আকসামিল কুরআন, পৃঃ ২৫৯।
      [11]. মুসলিম হা/২৯৬৫।
      [12]. বুখারী হা/৬৪৪৬; মুসলিম হা/১০৫১; মিশকাত হা/৫১৭০।
      [13]. নববী, শরহে মুসলিম হা/২৯৬৫-এর ব্যাখ্যা, ১৮/১০০।
      [14]. বুখারী হা/২৭০৪।
      [15]. তুহফাতুল আহওয়াযী ১০/১৮৯।
      [16]. বুখারী হা/৬৮৩০।
      [17]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/২৩৮।
      [18]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৫/১৩১।
      [19]. ইমাম বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭১৬। আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। -

      [ সংকলিত ]
      Last edited by Ahmad Faruq M; 12-20-2015, 06:30 PM.

      Comment


      • #4
        যাজাকাল্লাহ।


        ক্ষমতার ভালবাসা প্রকাশের ক্ষেত্র (مظاهر حب الرئاسة) :
        ১. আল্লাহর সার্বভৌম ও সার্বিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা
        ২. আমলের মাঝে একনিষ্ঠতার অভাব দেখা দেয়া
        ৩. ক্ষমতা না পেলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা
        ৪. লোকের দোষ আলোচনা এবং অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করা
        ৫. দ্বীনদারী ও বিদ্যা-বুদ্ধিতে তার থেকে কেউ শ্রেয় আছে বলে সে মানতে নারায
        ৬. ক্ষমতা হারিয়ে গেলে কিংবা কেড়ে নেওয়া হ’লে আফসোস করা
        ৭. জনগণের সামনে দাম্ভিকতা প্রকাশ এবং তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা
        ৮. অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনে আল্লাহর সাহায্য না পাওয়া
        ৯. কাফির-মুশরিকদের সাথে সখ্যতা
        ১০. সত্য দ্বীন ইসলাম গ্রহণে অনীহা এবং বিদ‘আত ও বাতিল মত অবলম্বন
        ১১. রাজা-বাদশাহদের প্রিয়পাত্র হওয়া এবং তাদের সাথে ওঠাবসা করা
        ১২. খ্যাতির মোহ
        ১৩. জনতার মুখ থেকে প্রশংসা ও সুখ্যাতি শোনার বাসনা
        ১৪. আল্লাহর নামে মিথ্যাচার ও মনগড়া কথা বলা
        ১৫. মন শক্ত হয়ে যাওয়া, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সঙ্গে মনের সম্পর্ক যুক্ত হওয়া এবং আল্লাহর যিকির থেকে বিরত থাকা
        ১৬. শত্রুতা এবং পারস্পরিক অনৈক্য সৃষ্টি

        Comment


        • #5
          মাশাঅাল্লাহ অাখি! অত্যন্ত চমত্*কার! জাযাকাল্লাহ।
          অাল্লাহ অামাদের মনের ক্ষতিকর সুপ্তবাসনা থেকে রক্ষা করুন।
          কাফেলা এগিয়ে চলছে আর কুকুরেরা ঘেঊ ঘেঊ করে চলছে...

          Comment


          • #6
            কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ ‘বোকাদের সঙ্গে বিতর্ক করা কিংবা আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কিংবা জনগণের দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরানোর মানসে যে বিদ্যা অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন’।[16]

            -----------------------------------------------------------------------
            বিদ্যা চর্চায় ব্যস্ত থাকা, কোন সময় তা বন্ধ করে না দেওয়া :
            .............
            ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন,تَفَقَّهُوْا قَبْلَ أَنْ تُسَوَّدُوْا ‘নেতা হওয়ার আগে তোমরা বিদ্যা অর্জন কর’। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, নেতা হওয়ার পরেও তোমরা বিদ্যা অর্জন করতে থাক। নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ তো বৃদ্ধ বয়সে বিদ্যা শিখেছেন।[24]
            হাসান বিন মানছূর আল-জাচ্ছাছ বলেন, আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কত বছর পর্যন্ত একজন মানুষ লেখা পড়া শিখবে? তিনি বললেন, মৃত্যু পর্যন্ত।[25]

