কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত:
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা
(প্রথম খণ্ড)
-শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
মূল প্রকাশনায়:
আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)
সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
দ্বিতীয় ভাগঃ
সিরিয়ার জেসুইট পাদ্রীদের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
এই আলোচনাকে আমি যে কয় ভাগে বিভক্ত করেছি—
১- ক্রুসেডার এবং ম্যারোনাইট
২- লেভান্টের ক্যাথলিকদেরকে ফ্রান্সের পৃষ্ঠপোষকতা
৩- লেভান্টে জেসুইট পাদ্রীদের ইতিহাস
৪- তাদের প্রধান কার্যক্রম
৫- তাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের উদাহরণ
ম্যারোনাইটরা হল মাউন্ট লেবাননের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খ্রিস্টান সম্প্রদায়। তারা সিরিয়ার সন্ন্যাসী সেন্ট মারুনের নামের দিকে সম্বন্ধিত করে নিজেদের এ নাম রেখেছে, যিনি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর শেষ এবং পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিককার একজন সন্ন্যাসী ছিলেন। সেইসাথে জন মারুনের নামের দিকেও তাদের সম্বন্ধ (৬৮৫—৭০৭ খ্রিস্টাব্দ), যিনি অ্যান্টিওকের পিতৃপুরুষ এবং ম্যারোনাইটদের প্রথম উর্দ্ধতন পুরুষ। তিনি বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান দ্বিতীয়ের সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করেছিলেন এবং ম্যারোনাইটদেরকে স্বতন্ত্র জাতিসত্তা উপহার দিয়েছিলেন।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে তারা খ্রিস্টের ইচ্ছার একক প্রকৃতির মতবাদ গ্রহণ করেছে। এর ধারণা দিয়েছিলেন কনস্টান্টিনোপলের প্যাট্রিয়ার্ক সার্জিয়াস (মৃত্যু ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ), রোম চার্চের দৃষ্টিতে যিনি ধর্মবিরোধী বলে বিবেচিত ছিলেন। ম্যারোনাইটদের এই মতবাদ সে কারণেই রোম-চার্চের মতবাদ বিরোধী ছিল। রোম-চার্চের বিশ্বাস ছিল, যিশুখ্রিস্টের মাঝে দুই ধরনের সহজাত ইচ্ছার বিদ্যমানতা ছিল; একটি হলো ধর্মতাত্ত্বিক অপরটি হলো মানবিক।
যোহন (জন) মারুন সম্রাট জাস্টিনিয়ান দ্বিতীয় এবং রোমের পোপ প্রথম সেরগিয়াস (মৃত্যু ৭০১ খ্রিস্টাব্দ) -এর মধ্যে একটি বিরোধের সুযোগ নিয়ে পোপের প্রতি তার সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন। এইভাবেই পোপ তাকে অ্যান্টিওকের প্যাট্রিয়ার্ক হিসাবে অনুমোদন করেছিলেন।
১১৮২ সালে, ম্যারোনাইট প্যাট্রিয়ার্ক, অ্যান্টিওকের ল্যাটিন প্যাট্রিয়ার্কের সাথে একতা গড়ার প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন, কিন্তু সে ঐক্য সাধিত হতে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বিশেষ করে জেসুইট জন এলিয়ানোর অবদান এই ঐক্য সাধনের পেছনে উল্লেখযোগ্য। এই ঐক্যের দ্বারা ম্যারোনাইট চার্চ রোমের পোপের অনুগত হয়ে যায়। ।
১৫৮৪ সালে, পোপ গ্রেগরি XIII (ত্রয়োদশ) রোমে ম্যারোনাইট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জেসুইটদের প্রশাসনের অধীনে চালু ছিল। সেটি ছিল ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র[1]।
