(২য় পর্ব কমেন্ট বক্সে দেখুন)
ইদানিং কাশ্মীর জিহাদ নিয়ে আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া সাহেবের বক্তব্য আশাকরি সকলেই শুনে থাকবেন। তার বক্তব্যের সারকথা:
[জিহাদ একটি মুনাজ্জাম ও শৃংখলাবদ্ধ কাজ। এলোপাথারি মারামারি করে মরে যাওয়াই জিহাদ নয়। আর শৃংখলাবদ্ধভাবে জিহাদ করতে হলে জিহাদের স্থান লাগবে, নিয়মিত সেনাবাহিনি লাগবে, কুদরত তথা শত্রুর সাথে পেরে উঠার সামর্থ্য লাগবে। সাধারণ ব্যক্তিদের দ্বারা এমন শৃংখলাবদ্ধ জিহাদ সম্ভব নয়, এর জন্য রাষ্ট্র লাগবে। রাষ্ট্রীয় ঘোষণার দ্বারা জিহাদ করতে হবে। জিহাদ করবে রাষ্ট্রের সেনাবাহিনি। সাধারণ মানুষ জিহাদে যাবে না। তবে যদি সেনাবাহিনি সাধারণ মানুষদের যেতে বলে তাহলে যাবে। কারণ, সেনাবাহিনি তখন তাদেরকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষ যাওয়া আত্মহত্যার শামিল। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ছাড়া তাদের জন্য জিহাদে যাওয়া হারাম হবে। অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার জিহাদে যাওয়ার ডাক না দেবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দেশের মুসলমানদের জন্য কাশ্মীর বা এ জাতীয় কোন ভূখণ্ডে যাওয়া হারাম।]
উপরোক্ত কথাটি (যদিও তাতে বেশ কিছু ভুল আছে তথাপি) এক পর্যায়ে মেনে নেয়ার মতো। কারণ, জিহাদ আসলে একটা জামাতবদ্ধ কাজ। এর জন্য একটা উপযুক্ত ময়দান এবং সুশৃংখল ব্যবস্থাপনা না থাকলে তেমন ফলপ্রসূ হয় না। এটা অস্বীকার করার মতো নয়। এ জন্যই মুজাহিদিনে কেরাম যার তার কথায় কোন ভূমিতে রওয়ানা দিতে নিষেধ করেন। বরং মুজাহিদদের নিয়ম হল, প্রত্যেকে আপন ভূমিতে থেকে জিহাদ করবে। কখনও প্রয়োজন পড়লে বাহিরে যাবে। ঢালাওভাবে সকলে হিজরত করে অন্য ভূমিতে চলে যাওয়া আন্তর্জাতিক উমারাদের নিয়ম বহির্ভূত। যাহোক, কথাটা এক পর্যায়ে মেনে নেয়ার তবে। তবে তার পুরো বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে, তার এ আশঙ্কা শুধু একটা আশঙ্কা নয়, বরং অনেকগুলো ভ্রান্ত আকিদার নাতিজা-ফলাফল। যেমন, আমাদের দেশের মুসলমান যুবকদের জন্য কাশ্মিরে যাওয়া হারাম হওয়ার কারণ বলেছেন,
- রাষ্ট্রপ্রধান তাদেরকে অনুমতি দেয়নি।
- কাশ্মীরে জিহাদের জন্য কোথাও থেকে কোনো ডাক আসেনি। এমনকি তিনি দাবি করেছেন যে, বর্তমান বিশ্বে কোথাও জিহাদের ডাক নেই।
- কাশ্মীরিরা জিহাদে দাঁড়ায়নি। আর যখন তারা না দাঁড়াবে তখন আমাদের উপর তাদের সাহায্য করার দায়িত্ব নেই। তারা যখন দাঁড়াবে এবং দাঁড়ানোর পর মোকাবেলা করতে অক্ষম হয়ে যাবে, তখন অন্যরা যেতে পারবে, নতুবা হারাম হবে।
- কাশ্মীরিরা দাঁড়ালেও তারা না পারলে প্রথম ফরয হতো পাকিস্তানীদের উপর। আমরা যারা দূরে আছি, তাদের জন্য যাওয়া হারাম হবে। এটা আত্মহত্যার শামিল।