            ---------------

            عَنْ أَبِىْ أُمَامَةَ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مَا مِنْ رَجُلٍ يَلِى أَمْرَ عَشَرَةٍ فَمَا فَوْقَ ذَلِكَ إِلاَّ أَتَى اللهَ عَزَّ وَجَلَّ مَغْلُوْلاً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَدُهُ إِلَى عُنُقِهِ فَكَّهُ بِرُّهُ أَوْ أَوْبَقَهُ إِثْمُهُ أَوَّلُهَا مَلاَمَةٌ وَأَوْسَطُهَا نَدَامَةٌ وَآخِرُهَا خِزْىٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ-
            ‘আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘এমন কোন ব্যক্তি নেই যে দশ কিংবা তার বেশী লোকের উপর কর্তৃত্ব করে। কিন্তু সে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সামনে তার গলার সাথে স্বীয় হাত শৃঙ্খলিত অবস্থায় উপস্থিত হবে। তার নেকী তাকে মুক্ত করবে অথবা তার গোনাহ তাকে ধ্বংস করবে। ক্ষমতার প্রথম পর্ব ভৎর্সনাযুক্ত, মধ্যপর্ব অনুশোচনাযুক্ত এবং শেষ পর্ব ক্বিয়ামত দিবসে লাঞ্ছনাকর’।[6]
            ------------
            ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, অন্তরের আরও অনেক ব্যাধি রয়েছে। যেমন লৌকিকতা, অহংকার, আত্মম্ভরিতা, হিংসা, গর্ব, নেতৃত্বের মোহ, যমীনে প্রাধান্য বিস্তার ইত্যাদি। এ সকল রোগ সন্দেহ ও লালসা যোগে সৃষ্ট। কেননা এতে অবশ্যই নষ্ট ভাবনা ও বাতিল ইচ্ছা বর্তমান রয়েছে। যেমন আত্মম্ভরিতা, গর্ব, অহংকার ও গৌরবের মত রোগ নিজেকে বড় ভাবা এবং মানুষের নিকট থেকে শ্রদ্ধা ও প্রশংসা পাওয়ার মানসিকতা থেকে সৃষ্ট। সুতরাং অন্তরের কোন রোগই লালসা অথবা সন্দেহ কিংবা উভয়ের সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত নয়। আবার উল্লিখিত সকল রোগ অজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট। আর অজ্ঞতার ঔষধ হ’ল বিদ্যা।[12]
            ---------
            ইবনু হিববান বলেছেন, ‘দেশ ও জাতির নেতার দুশ্চিন্তা সবার চেয়ে বেশী। তার দুঃখের মাত্রা সর্বাধিক। তাকেই সবচেয়ে বেশী ব্যস্তমনা থাকতে হয়। তার বদনামও দেশজোড়া। শত্রুর সংখ্যা তার সবার উপরে পেরেশানীও তাকে বেশী পেয়ে বসে। বিব্রতকর পরিস্থিতিও তাকে বেশী সামলাতে হয়। ক্বিয়ামতে তাকেই সবচেয়ে বেশী হিসাব দিতে হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা মাফ না করলে সেই ক্বিয়ামতে কঠিন আযাব ভোগ করবে’।[19]
            ------------
            এক ব্যক্তি ওমর (রাঃ)-এর নিকট জনগণের মাঝে কিচ্ছা-কাহিনী বলে বেড়ানোর অনুমতি চাইল। তিনি তাকে বললেন, আমার ভয় হয় যে, তুমি তাদের মাঝে কিচ্ছা বা ইতিহাস বলতে গিয়ে নিজেকে তাদের থেকে বড় মনে করবে। তারপর ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে তাদের পায়ের তলা দিয়ে পিষবেন।[21]
            ----------
            . সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা, তওবা ও আত্মসমালোচনা করতে থাকা :