লেভান্টে যখন ক্রুসেড শুরু হয়, তখন মেরুনরা তাদের সাথে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করে এবং মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডারদেরকে সহায়তায় তারা একই প্লাটফর্মে অবস্থান করে[2]।
নিজেদের গ্রন্থে তারা স্বীকারও করেছে— “তাদের প্রতি পুরোপুরি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা ছিল। তাদের একটি নগণ্য অংশ তাদের সাথে জেরুজালেমে যাত্রা করেছিল। সকল বিষয়ে তাদের (ক্রুসেডারদের) খুবই উপকারে এসেছিল তারা। এ অবস্থায়ই সকলে মিলে পবিত্র শহর জয় করেছিল এবং তারাও গনিমতের একটি অংশ লাভ করেছিল।”
ক্রুসেডাররাও তাদেরকে যথাযথ প্রতিদান দিয়েছিল। ল্যাটিন বুর্জোয়া গোষ্ঠী যেসব সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করত, জেরুজালেম রাজ্যে জমিদারি ছিল যার অন্তর্ভুক্ত, সে সব সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে ক্রুসেডাররা তাদেরকে পুরস্কৃত করেছিল।
কিন্তু ক্রুসেড শেষ হওয়ার পর মামলুকরা তাদের থেকে কঠিন প্রতিশোধ নিয়েছিল[3]।
মিশর, লেভান্ট ও পূর্বাঞ্চলে ক্রুসেডার আন্দোলনের ব্যর্থতার পর, পশ্চিম দেশীয় চার্চ খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, খ্রিস্টান ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সশস্ত্র পন্থা অকার্যকর। তখন তারা তাদের মতাদর্শ প্রচার প্রসারের জন্য মিশনারি মিশন গ্রহণ করে নেয়[4]।
***খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে তারা খ্রিস্টের ইচ্ছার একক প্রকৃতির মতবাদ গ্রহণ করেছে। এর ধারণা দিয়েছিলেন কনস্টান্টিনোপলের প্যাট্রিয়ার্ক সার্জিয়াস (মৃত্যু ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ), রোম চার্চের দৃষ্টিতে যিনি ধর্মবিরোধী বলে বিবেচিত ছিলেন। ম্যারোনাইটদের এই মতবাদ সে কারণেই রোম-চার্চের মতবাদ বিরোধী ছিল। রোম-চার্চের বিশ্বাস ছিল, যিশুখ্রিস্টের মাঝে দুই ধরনের সহজাত ইচ্ছার বিদ্যমানতা ছিল; একটি হলো ধর্মতাত্ত্বিক অপরটি হলো মানবিক।
যোহন (জন) মারুন সম্রাট জাস্টিনিয়ান দ্বিতীয় এবং রোমের পোপ প্রথম সেরগিয়াস (মৃত্যু ৭০১ খ্রিস্টাব্দ) -এর মধ্যে একটি বিরোধের সুযোগ নিয়ে পোপের প্রতি তার সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন। এইভাবেই পোপ তাকে অ্যান্টিওকের প্যাট্রিয়ার্ক হিসাবে অনুমোদন করেছিলেন।
১১৮২ সালে, ম্যারোনাইট প্যাট্রিয়ার্ক, অ্যান্টিওকের ল্যাটিন প্যাট্রিয়ার্কের সাথে একতা গড়ার প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন, কিন্তু সে ঐক্য সাধিত হতে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বিশেষ করে জেসুইট জন এলিয়ানোর অবদান এই ঐক্য সাধনের পেছনে উল্লেখযোগ্য। এই ঐক্যের দ্বারা ম্যারোনাইট চার্চ রোমের পোপের অনুগত হয়ে যায়। ।
১৫৮৪ সালে, পোপ গ্রেগরি XIII (ত্রয়োদশ) রোমে ম্যারোনাইট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জেসুইটদের প্রশাসনের অধীনে চালু ছিল। সেটি ছিল ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র[1]।