- কাশ্মীরে জিহাদ দাঁড়ালে, তারা না পারলে, এমনকি আশপাশের মুসলমানরাও না পারলে তখন আমরা যেতে পারবো। তবে আমাদের মধ্যে কেবল সে সকল লোকই যাবে যারা সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত। সাধারণ মানুষ কখনও জিহাদে যাবে না। অবশ্য তিনি সামনে গিয়ে এর বিপরীত কথা বলেছেন যে, নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনি যদি সাধারণ মানুষকে যেতে বলে তাহলে তারা যাবে। সেনাবাহিনি তাদেরকে ট্রেনিং দেবে।
- যারা কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য বলছে, তারা নিজেরা জিহাদে যায় না। অন্যদেরকে যেতে বলে নিজেরা বসে থাকে। এরা নিজেদের সুনাম বাড়ানোর জন্য জিহাদের কথা বলছে। এরা ধান্দাবাজ- ফেতনাবাজ। এদের কথা শুনা জায়েয হবে না।
- কাশ্মীরে কারা জিহাদ করছে তা জানা নেই। আর হাদিসে এসেছে, ومن قاتل تحت راية عمية يغضب لعصبة أو يدعو إلى عصبة أو ينصر عصبة فقتل فقتلة جاهلية “যে ব্যক্তি এমন ঝাণ্ডা তলে যুদ্ধ করে যা হক না বাতিল জানা নেই, যে তার আপন গোত্রের স্বার্থে ক্রোধান্বিত হয় কিংবা গোত্রের দিকে আহবান করে বা অন্যায়ভাবে গোত্রের সহায়তা করে আর এভাবেই মারা যায়, তাহলে সে জাহিলী মরা মরল।”- মুসলিম: ৪৮৯২
এছাড়াও আরও অনেক কিছু বলেছেন। সংক্ষেপে একটু গুছিয়ে বলতে গেলে এভাবে বলা যায়-
[কোন মুসলিম ভূখণ্ডে কাফেররা আগ্রাসন চালালে প্রথমত যাদের উপর আক্রমণ হয়েছে মোবাবেলা করা তাদের উপর ফরযে আইন- যদি মোকাবেলার সামর্থ্য তাদের থাকে। মোকাবেলার সামর্থ্য না থাকলে ফরয নয়। তখন হয়তো হিজরত করবে, নয়তো সবর করবে (তথা মার খেতে থাকবে)। আর সামর্থ্যের মাপকাটি হল, কাফেরদের সংখ্যা মুসলমানদের ডবলের চেয়ে বেশি না হওয়া।
আক্রান্ত মুসলমানরা যদি জিহাদে না দাঁড়ায়, তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা এবং তাদের হয়ে জিহাদ করা বাহিরের মুসলামনদের দায়িত্ব নয়। বাহিরের মুসলমানদের উপর তখনই জিহাদ ফরয হবে, যখন আক্রান্তরা কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি তথা আমীরের অধীনে মোকাবেলায় দাঁড়াবে। যখন তারা আমীরের অধীনে দাঁড়াবে এবং মোকাবেলা করতে অক্ষম হয়ে পড়বে তখনই কেবল বাহিরের মুসলমানদের উপর ফরয হবে, অন্যথায় নয়।
যদি তারা কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি তথা আমীরের অধীনে মোকাবেলায় দাঁড়ায় কিন্তু মোকাবেলা করতে সক্ষম না হয়, তাহলে পার্শ্ববর্তী মুসলমান রাষ্ট্রের সকলের উপর জিহাদ ফরয হবে না, কেবল সেনাবাহিনির উপর ফরয হবে। সাধারণ জনগণের উপর ফরয হবে না। তবে সেনাবাহিনি যদি সাধারণ জনগণকে যেতে বলে তাহলে যাবে এবং সেনাবাহিনি তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করবে।
পার্শ্ববর্তীরা যদি জিহাদে যায় এবং তারাও মোকাবেলা করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তাহলে দূরবর্তীদের উপর জিহাদ ফরয। পার্শ্ববর্তী দেশের মুসলমানরা যদি জিহাদে না যায়, তাহলে দূরবর্তী দেশগুলোর মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরয নয়। (শায়খ যদিও কথাটি এত পরিষ্কার করে বলেননি, তবে বয়ান থেকে কথাটি স্পষ্ট।)
