আন নাসর মিডিয়াপরিবেশিত
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ২৩তম পর্ব
গণতন্ত্র ও আকাবির উলামাদের ব্যাপারে আলোচনা
গণতন্ত্র সত্য হওয়ার পক্ষে একটি দলিল পেশ করা হয় যে, এটি যদি বাতিল হতো; তাহলে অনেক বড় বড় আকাবির উলামারা কেন তাতে জড়িয়েছেন?
এ ব্যাপারে আমরা আগেও আলোচনা করেছি যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকারীদের শক্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে কোনো ধারণাই ছিল না; বরং তা এমন এক শয়তানি ব্যবস্থা; তাতে যত চিন্তা করা হয়, তত প্রতারণা আবিষ্কৃত হয়। তত তাদের জন্য বদ-দুআ নির্গত হয়।
এ লোকগুলো ইসলাম, শরীয়াহ, আকায়েদ ও ফিকহে ইসলামীর গভীর জ্ঞান রাখতো। প্রাথমিক যুগে ইংরেজরা গণতন্ত্রকে এমনভাবে চালু করার প্রয়াস চালিয়েছে, যেমনটি এটিকে পশ্চিমে চালু করার জন্য করেছিল। কিন্তু শুধু উলামা কেন, সাধারণরাও একথা ভালোভাবে জানত যে, আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য মানা, বা আইন প্রণয়নের অধিকার আল্লাহ ছাড়া কাউকে দেওয়া- এটি শুধু কবীরা গোনাহই নয়; বরং কুফর। তাই এ প্রয়াস মুসলিম বিশ্বে প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে।
এরপর মুসলিম বিশ্বের জন্য এ সংশোধিত সংস্করণ পাঠানো হয়েছে, যাতে ইসলামী পরিভাষাসমূহ ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, সেটিকে ইসলামঘনিষ্ঠ প্রমাণিত করা।
তাই যেসব আলেম তাতে অংশ নিয়েছেন, তাদের সেই ভালো উদ্দেশ্যে ছিল, তারা এ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে শরীয়াহ আইন বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু সেটিকে কাছ থেকে ভালোভাবে দেখার পর এবং যাদের হাতে এ ব্যবস্থার চাবি রয়েছে, তাদেরকে ভালোভাবে বুঝার পর, সেসব উলামাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এটি নিছক প্রতারণা।
তাছাড়া আরও একটি ঐতিহাসিক সত্য সামনে রাখা আবশ্যক, সেই আকাবির উলামার সাথে তখনকার নেতারা দিনরাত ওয়াদা করত যে, আমরা দেশে শরীয়াহ আইন বাস্তবায়ন করব। এটির উপর ভিত্তি করেই উলামারা এ ব্যবস্থায় অংশ নিয়েছেন। তো এখন যদি সেই নেতারা প্রতারণা করে, উলামাদের দোষ কী?
তাই জ্ঞানীদের জন্য এটা সাজে না যে, এটিকে গণতন্ত্রের সত্যতার পক্ষে দলিল পেশ করে এমনভাবে বলা যে, গণতন্ত্র ভুল হলে আকাবিরগণ তা করতেন না।
এটি ভুল যে, নেতাদের শক্তির ভয়ে আপনারা কোনো দলিল ছাড়া সেই কুফরকে ইসলাম প্রমাণ করবেন এবং দলিলে আকাবিরদের নাম ব্যবহার করবেন। (আপনাদের কি এ অধিকার আছে?) তেমনি এটাও ভুল যে, এ গণতন্ত্রে অংশ নেওয়ার ফলে কোনো অতি উৎসাহী সেসব উলামাকে কাফির বলে দেবেন। মধ্যমপন্থা হলো, এসব আলেমকে অপারগ মনে করা হবে এবং গণতন্ত্রের কুফরী মানুষের সামনে স্পষ্ট করে দেওয়া হবে। ৩. আল্লাহ কর্তৃক অবৈধ ও হারামকৃত বস্তুকে বৈধ ও হালাল বানানো এবং অবশ্য পালনীয় ফরযকে হারাম ও অবৈধ বানানো:
এ জাহেলী ব্যবস্থায় একটি বড় শরীয়াহবিরোধী কাজ হলো, নিজেরাই যা ইচ্ছা বৈধ সাব্যস্ত করে, আর যা ইচ্ছা অবৈধ সাব্যস্ত করে। অথচ এ অধিকার আল্লাহ কাউকে দেননি।
وَقَالُوا هَٰذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ لَّا يَطْعَمُهَا إِلَّا مَن نَّشَاءُ بِزَعْمِهِمْ وَأَنْعَامٌ حُرِّمَتْ ظُهُورُهَا وَأَنْعَامٌ لَّا يَذْكُرُونَ اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا افْتِرَاءً عَلَيْهِ سَيَجْزِيهِم بِمَا كَانُوا يَفْتَرُونَ ﴿الأنعام: ١٣٨﴾
“তারা বলেঃ এসব চতুষ্পদ জন্তু ও শস্যক্ষেত্র নিষিদ্ধ। আমরা যাকে ইচছা করি, সে ছাড়া এগুলো কেউ খেতে পারবে না, তাদের ধারণা অনুসারে। আর কিছুসংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে আরোহন হারাম করা হয়েছে এবং কিছু সংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর উপর তারা ভ্রান্ত ধারনা বশতঃ আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না, তাদের মনগড়া বুলির কারণে, অচিরেই তিনি তাদের কে শাস্তি দিবেন।” (সূরা আন‘আম: ১৩৮)
আফসোস! এ গণতান্ত্রিক কুফরী ব্যবস্থাকে ইসলামী প্রমাণ করার জন্য শেষমেষ সেই কথাই বলা হয়, যা কুফফারে মক্কা দলিল দিতে ব্যর্থ হয়ে বলত-
وَقَالَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِن دُونِهِ مِن شَيْءٍ نَّحْنُ وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِن دُونِهِ مِن شَيْءٍ كَذَٰلِكَ فَعَلَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ ﴿النحل: ٣٥﴾
“মুশরিকরা বললঃ যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমরা তাঁকে ছাড়া কারও এবাদত করতাম না এবং আমাদের পিতৃপুরুষেরাও করত না এবং তাঁর নির্দেশ ছাড়া কোন বস্তুই আমরা হারাম করতাম না। তাদের পূর্ববর্তীরা এমনই করেছে। রাসূলের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র সুস্পষ্ট বাণী পৌছিয়ে দেয়া।” (সূরা নাহল: ৩৫)
৪. অসৎকর্মে আদেশ এবং সৎকর্মে বাধাপ্রদান
এ ব্যবস্থায় এ কাজটি রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাওবায় ইরশাদ করেছেন-
الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُم مِّن بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ نَسُوا اللَّهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ﴿التوبة: ٦٧﴾
“মুনাফেক নর-নারী সবারই গতিবিধি একরকম; শিখায় মন্দ কথা, ভাল কথা থেকে বারণ করে এবং নিজ মুঠো বন্ধ রাখে। আল্লাহকে ভুলে গেছে তার, কাজেই তিনিও তাদের ভূলে গেছেন নিঃসন্দেহে মুনাফেকরাই নাফরমান।” (সূরা তাওবা: ৬৭)
খেলাফতে উসমানিয়ার ধ্বংসের পর পৃথিবীর বুকে আল্লাহর শরীয়ত পুরোপুরি শাসিত ও পরাভূত হয়ে গেছে। মুসলিম ভূখণ্ডসমূহে শরীয়াহব্যবস্থা শেষ করে দিয়ে ইংরেজি, ফরাসি ও অন্যান্য মিশ্র ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫ খৃ.) পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যখন নিজেদের অধীনস্থ মুসলিম দেশগুলো ত্যাগ করছিল, তখন তারা খুব ভালোভাবেই খেয়াল রেখেছে যে, তাদের চলে যাওয়ার পরও যাতে কোনো ভূখণ্ডে মুহাম্মাদ ﷺ এর শরীয়াহ বাস্তবায়িত হতে না পারে। তাই অধিকাংশ মুসলিম দেশে গণতন্ত্র চালু করা হয় এবং এ কথা আবশ্যক করে দেওয়া হয় যে, কোনো মুসলিম দেশে শরীয়াহ চালু করা যাবে না। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘের চার্টারকে জীবনব্যবস্থা (ধর্ম) হিসেবে প্রত্যেক রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। সরকারগুলো এসব কানুন গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করছে। রাষ্ট্রের পুলিশবাহিনী তা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে।
ফলে মুসলিম সাম্রাজ্য থেকে ইসলামের কর্তৃত্ব শেষ হয়েছে। যে ব্যবস্থা মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার পোশাকটি নতুন হলেও তার বাস্তবতা ফেরআউন, নমরুদ, সামিরী, শাদদাদ, আবূ লাহাব ও আবূ জাহালদের মতোই ছেঁড়া ও পুরাতন। আসলে এ জীবনব্যবস্থা হলো, সেই পুরানো জাহিলিয়্যাতের নতুন সংস্করণ। এটির কর্তৃত্বকালীন মানুষ শুধু পাপাচারেই লিপ্ত হয় না; বরং পাপাচার প্রসার করার দাওয়াত, তার প্রতি অনুরাগ ও উৎসাহিতকরণ এবং পাপাচারের সব উপকরণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যোগাড় করা হয়। পাপাচারের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার দাওয়াত, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এগুলোর প্রচার ও সুরক্ষাদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব সাব্যস্ত হয়। সুদের ভাগাড় (ব্যাংক) হোক বা বেহায়াপনার আখড়া (মালিশকেন্দ্র, সিনেমাহল, ক্যাবল, টিভি, ইন্টারনেট, ক্যাফে ইত্যাদি) হোক বা গানবাজনার অনুষ্ঠান হোক- এদের কারো কোনো আশঙ্কা হলে রাষ্ট্রের আইনকৃংখলা বাহিনী তাদের নিরাপত্তা দেওয়াকে নিজেদের উপর ফরয মনে করে। এমন মুহূর্তে কোনো ঈমানদার পাপাচার রুখতে ওঠে দাঁড়ালে তাকে লাল-মাসজিদ ও জামিয়া হাফসার মতো টার্গেট করা হয়।
মুহাম্মাদ ﷺ এর শরীয়তকে রুখার জন্য রাষ্ট্রের সব শাখা (সরকার, প্রশাসন, বিচারবিভাগ, গণমাধ্যম) নিজেদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। তেমনিভাবে ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করা, ইসলামের নিদর্শনাবলি (দাড়ি, টুপি, হুদূদ-কিসাস ইত্যাদি) কে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা, উম্মাহকে জিহাদ থেকে দূরে সরানোর বিভিন্ন পায়তারা করা, মাদরাসা, উলামা ও দ্বীনিশিক্ষার প্রতি ঘৃণা ছড়ানো ওদের মৌলিক মিশনের অন্তর্ভুক্ত।