লেভান্টে যখন ক্রুসেড শুরু হয়, তখন মেরুনরা তাদের সাথে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করে এবং মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডারদেরকে সহায়তায় তারা একই প্লাটফর্মে অবস্থান করে[2]।
নিজেদের গ্রন্থে তারা স্বীকারও করেছে— “তাদের প্রতি পুরোপুরি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা ছিল। তাদের একটি নগণ্য অংশ তাদের সাথে জেরুজালেমে যাত্রা করেছিল। সকল বিষয়ে তাদের (ক্রুসেডারদের) খুবই উপকারে এসেছিল তারা। এ অবস্থায়ই সকলে মিলে পবিত্র শহর জয় করেছিল এবং তারাও গনিমতের একটি অংশ লাভ করেছিল।”
ক্রুসেডাররাও তাদেরকে যথাযথ প্রতিদান দিয়েছিল। ল্যাটিন বুর্জোয়া গোষ্ঠী যেসব সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করত, জেরুজালেম রাজ্যে জমিদারি ছিল যার অন্তর্ভুক্ত, সে সব সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে ক্রুসেডাররা তাদেরকে পুরস্কৃত করেছিল।
কিন্তু ক্রুসেড শেষ হওয়ার পর মামলুকরা তাদের থেকে কঠিন প্রতিশোধ নিয়েছিল[3]।
মিশর, লেভান্ট ও পূর্বাঞ্চলে ক্রুসেডার আন্দোলনের ব্যর্থতার পর, পশ্চিম দেশীয় চার্চ খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, খ্রিস্টান ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সশস্ত্র পন্থা অকার্যকর। তখন তারা তাদের মতাদর্শ প্রচার প্রসারের জন্য মিশনারি মিশন গ্রহণ করে নেয়[4]।
সংখ্যা বিচারে ক্যাথলিক সম্প্রদায়কে লেভান্টের সবচেয়ে বড় খ্রিস্টান সম্প্রদায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এতে অনেকগুলো গোত্র ও উপশাখা রয়েছে। যেমন ম্যারোনাইটস, অ্যারামিয়ান, ল্যাটিন ও সিরিয়াক।
এই সম্প্রদায়টি মূলত রোমের সাথে যুক্ত ছিল। জেসুইট ও ল্যাটিন মিশনারীরা এ সম্প্রদায়ের মাঝে তাদের সমস্ত পরিষেবা, বিশেষ করে তাদেরকে শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সুরক্ষা প্রদানের জন্য কাজ করেছিল।
ইউরোপীয় দেশগুলি লেভান্টের খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলির কাছ থেকে তাদের বিষয়ে হস্তক্ষেপের ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছিল। তাই সে সময় ফ্রান্স ক্যাথলিকদেরকে নিরাপত্তা দেবার দাবি করেছিল। রাশিয়া নিয়েছিল অর্থোডক্সদেরকে রক্ষার দায়িত্ব। আর পরবর্তী সময়ে ব্রিটেন প্রোটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেবার এবং তাদেরকে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য নিজেদের শাসককে রাজি করিয়ে নিয়েছিল[5]।
খ্রিস্টান একেক গোষ্ঠীকে ইউরোপের একেকটি রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থন ও সুরক্ষা প্রদানের এই রাজনীতির কারণে দেশগুলোর মাঝে সংঘাত আরম্ভ হয়ে যায়। এমনকি এক পর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের বিষয়েও তারা হস্তক্ষেপ করতে আরম্ভ করে।
আর ফ্রান্স যেহেতু লেভানটে ক্যাথলিক গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি এবং তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল, তাই বিশেষভাবে ম্যারোনাইটদের সঙ্গে ফ্রান্সের আলাদা ধরনের সম্পর্ক ছিল এবং ম্যারোনাইটরাও এ নিয়ে ছিল গর্বিত। তারা নিজেদেরকে মনে করতো—এমনিভাবে ফরাসিরাও তাদেরকে মনে করত—'প্রাচ্যের ফরাসি'[6]।