তবে সেনাবাহিনি হোক, সাধারণ মুসলমান হোক, পার্শ্ববর্তী হোক বা দূরবর্তী হোক: তাদের জন্য তখনই জিহাদে যাওয়া জায়েয হবে, যখন রাষ্ট্র প্রধান অনুমতি দেবে। রাষ্ট্র প্রধান অনুমতি না দিলে জিহাদে যাওয়া হারাম।]
এককথায়, সব বিভ্রান্তির গোঁড়া হল, ইমাম। শায়খের মতে জিহাদ ফরয হওয়ার জন্য ইমাম, ইমামের আহ্বান ও অনুমতি লাগবে। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদেরও একজন ইমাম লাগবে; আর বাহিরের মুসলমান যারা জিহাদে যেতে চাচ্ছে তাদেরও তাদের ইমাম তথা রাষ্ট্র প্রধানের অনুমতি লাগবে। অবশ্য তিনি এতটুকু ব্যবধান করেছেন যে, যারা বাহিরের তাদের জন্য তো নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র প্রধান লাগবে; কিন্তু যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের জন্য এমন রাষ্ট্র প্রধান লাগবে না। অন্তত জিহাদে অভিজ্ঞ এমন কোন ব্যক্তির অধীনে জিহাদে দাঁড়াতে হবে। যদি তারা জিহাদে দাঁড়ায় তাহলেই কেবল বাহিরের মুসলমানদের জন্য এখানে এসে জিহাদ করা জায়েয হবে, অন্যথায় যদি তারা শুধু মারই খেতে থাকে, অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তির অধীনে জিহাদে না দাঁড়ায়, তাহলে বাহিরের মুসলমানদের জন্য তাদেরকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসা জায়েয নয়, হারাম। কারণ, যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের কোন ইমাম নেই।
দ্বিতীয়ত যদি তারা কোন আমীরের নেতৃত্বে দাঁড়ায়ও এবং অক্ষম হয়ে মারও খেতে থাকে, তথাপি বাহিরের মুসলমানদের জন্য তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা ততক্ষণ পর্যন্ত হারাম, যতক্ষণ না তাদের রাষ্ট্র প্রধান তাদেরকে অনুমতি দেয়।
এর দলীল তিনি দিয়েছেন নিচের হাদিসটি দিয়ে-
إنما الإمام جنة يقاتل من ورائه ويتقى به
“ইমাম হচ্ছেন ঢালস্বরূপ। তার পেছনে থেকে যুদ্ধ করা হবে এবং তার দ্বারা আত্মরক্ষা করা হবে।”- বুখারি ২৭৯৭, মুসলিম ১৮৪১অতএব, যাদের উপর আক্রমণ হয়েছে তাদেরও একজন ইমাম লাগবে, আর বাহিরের মুসলমান যারা যাবে, তাদেরও ইমামের অনুমতি লাগবে। এ হাদিসের আলোচনা আমরা সামনে করবো ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য, শায়খ বলেছেন, যাদের উপর আক্রমণ হয়েছে তাদের উপর জিহাদ তখনই ফরয হবে, যখন শত্রু প্রতিহত করার কুদরত তাদের থাকবে। এর মাপকাটি তিনি বুঝাচ্ছেন, শত্রু সংখ্যা মুসলমানদের দ্বিগুণের বেশি না হওয়া। দ্বিগুণের বেশি হলে কুদরত নেই ধরা হবে। তখন আর ফরয থাকবে না। ধরলাম ফরয নয়, তাহলে অন্তত প্রতিরোধ করা জায়েয হবে কি’না? এ ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট কিছু না বললেও যতটুকু বুঝা যায়, তার মতে এমতাবস্থায় প্রতিরোধ করা হারাম হবে। কেননা, এটা ‘ইলক্বাউন নাফস ইলাততাহলুকা’ তথা আত্মহত্যার শামিল। শায়খের আরেকটা কথা থেকে এমনটা বুঝা যায়। তাহ হল, শায়খ যখন বলেছিল, রাষ্ট্র প্রধানের অনুমতি না হলে জিহাদে যাওয়া হারাম, তখন একজন সূরা নিসার নিম্নোক্ত আয়াত দিয়ে এর আপত্তি করেছিল-
