দেশ ও ভাষার জন্য জীবনদান নিয়ে এক লেখার প্রেক্ষিতে মন্তব্য
“দেশ ও ভাষার জন্য জীবনদানের মর্যাদা” নামে একটা সংবাদ হয়তো অনেকে দেখেছেন।
লেখকের পরিচয়ে বলা হয়েছে: মুফতি রফিকুল ইসলাম আল মাদানি। গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা।
শিরোনাম থেকেই ঘৃণ্য জাতীয়তাবাদের পঁচা গন্ধ আসছে। আর ভিতরে যা আছে তা আরও পঁচা।
লেখক মদীনা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। সে হিসেবে ‘আল মাদানি’। সৌদি আরবের এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে এদেশের অনেকজনই পড়াশুনা শেষে দেশে এসে নিজেদের মানসাব ও যশ-খ্যাতি সংরক্ষণের বিনিময়ে তাগুত সরকারের গদি সুরক্ষার পক্ষে দিবানিশি কাজ করে যাচ্ছেন। তাগুতদের শরয়ী শাসকের লেভেল লাগানো, ওয়াজিবুল ইতাআত সাব্যস্ত করা ইত্যাদি জঘন্য কাজগুলো করে যাচ্ছেন, তাওহিদের স্লোগানবাদি এমন অনেকের কালো চেহারা হয়তো আপনারা চেনেন।
এ ধরনের তাওহিদবাদিদের পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য মোটেই আশ্চর্য কিছু ছিল না। কিন্তু আমাদের শিরোনামের লেখক স্বয়ং নিজে ‘তথাকথিত আহলে হাদীসের আসল রূপ’ নামে কিতাব সংকলন করেছেন। তার থেকে এ ধরনের লেখাতে একটু আশ্চর্য হওয়া যেতো।
অবশ্য কওমি অঙ্গন থেকে ফরিদ মাসউদের উদ্ভব এবং শোকরানা মাহফিলের ঘটনার পর আর কোনো মহল থেকেই কোনো কিছু আশ্চর্যের নয়।
বিশেষত লেখকের উপরোক্ত কিতাবে একটা শিরোনাম আছে, ‘জঙ্গিবাদের গোড়ায় আহলে হাদীস কেন?(*)
টীকাতে লেখা আছে, ‘(*) মুসলমানদেরকে জঙ্গিবাদের অশুভ চক্রান্ত থেকে সতর্ক থাকার লক্ষ্যে এই শিরোনামটি ১৯তম সংস্করণে সংযোজন করা হয়েছে।’ পৃষ্ঠা ৩২
তখন আর তেমন আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আজকাল সব মহল এবং সব গবেষক থেকেই সব কিছু সম্ভব হচ্ছে। অসম্ভব হলে শুধু সেটাই, যেটা তাগুতদের গদির বিপক্ষে যাবে।
যাহোক, এ গেল শিরোনাম নিয়ে কথা। ভিতরে তিনি যে অপরাধটা করেছেন, কুফরি জাতীয়তাবাদি এসব চেতনা ও আন্দোলনকে শরয়ী লেবাস পরিয়ে উপস্থাপন করেছেন।
তৎকালীন পাকিস্তান উর্দু ভাষাকে কতটুকু বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছিল এবং সেটা শরীয়তের বিপরীত কি’না, একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের সে অধিকার আছে কি’না- সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। বিশেষত যারা বাধ্যতামূলক করতে চাচ্ছিল, তারাও তাগুতই ছিল এবং তাদের মধ্যেও জাহিলি জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল; তখন আর সেদিকে যাওয়ার তেমন দরকার নেই।
তবে লক্ষ করার দরকার যেটা, সেটা হলো,
তৎকালীন ভাষা আন্দোলন কি ইসলামের জন্য হয়েছিল? কিংবা অন্তত ইসলাম অনুমোদন দেয় এ দিকটি বিবেচনা রেখে করা হয়েছিল?
প্রতিটি চক্ষুষ্মান ব্যক্তি বলতে বাধ্য যে, ইসলামের কোনো নাম নিশানাও সেখানে ছিল না। সম্পূর্ণ জাহিলি জাতীয়তাবাদি চেতনা থেকে এ আন্দোলন হয়েছিল।
জিহাদের মতো পবিত্র ও মহান ইবাদতও যদি কোনো ব্যক্তি জাতীয়তাবাদি চেতনা নিয়ে করে বা লোক দেখানোর জন্য করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বর্থ্যহীন সিদ্ধান্ত যে, তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে; তখন লেখক কি করে বলতে পারলেন,
‘মাতৃভাষা নিয়ে এ আন্দোলনেই পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বীজ বপন হয়েছিল। রচিত হয়েছিল লাল-সবুজের পতাকা। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে তারা শহীদের মর্যাদা পাবেন’।?!
আরও আশ্চর্যের কথা হলো, যারা ভাষা আন্দোলনে নিহতদের শহীদ বলেন – এমনকি হিন্দুদেরকেও তারা এ হুকুমের বাহিরে রেখে কথা বলেন না- তাদের অনেকের কাছে হেফাজতের রাতে মৃত্যুবরণকারী উলামা, তুলাবা ও মুসলিম জনসাধারণ শহীদ নন!
কেন?
কারণ, তারা সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিহত হয়েছে। তারা বাগি।
প্রশ্ন হলো, তাহলে ভাষা আন্দোলন করেছিল যারা, তারা কি বর্তমান বাংলাদেশের চেয়েও পাঁচ/সাতগুণ বড় একটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায়নি, যে রাষ্ট্রটি- নামে হলেও- ইসলামের জন্য হয়েছিল?
জাহিলি জাতীয়তাবাদি চেতনা নিয়ে একটা দুনিয়াবি বিষয়ে নিহত হলে শহীদ হবে, আর দ্বীনের জন্য মারা গেলে শহীদ হবে না! বড় অবাক কথা।
কিন্তু আগেই বলেছি, আজকালকার গবেষকদের কাছ থেকে কোনো কিছুই আর অপ্রত্যাশিত নয়।
***
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কথা বলে রাখি, স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপনকে তিনি প্রশংসার দৃষ্টিতে উল্লেখ করেছেন। বলি, আজ যারা জিহাদ করে বাংলাদেশে আযাদির বীজ বপন করতে চাচ্ছেন, সেটা অবৈধ হবে কেন?
নামে হলেও ইসলামি; সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নতুন রাষ্ট্র জন্ম দিলে যদি প্রশংসনীয় হয়, তাহলে শতভাগ কুফরি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জিহাদ করে স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করলে কেন নাজায়েয হবে?
ইসলামের লেবাসধারী যারা ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আড়তি গেয়ে থাকেন, তাদের কাছে প্রশ্নটা রইল।
***
Comment