ফরাসি রাজা লুই নবমকে মনে করা হয় তাদের প্রথম ফরাসি বন্ধু। পনের হাজার ম্যারোনাইট নাইটের একটি প্রতিনিধি দল তার কাছে এসেছিল, যখন তিনি 'একরে'র এক স্থানে গিয়েছিলেন। প্রতিনিধিদলটি বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে এসেছিল। এই উপলক্ষে তিনি ২১/৫/১২৫০ তারিখে তাদের হাতে একটি চিঠি তুলে দেন। সেই চিঠিতে তিনি তাদেরকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। সেখানে বলা হয়েছে: "আমরা নিশ্চিত, সেন্ট মারন নামে পরিচিত এই দলটি আমাদের ফরাসি সম্প্রদায়েরই অংশ।"[7]
১৬৪৯ সালে, ফ্রান্সের রাজা লুই চতুর্দশ ম্যারোনাইট সম্প্রদায়কে রক্ষার কথা ঘোষণা করেন। এই গোষ্ঠীকে তিনি ফরাসি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করতেন। তিনি লেভান্টস্থ ফরাসি কনসালদেরকে তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু সরবরাহ এবং তাদেরকে সুরক্ষা প্রদান করতে বলেন। অটোমান সাম্রাজ্যের কর্মচারীদের কাছেও যেন তাদের অযত্ন না হয়, তিনি সে বিষয়ে বলে দেন।
১৭৩৭ সালে রাজা লুই পঞ্চদশও তাদেরকে সুরক্ষার কথা পুনর্বার উল্লেখ করেন। সেসময় তিনি ঘোষণা করেছিলেন: "আমরা তাদেরকে আমাদের সুরক্ষা ও তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করছি, যাতে সময়ের সঙ্গে পথচলায় তারা পূর্ণমাত্রায় উপকৃত হতে পারে।" তিনিও লেভান্টস্থ ফরাসি কনসালদেরকে বলে দিয়েছিলেন, "নিজেদের অধ্যবসায়, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা ও সুরক্ষাগুণ দিয়ে অ্যান্টিওকের পবিত্র পিতাকে এবং সর্বত্র সমস্ত ম্যারোনাইট খ্রিস্টানকে আপনারা সাহায্য করুন।"[8]
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ড্রুজ এবং ম্যারোনাইটদের [9] মধ্যে ঘটে যাওয়া ঝামেলার পরে তৃতীয় নেপোলিয়ন একটি ফরাসি দল পাঠাবার আগ পর্যন্ত সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থনের এই ধারা অব্যাহত ছিল। ম্যারোনাইট কবি ও পুরোহিত হান্না রা'দ ১৮৬০ সালে লেখা তাঁর কবিতায় এই সমর্থনের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই কবিতায় প্রভুর ভাষায় তিনি বলেছেন—(আল্লাহ তায়ালা এ সব থেকে পবিত্র এবং বহু ঊর্ধ্বে)—
حتّام تفترسُ الذئاب رعيَّتي فقطيعيَ المختار كاد يُقطَّعُএই সম্প্রদায়টি মূলত রোমের সাথে যুক্ত ছিল। জেসুইট ও ল্যাটিন মিশনারীরা এ সম্প্রদায়ের মাঝে তাদের সমস্ত পরিষেবা, বিশেষ করে তাদেরকে শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সুরক্ষা প্রদানের জন্য কাজ করেছিল।
ইউরোপীয় দেশগুলি লেভান্টের খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলির কাছ থেকে তাদের বিষয়ে হস্তক্ষেপের ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছিল। তাই সে সময় ফ্রান্স ক্যাথলিকদেরকে নিরাপত্তা দেবার দাবি করেছিল। রাশিয়া নিয়েছিল অর্থোডক্সদেরকে রক্ষার দায়িত্ব। আর পরবর্তী সময়ে ব্রিটেন প্রোটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেবার এবং তাদেরকে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য নিজেদের শাসককে রাজি করিয়ে নিয়েছিল[5]।