﴿وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا﴾
“তোমাদের কী হলো! তোমরা কিতাল করছো না আল্লাহর রাস্তায় এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য? যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে বের করে নিন এ জনপদ থেকে, যার অধিবাসীরা যালিম। আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কোনো অভিভাবক নির্ধারণ করে দিন এবং নিযুক্ত করে দিন আপনার পক্ষ থেকে কোনো সাহায্যকারী।”- নিসা ৭৫আপত্তি করেছিল যে, এ আয়াতে তো রাষ্ট্র প্রধানের অনুমতি লাগবে বলা হয়নি। তখন তিনি আজগুবি একটা জওয়াব দিয়েছেন। সাথে এও বলেছেন, দুর্বলদেরকে তো একথা বলা হয়নি যে, তোমরা জিহাদ শুরু কর। তাদেরকে সবর করতে বলা হয়েছে।
শায়খের এ কথা এবং আগের কথা মিলালে বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি বুঝাচ্ছেন, দুর্বলদের জন্য জিহাদ করা হারাম। এটা আত্মহত্যার নামান্তর। এছাড়াও আরো বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে তিনি বিষয়টি বুঝানোর পায়তারা করেছেন। যদি এমনটাই হয়, তাহলে শায়খের এ দাবি নির্জলা মিথ্যা। কারণ, আয়াতে তো এ কথা বলা হয়নি যে, ‘তোমরা মার খেয়ে যাও, তবুও জিহাদ শুরু করবে না। তোমরা দুর্বল। জিহাদ শুরু করা তোমাদের জন্য হারাম হবে’। বেশির চেয়ে বেশি একথা বলা যায়, দুর্বলদের জন্য জিহাদ ফরযে আইন করা হয়নি। তাই না করার অনুমতি আছে। কিন্তু করলে হারাম হবে একথা তো বলা হয়নি। বরং করাটাই প্রশংসনীয়। মার খেয়ে খেয়ে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে, ইজ্জত-আব্রু হারিয়ে মরার চেয়ে যুদ্ধ করে মরে যাওয়া প্রশংসনীয়। এ ব্যাপারে ইনশাআল্লাহ আমরা সামনে আলোচনা করবো।
অধিকন্তু দুর্বলদের জন্য জিহাদ না করে থাকার অনুমতি আছে কথাটা ঢালাওভাবে সহীহ নয়। কাফেররা আপনাকে, আপনার সামনে আপনার ছেলে-মেয়ে, মা-বাপা ও ভাই-বোনকে নির্যাতন ও হত্যা করছে আর আপনি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন? কিছুই করবেন না? এটার অনুমতি শরীয়ত দেয় না। সামর্থ্যে যতটুকু আছে আপনাকে করতে হবে। বসে বসে মার খেয়ে খেয়ে, নিজের ইজ্জত-আব্রু হারিয়ে মরার অনুমতি শরীয়ত দেয় না। সামনে ইনশাআল্লাহ এর আলোচনা করবো।