            ইবনু হিববান বলেছেন, যে মুসলমানদের শাসনকাজের দায়িত্ব বহন করে প্রতি মুহূর্তে তার আল্লাহর নিকট ধর্ণা দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। যাতে ক্ষমতার ব্যাপারে তার কোন বাড়াবাড়ি হয়ে না যায়। সে আল্লাহর বড়ত্ব, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির কথা স্মরণ করবে। আল্লাহ্ই তো যালিমের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী এবং নেককারদের প্রতিদান প্রদানকারী। সুতরাং শাসক তার কাজে অবশ্যই এমন আচরণ করবে, যাতে তার ইহলোক-পরলোক সবলোকেই কল্যাণ হয়। সে যেন তার পূর্ববর্তী শাসকদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। কেননা সে যে দায়িত্ব পেয়েছে সেজন্য অবশ্যই তাকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে। একইভাবে এজন্য তাকে ক্বিয়ামতে অবশ্যই আল্লাহর দরবারে হিসাব দিতে হবে।[23]
            -----------
            ৭. দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হয়ে আখেরাতের প্রতি আসক্ত হওয়া এবং আখেরাতের কাজে প্রতিযোগিতা করা :
            ইবনু রজব বলেছেন, জেনে রাখ মানুষের মন সমকালীন সকল মানুষের উপর উঠতে ও তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে ভালবাসে। এখান থেকেই উৎপত্তি ঘটে অহঙ্কার ও হিংসার। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ স্থায়ী উচ্চতা লাভের চেষ্টা চালিয়ে যায়। যাতে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি, নৈকট্য ও সাহচর্য। নশ্বর ও অস্থায়ী উচ্চতায় তার কোনই আগ্রহ থাকে না। যার পেছনে থাকে আল্লাহর অসন্তোষ, ক্রোধ তার থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং মানুষের অবনতি। এই দ্বিতীয় প্রকার উচ্চতারই নিন্দা করা হয়েছে। এ উচ্চতা অবাধ্যতামূলক এবং ভূপৃষ্ঠে নাহকভাবে অহংকার প্রদর্শন মাত্র।
            পক্ষান্তরে প্রথম প্রকার উচ্চতা লাভের জন্য লোভ করা প্রশংসার যোগ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَفِيْ ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُوْنَ ‘এতে বিজয়ী হওয়ার জন্য সকল প্রতিযোগী যেন প্রতিযোগিতা করে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/২৬)।[26]

            --------------

            ইবনু রজব বলেছেন, মহান আল্লাহ তাঁর আধ্যাত্মিক সাধক বান্দাদেরকে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সম্পদ ও মর্যাদার বদলে দুনিয়াতেই তাক্বওয়া ও আধ্যাত্মিক শক্তি দান করেন। যার ফলে অন্য সব মানুষ তাদের সমীহ করে চলে। এতো গেল তাদের বাইরের দিক, আর ভিতর দিক থেকে আল্লাহর মা‘রেফাত, ঈমান ও আনুগত্যের মজা উপভোগ করেন। এটাই সেই পবিত্র জীবন যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নর-নারীকে দিয়েছেন। এ জীবনের স্বাদ দুনিয়াতে কোন রাজা-বাদশাহ ও রাষ্ট্রীয় পদাধিকারীরা কখনো পায়নি। এজন্যই ইবরাহীম ইবনু আদহাম (রহঃ) বলেছেন, لو يعلم الملوك وأبناء الملوك ما نحن فيه لجالدونا عليه بالسيوف-‘রাজা-বাদশাহ ও তাদের সন্তানেরা যদি আমরা কী মজা ও সুখে-শান্তিতে আছি তা জানত, তাহ’লে তারা তা লাভের জন্য তলোয়ার নিয়ে আমাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হ’ত।[28]
            -------------
            আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘দীনারের দাস ধ্বংস হোক, দিরহামের দাস ধ্বংস হোক, রেশমী বস্ত্রের দাস ধ্বংস হোক। তাকে দেওয়া হ’লে সে খুশী হয়। আর না দেওয়া হ’লে নাখোশ হয়। সে ধ্বংস হোক, ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তার পায়ে কাঁটা ফুটলে তা বের করা না যাক। সুখময় হোক সেই মানুষের জীবন, যে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার মাথার চুলগুলো হয়ে যায় আলু থালু, আর পা দু’টো হয়ে যায় ধূলিমাখা। যদি সে নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকে তো সেই দলেই থাকে, আবার পশ্চাৎবাহিনীতে থাকে তো পশ্চাৎবাহিনীতেই থাকে। (সে এতটাই অখ্যাত যে) সে কোন কিছুর অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় না এবং কোন সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গৃহীত হয় না’।[1]