খ্রিস্টান একেক গোষ্ঠীকে ইউরোপের একেকটি রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থন ও সুরক্ষা প্রদানের এই রাজনীতির কারণে দেশগুলোর মাঝে সংঘাত আরম্ভ হয়ে যায়। এমনকি এক পর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের বিষয়েও তারা হস্তক্ষেপ করতে আরম্ভ করে।
আর ফ্রান্স যেহেতু লেভানটে ক্যাথলিক গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি এবং তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল, তাই বিশেষভাবে ম্যারোনাইটদের সঙ্গে ফ্রান্সের আলাদা ধরনের সম্পর্ক ছিল এবং ম্যারোনাইটরাও এ নিয়ে ছিল গর্বিত। তারা নিজেদেরকে মনে করতো—এমনিভাবে ফরাসিরাও তাদেরকে মনে করত—'প্রাচ্যের ফরাসি'[6]।
ফরাসি রাজা লুই নবমকে মনে করা হয় তাদের প্রথম ফরাসি বন্ধু। পনের হাজার ম্যারোনাইট নাইটের একটি প্রতিনিধি দল তার কাছে এসেছিল, যখন তিনি 'একরে'র এক স্থানে গিয়েছিলেন। প্রতিনিধিদলটি বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে এসেছিল। এই উপলক্ষে তিনি ২১/৫/১২৫০ তারিখে তাদের হাতে একটি চিঠি তুলে দেন। সেই চিঠিতে তিনি তাদেরকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। সেখানে বলা হয়েছে: "আমরা নিশ্চিত, সেন্ট মারন নামে পরিচিত এই দলটি আমাদের ফরাসি সম্প্রদায়েরই অংশ।"[7]
১৬৪৯ সালে, ফ্রান্সের রাজা লুই চতুর্দশ ম্যারোনাইট সম্প্রদায়কে রক্ষার কথা ঘোষণা করেন। এই গোষ্ঠীকে তিনি ফরাসি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করতেন। তিনি লেভান্টস্থ ফরাসি কনসালদেরকে তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু সরবরাহ এবং তাদেরকে সুরক্ষা প্রদান করতে বলেন। অটোমান সাম্রাজ্যের কর্মচারীদের কাছেও যেন তাদের অযত্ন না হয়, তিনি সে বিষয়ে বলে দেন।
১৭৩৭ সালে রাজা লুই পঞ্চদশও তাদেরকে সুরক্ষার কথা পুনর্বার উল্লেখ করেন। সেসময় তিনি ঘোষণা করেছিলেন: "আমরা তাদেরকে আমাদের সুরক্ষা ও তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করছি, যাতে সময়ের সঙ্গে পথচলায় তারা পূর্ণমাত্রায় উপকৃত হতে পারে।" তিনিও লেভান্টস্থ ফরাসি কনসালদেরকে বলে দিয়েছিলেন, "নিজেদের অধ্যবসায়, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা ও সুরক্ষাগুণ দিয়ে অ্যান্টিওকের পবিত্র পিতাকে এবং সর্বত্র সমস্ত ম্যারোনাইট খ্রিস্টানকে আপনারা সাহায্য করুন।"[8]
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ড্রুজ এবং ম্যারোনাইটদের [9] মধ্যে ঘটে যাওয়া ঝামেলার পরে তৃতীয় নেপোলিয়ন একটি ফরাসি দল পাঠাবার আগ পর্যন্ত সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থনের এই ধারা অব্যাহত ছিল। ম্যারোনাইট কবি ও পুরোহিত হান্না রা'দ ১৮৬০ সালে লেখা তাঁর কবিতায় এই সমর্থনের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই কবিতায় প্রভুর ভাষায় তিনি বলেছেন—(আল্লাহ তায়ালা এ সব থেকে পবিত্র এবং বহু ঊর্ধ্বে)—
ولقد أقمتُ لنصر شعبي ظافراً بطلاً تخرُّ لهُ الجهات الأربعُ
صحنا وكان إلى فرنس الصوت: يا نابوليون. أجابنا: لا تجزعوا
إني لمنجدكم وكاشفُ كَربكم برضى الإلهِ سواهُ فخراً يُمنعُ
"নেকড়ে আর কতদিন পর্যন্ত আমার মেষ শিকার করবে? আর আমার পছন্দের পাল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে?