আর শায়খ শত্রু সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হলেই যে জিহাদ ফরয নয় বলেছেন, সেটা মূলত তার অজ্ঞতার ফল। আহযাবের যুদ্ধে যখন কুরাইশরা আরবের বড় বড় কয়েকটি কাফের গোত্র এবং মদীনার ইয়াহুদিদের সমন্বয়ে বহুজাতিক বাহিনি গঠন করে মদীনা অবরোধ করেছিলে, তখন কি কাফেরদের সংখ্যা মুসলমানদের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি ছিল না? তখন কি জিহাদ ফরযে আইন ছিল না? না’কি হারাম ছিল? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের নিয়ে যে প্রতিরোধ করেছেন তা কি হারাম করেছেন? শায়খ আপনি কি বলছেন? আপনার মাথা ঠিক আছে তো? আমার মনে হয় শায়খ কি যে বলেন তা চিন্তা করেন না। মুখে যা আসে বলে দেন। এজন্য শায়খের আগে পিছে কথার মধ্যে অনেক গড়মিল দেখা যায়। ২০ মিনিটের দু’টো বয়ানে মধ্যেও শায়খের অনেক গড়মিল আছে। বরং বলতে গেলে শায়খের প্রতিটি কথাতেই একেকটি মহা বিভ্রান্তি লুকায়িত। সব আলোচনা করতে গেলে বিশাল কিতাব লিখতে হবে। আলোচনা সংক্ষেপ করতে চাচ্ছি।
***
তাহলে এখন মুসলমানদের করণীয় কি? বাইরের মুসলামানদের করণীয় বলেছেন, দোয়া করা এবং যাদেরকে বললে কাজ হবে তাদেরকে বলা। এর বাইরে কোন কাজ নেই। এমনকি কাশ্মীরিদের দাবিতে মিছিলও করতে তিনি নিষেধ করেছেন।
দোয়ার বিষয়টা মেনে নিলাম। মুসলমানের বিপদে অন্য মুসলমান দোয়া করবে এটাই তো ভ্রাতৃত্বের দাবি। এতে আপত্তি নেই। আপত্তি হলো, দোয়া ছাড়া আর কিছু করণীয় আছে কি’না- সেটা নিয়ে।
তিনি দোয়া ছাড়া আর করণীয় বলেছেন, ‘যাদেরকে বললে কাজ হবে তাদেরকে বলা’। এর দ্বারা তিনি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর তাগুত শাসকগোষ্ঠী, অন্যান্য কাফের রাষ্ট্রের শাসকদের বুঝিয়েছেন। জাতিসংঘকেও হয়তো বুঝিয়ে থাকবেন। কিন্তু তাদের কাছে যদি বলা না যায় (বিশেষত যখন তিনি মিছিল করতেও নিষেধ করেছেন তখন বলার আর কি সূরত বাকি রইল? আর শাসকগোষ্ঠীর কাছে দাবি নিয়ে পৌঁছা যে মোটামুটি অসম্ভব আশাকরি বর্তমানে কারো কাছে অস্পষ্ট নয়; আর পৌঁছতে পারলেও তাতে সমূহ বিপদের আশঙ্কা); কিংবা বলার পর যদি তারা কোন কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে কি করণীয় তা তিনি বলেননি। তবে তিনি এতটুকু বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার যদি ভারতের পক্ষ হয়ে কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে ভারতের পক্ষে যোগ দেয়া আমাদের জন্য জায়েয হবে না। সাথে এ কথাও বলেছেন যে, বাংলাদেশ সরকার ভারতকে সমর্থন করে যাচ্ছে। তবে আরো কিছু প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেছেন, যেগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন,
- সরকার যখন কুফরের পক্ষ নিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে তখন সরকারের কি বিধান? সে মুসলমান থাকবে কি’না বা তার আনুগত্য জরুরী কি’না বা সে আমীরুল মু’মিনীন হিসেবে বহাল থাকবে কি’না (যেমনটা তারা বর্তমানে সরকারকে আমীরুল মু’মিনীন মনে করে থাকে এবং তার আনুগত্য ফরয বলে থাকে)?
- সরকার যদি নিজেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে এবং জিহাদেরও অনুমতি না দেয় তখন মুসলমানদের কি করণীয়?
- সরকার যদি ভারতের পক্ষে যোগ দেয়, তাহলে এদেশের মুসলমানদের কি করণীয়?