            ইবনু হাজার বলেছেন, ‘যদি নিরাপত্তারক্ষী দলে প্রয়োজন বেশী দেখা দেয় তাহ’লে সে সেখানে কাজ করে। আর যদি পশ্চাৎ বাহিনীতে প্রয়োজন বেশী পড়ে তো সে সেখানে কাজে লেগে যায়’।
            ইবনুল জাওযী বলেছেন, إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ কথাটির অর্থ সে অখ্যাত-অজ্ঞাত মানুষ। কোন সময় সে বড় বা উঁচু পদ চায় না। সুতরাং তাকে সফর করতে বলা হলে, সফর করে। অর্থাৎ যখন যে কাজের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সে সে কাজ করতে শুরু করে। অতএব যেন সে বলে, যদি নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকা প্রয়োজন হয়, তো আমি নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকব। আর যদি পশ্চাৎবাহিনীতে থাকার প্রয়োজন হয়, তো আমি সেখানেই অবস্থান করব। রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী, إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ ‘এ কথার মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রীতি, খ্যাতি লাভের মানসিকতা পরিত্যাগ করা এবং অখ্যাতি ও বিনয়-নম্র জীবনের মাহাত্ম্য ফুটে উঠেছে’।[2]

            -----------
            আওফ ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (ছাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে) বলেন, إن شئتم أنبأتكم عن الإمارة وما هي؟ أولها ملامة وثانيها ندامة وثالثها عذاب يوم القيامة إلا من عدل ‘তোমরা চাইলে আমি তোমাদেরকে রাষ্ট্রনায়কের প্রদত্ত দায়িত্ব ও তার অবস্থা বর্ণনা করতে পারি। এ পদের প্রথমে রয়েছে তিরষ্কার। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে অনুশোচনা এবং তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ক্বিয়ামত দিবসের মহাশাস্তি। তবে যে ইনছাফ বা ন্যায়নীতি অবলম্বন করবে সে এসব থেকে রেহাই পাবে’।[4]
            আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَيَتَمَنَّيَنَّ أَقْوَامٌ وُلُّوْا هَذَا الأَمْرَ أَنَّهُمْ خَرُّوْا مِنَ الثُّرَيَّا وَأَنَّهُمْ لَمْ يَلُوْا شَيْئاً ‘শাসকের দায়িত্ব পালনকারী বহু মানুষ (ক্বিয়ামত দিবসে) এই কামনা করবে যে, শাসকের কিছুমাত্র দায়িত্ব পালন না করার জন্য যদি তাদের সপ্তর্ষিমন্ডল থেকেও নীচে ফেলে দেওয়া হয়। তাহ’লে সেটাও তাদের জন্য অনেক ভাল’।[5]

            -----------
            . ব্যক্তির নিজের মর্যাদা জানা :

            ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি যদি নিজের মর্যাদা বা যোগ্যতা যাচাই করতে পারে, তাহ’লে সে বুঝতে পারবে যে, এই কাজের ভার বহনের ক্ষমতা তার আছে কি-না? যদি সে বুঝতে পারে যে, সে এ দায়িত্ব পালনের যোগ্য নয়, তাহ’লে সে অগ্রসর হবে না।
            عَنْ أَبِى ذَرٍّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَا أَبَا ذَرٍّ إِنِّى أَرَاكَ ضَعِيفًا وَإِنِّى أُحِبُّ لَكَ مَا أُحِبُّ لِنَفْسِى لاَ تَأَمَّرَنَّ عَلَى اثْنَيْنِ وَلاَ تَوَلَّيَنَّ مَالَ يَتِيْمٍ-
            আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘হে আবু যার! আমার দৃষ্টিতে তুমি একজন দুর্বল মানুষ। আর আমি তোমার জন্য ভালবাসি, যা নিজের জন্য ভালবাসি। সুতরাং তুমি কখনই দু’জন লোকেরও নেতা বা শাসক হয়ো না এবং কখনই ইয়াতীমের মালের তত্ত্বাবধায়ক হয়ো না’।[6]
            ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেছেন, এখানে দুর্বল অর্থ আমীরের উপর জনগণের জাগতিক ও দ্বীনী কল্যাণমূলক যে যে দায়িত্ব রয়েছে তা পালন সম্পর্কিত দুর্বলতা। তাঁর এ দুর্বলতার কারণ দুনিয়ার প্রতি তাঁর অনাসক্তি এবং ইবাদত-বন্দেগীতে অধিক মনোনিবেশ। এ ধরনের লোক জনকল্যাণ ও দুনিয়ার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হ’তে পারে না। অথচ এই দু’টি জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণের উপর দ্বীন ইসলামের কার্যকারিতা (বহুলাংশে) নির্ভর করে। নবী করীম (ছাঃ) যখন তাঁর এ অবস্থা জানলেন তখন তাঁকে নছীহত করলেন এবং নিষেধ করলেন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ও ইয়াতীমের মালের তত্ত্বাবধান করতে।[7]