এসব প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেছেন।
***
ফতোয়ার নাতিজা-ফলাফল
শায়খের ফতোয়া অনুযায়ী ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে একটু লক্ষ করি:
শায়খ বলেছেন, কাশ্মীরে যে পরিমাণ হিন্দু সৈন্য আছে এবং তাদের যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আছে, তার সামনে কাশ্মীর মুসলমানদের দাঁড়ানোর সামর্থ্য নেই। এমনকি এও বলেছেন, বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ কাশ্মীরে চলে গেলেও কিছু করতে পারবে না। এতই যখন দুর্বল, তখন কাশ্মীরিদের জন্য জিহাদে দাঁড়ানো আত্মহত্যার শামিল। শায়েখের ফতোয়া অনুযায়ী (যদি আমি শায়খের কথা সঠিক বুঝে থাকি) কাশ্মীরিদের জন্য জিহাদে দাঁড়ানো হারাম। কিংবা অন্তত ফরয নয়। আর শায়খ বলেছেন, কাশ্মিরিরা জিহাদে দাঁড়ায়নি। মোটকথা দাঁড়ানো হারামই হোক কিন্তু এমনটাই হয়ে থাকুক যে, তারা দাঁড়ায়নি- সর্বাবস্থায় বহির্বিশ্বের মুসলমানদের জন্য কাশ্মিরে যাওয়া হারাম। কারণ, এক দিকে তারা নিজেরা যখন দাঁড়ায়নি (যদিও শায়খের এ বক্তব্য সঠিক নয়, বরং কাশ্মিরিরা টুকটাক হলেও জিহাদ করে যাচ্ছে) তখন শায়খের দরবারি ফতোয়া অনুযায়ী তাদেরকে সাহায্য করা বাকি মুসলমানদের দায়িত্ব নয়। অধিকন্তু পাকিস্তান যেহেতু এগিয়ে যায়নি, তাই আমাদের কোন দায়িত্ব নেই। সর্বোপরি রাষ্ট্রপ্রধানের যেহেতু অনুমতি হয়নি, তাই বাহিরের মুসলমানদের জন্য কাশ্মিরে সহায়তা করতে যাওয়া হারাম। অতএব, এখন যদি গোটা কাশ্মীরকে মৃত্যুপুরীও বানানো হয়; কাশ্মীরের নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সকলকেও যদি ধরে ধরে যবাই করা হয় বা বোম্বিং করে উড়িয়ে দেয়া হয়; যদি মা-বোনদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিতও হয়, যদি তাদের প্রতি দরদে হৃদয় ফেঁটে টুকরো টুকরোও হয়ে যায়, তথাপি আমাদের জন্য এবং বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য জিহাদে যাওয়া হরাম! হারাম! হারাম! কাঁদতে পারবেন, দোয়া করতে পারবেন, জিহাদ করতে পারবেন না। এমনকি মিছিলও করতে পারবেন না। করলেই হারাম হবে। জাহান্নামে যেতে হবে। আল্লাহর সামনে কেয়ামতের দিন জবাবদিহি করতে হবে- কেন তুমি রাষ্ট্র প্রধানের অনুমতি ছাড়া জিহাদে গেলে? তাগুতদের কথা মতো কেন ঘরে বসে থাকলে না? কেন কাশ্মীরিদের নীরবে হত্যা করতে দিলে না? কেন মালউনদেরকে বাধা দিলে? আরো হাজারো জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে!!
এই হল ফতোয়ার সারকথা। বাহ! অনেক সুন্দর ফতোয়া। এ ধরণের সরকারি ফতোয়া দেয়ার জন্যই বালআম বিন বাউরার উত্তরসূরি কুকুরদেরকে রুটি আর উচ্ছিষ্ট দিয়ে তাগুতগোষ্ঠী পোষে যাচ্ছে। না হলে তাদের কি-ই বা দরকার পড়েছে যে, এদেরকে তারা পোষে যাবে- যদিও তা উচ্ছিষ্ট দিয়েই হোক না কেন!!
(চলমান ইনশাআল্লাহ)
Comment