            ----------------

            আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, পদের ক্ষমতা কাজে লাগানোর যথার্থ স্থান রয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহর বিধি-বিধান ব্যস্তবায়নে কাজ করা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, অত্যাচারিত ব্যক্তির সহযোগিতা, দুর্বলদের সাহায্য করা, আল্লাহর শত্রুদের উৎখাত করা ইত্যাদি। এরূপ হ’লে রাষ্ট্রক্ষমতা ও পদ প্রীতি ইবাদত বলে গণ্য হবে।[10]
            ---------

            পূর্বসূরি নেককারদের জীবনী অধ্যয়ন ও শিক্ষা গ্রহণ :

            আমের ইবনু সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) তাঁর উটের পাল চরাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর ছেলে ওমর তাঁর কাছে আসল। তাকে দেখে সা‘দ বলে উঠলেন, এই আরোহীর অনিষ্টতা থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি। সে বাহন থেকে নেমে বলল, আপনি ছাগল, উট নিয়ে পড়ে আছেন। আর জনগণকে ছেড়ে দিয়েছেন, যারা রাষ্ট্র নিয়ে ঝগড়া করছে? সা‘দ (রাঃ) তার বুকে তখন করাঘাত করে বললেন, চুপ কর। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْعَبْدَ التَّقِىَّ الْغَنِىَّ الْخَفِىَّ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সেই বান্দাকে ভালবাসেন, যে পরহেযগার, ধনী এবং নির্ঝন্ঝাট জীবন যাপন করে’।[11]
            ইমাম নববী (এ হাদীছের ব্যাখ্যায়) বলেছেন, এখানে ঐশ্বর্য বলতে মনের ঐশ্বর্যকে বুঝানো হয়েছে। এই ঐশ্বর্যই কাম্য। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ অর্থাৎ ‘মনের প্রাচুর্যই আসল প্রাচুর্য’।[12] আর الخفي শব্দের অর্থ অপরিচিত, অজ্ঞাত মানুষ যে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল আল্লাহর ইবাদতে এবং নিজের ব্যক্তিগত কাজকর্মে মশগূল থাকে।[13]
            কখনও কেউ বড় কোন কল্যাণার্থে নিজে পদত্যাগ করেন এবং অন্যকে পদ লাভের সুযোগ করে দেন। যেমন হাসান ইবনু আলী (রাঃ) খিলাফতের দাবী মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর অনুকূলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এক ভবিষ্যদ্বাণীতে নবী করীম (ছাঃ) এজন্য তার প্রশংসা করে গিয়েছেন।
            عَنْ أَبِيْ بَكْرَةَ قَال رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى الْمِنْبَرِ وَالْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ إِلَى جَنْبِهِ، وَهْوَ يُقْبِلُ عَلَى النَّاسِ مَرَّةً وَعَلَيْهِ أُخْرَى وَيَقُولُ إِنَّ ابْنِى هَذَا سَيِّدٌ، وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ-
            আবু বাকরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মিম্বরের উপর দেখেছি। এমতাবস্থায় হাসান ইবনু আলী তার পাশে ছিলেন। একবার তিনি জনতার দিকে তাকাচ্ছিলেন, আরেকবার তার দিকে। এমতাবস্থায় তিনি বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমার এই পুত্র একজন নেতা। সম্ভবতঃ আল্লাহ তার মাধ্যমে মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে সমঝোতা করে দিবেন’।[14]

            আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেছেন, এটি নবী করীম (ছাঃ)-এর একটি বড় মু‘জিযা। তিনি যেমনটা বলে গিয়েছিলেন, তেমনই ঘটেছিল।[15]

            পূর্বসুরি নেককারদের কেউ কেউ তার থেকে উপযুক্ত কাউকে দেখলে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া থেকে বহু বহু দূরে রাখতেন। যেমন আবুবকর (রাঃ)-এর খলীফা হওয়া এবং ছাহাবীদের তাঁর হাতে বায়‘আত হওয়ার ঘটনার মধ্যে এর বড় প্রমাণ রয়েছে।
            ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আবুবকর (রাঃ) ভাষণ দিলেন। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য খলীফা হিসাবে এই দু’জনকে পসন্দ করছি। তোমরা তাদের যাকে পসন্দ কর তার হাতে বায়‘আত কর। তিনি আমার ও আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ-এর হাত ধরলেন। এর আগে তিনি আমাদের (দু’জনের) মাঝে বসা ছিলেন। তিনি যদি এ কথা বাদে অন্য কিছু বলতেন তাহ’লে হয়ত আমার তা অপসন্দ হ’ত না। আল্লাহর কসম! যে জাতির মধ্যে আবুবকর রয়েছেন সেই জাতির আমীর বা রাষ্ট্রপ্রধান আমাকে নির্বাচন করার তুলনায় যদি আমার গর্দানও কাটা যায় আর তাতে আমার কোন পাপ না হয়, তবে সেটাই আমার নিকট সবচেয়ে ভাল লাগত।[16]

            এমনই আরেকটি ঘটনা- ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) যখন খলীফার আসনে আসীন হ’লেন, তখন পুলিশ প্রধান ভূতপূর্ব খলীফাদের যেভাবে বর্শা হাতে কর্ডন করে মসজিদে নিয়ে যেতেন নিয়মমাফিক তাকেও সেভাবে নিতে এলেন। ওমর (রহঃ) তাকে দেখে বললেন, আমাকে তোমার কী প্রয়োজন? তুমি আমার নিকট থেকে সরে যাও। আমি তো একজন সাধারণ মুসলিম বৈ কিছুই নই। তারপর তিনি যাত্রা শুরু করলেন। তারাও তাঁর সাথে সাথে চলল। অবশেষে মসজিদে ঢুকে তিনি মিম্বরে দাঁড়ালেন। লোকেরা তাঁর পাশে জমা হ’লে তিনি বললেন, হে লোক সকল! খিলাফতের এ গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে চেপে বসেছে। অথচ এ ব্যাপারে আমার কোন মতামত নেয়া হয়নি। আমার পক্ষ থেকে কোন দাবীও তোলা হয়নি। আবার মুসলমানদের সাথেও কোন পরামর্শ করা হয়নি। আমি আমার প্রতি তোমাদের বায়‘আতের যে বাধ্যবাধকতা আছে তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সুতরাং তোমাদের ইচ্ছামত একজনকে তোমরা তোমাদের নিজেদের ও দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করে নাও। সমবেত মুসলমানরা তখন চিৎকার করে এক বাক্যে বলল, আমরা আপনাকেই আমাদের জন্য ও দেশ পরিচালনার জন্য নির্ধারণ করলাম। আমরা সবাই আপনার প্রতি রাযী-খুশী। তখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং তাদের সামনে ভাষণ দিলেন।[17]

            একবার খলীফা ওমর ইবনু আব্দুল আযীযের স্ত্রী ফাতিমা তাঁর সাথে দেখা করেন। তিনি তখন তাঁর ছালাতের পাটিতে গালে হাত দিয়ে বসা ছিলেন। তাঁর দু’গাল বেয়ে চোখের পানি ঝরে পড়ছিল। তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন, আমীরুল মুমিনীন, কোন কারণ বশত কি এরূপ করছেন? তিনি বললেন, হে ফাতিমা! মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মাতের শাসনের গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে নিয়েছি। আমি ভাবছি দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র কত ক্ষুধার্ত, অভাবী, মুমূর্ষু রোগী, কষ্ট-ক্লেশভোগী বস্ত্রহীন, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, পরদেশী বন্দী, বৃদ্ধ, পোষ্যভারাক্রান্ত ইত্যাদি কত অসহায় মানুষ যে আছে! আমি জানি যে, আমার প্রভু অচিরেই আমাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। আর তাদের পক্ষে আমার বিরুদ্ধে বাদী হবেন স্বয়ং নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আমার ভয় হচ্ছে- তাঁর এই মামলার সময় আমার পক্ষ থেকে জবাব দেওয়ার মত কোনই দলীল-প্রমাণ আমার থাকবে না। তাই আমার নিজের উপর করুণা করে আমি কাঁদছি।[18]

            Comment

            Working...
            X