আমি তো আমার জনগণকে বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এমন এক বীরকে পাঠিয়ে দিয়েছি, চতুর্দিক যার আগমনে নত হয়ে যায়।
আমি চিৎকার করলাম। ফ্রান্স অভিমুখে আওয়াজ গেল: হে নেপোলিয়ন! আমি জবাব দিলাম: তোমরা আতঙ্কিত হয়ো না;
আমি হলাম তোমাদের উদ্ধারকারী, আমি তোমাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করি, তোমাদের দুর্দশা দূরীভূত করি, ঈশ্বরের সন্তুষ্টিতে। তাকে ছাড়া অহংকার নিষিদ্ধ।"
সেই কবিতার ভেতরেই ফরাসি আক্রমণের প্রশংসায় বলা হয়েছে-
لولاكِ لم يشرق نهارُ سلامة فينا ولا زال الشقا المستفظعُ
"হে ফ্রান্স! আল্লাহর তাওফীকে তোমার সকল কৃতিত্ব!! তুমি ধর্ম ও জগতের কেন্দ্রস্থল। তুমিই প্রত্যাবর্তনের চূড়ান্ত স্থল।
যদি তুমি না থাকতে, তাহলে প্রশান্তিময় প্রভাত উদিত হতো না আমাদের মাঝে, আর ভয়ানক দুর্ভাগ্যের নিকষ কালো রাতও বিদায় হতো না"
জেসুইট লুই শেখো ফ্রান্সের প্রতি তার ভালবাসা লুকিয়ে রাখতে পারেননি। তাই তিনি ফ্রান্স সম্পর্কে বলেছিলেন: "এর দীর্ঘ কীর্তনশ্লোক বর্ণনা-সুষমায় রচিত, বদান্যতা ও নম্রতার উচ্ছল ধারা সেই বর্ণনায় হয় প্রবাহিত।"[10]
এই সমর্থন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেও দেখা গিয়েছিল, যখন লেবানন ফরাসি ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল।[11]
খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলো বিশেষ করে তন্মধ্যে প্রোটেস্ট্যান্ট গ্রুপগুলোই ছিল মিশনারিদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু। তাই তারা খ্রিস্টান সেই গ্রুপগুলোর অবস্থা অধ্যয়ন, তাদেরকে শিক্ষাগত ও সামাজিক পরিষেবা প্রদান এবং তাদের মধ্যে নতুন ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছিল।
এই কার্যকলাপ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষের জন্ম দেয়। ক্যাথলিকরা আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনের সামনে একটি হোঁচট খায়। এই ক্যাথলিকদের অগ্রভাগেই ছিল ম্যারোনাইটরা।[12]
ম্যারোনাইট সম্প্রদায়টি ছিল আমেরিকান সংস্কৃতির মতো ফরাসী সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষী সংস্কৃতির প্রতি সবচেয়ে শত্রু মনোভাবাপন্ন সম্প্রদায়গুলোর অন্যতম। ম্যারোনাইট চার্চ এমন লোকদের প্রতি অত্যন্ত হিংস্র ছিল যারা অন্যান্য গির্জায়, বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্টবাদে ধর্মান্তরিত হত। এ কারণেই তারা লেভান্টে আমেরিকান মিশনারি কার্যকলাপের এতটা প্রবল বিরোধিতা করেছিল।[13]
যে সমস্ত মেরোনাইট প্রোটেস্ট্যান্টদের কাছে যাবে, তাদের সাথে সদাচরণ করবে, তাদের অনুরোধ পূরণ করবে, তাদেরকে বাসস্থান ভাড়া দেবে বা তাদের দেশে বসবাস করতে সহায়তা করবে, ম্যারোনাইট প্যাট্রিয়ার্ক এমন সকলকে বঞ্চিত করার হুমকি দেয়।
এমনিভাবে অর্থোডক্স মতাবলম্বী খ্রিস্টানরাও তাদের মতাদর্শের যারাই প্রোটেস্ট্যান্ট[14] মতাদর্শের প্রতি ঝুঁকে যেত, তাদেরকে নির্যাতন-নিপীড়ন করত।
'জাহেলে'র ওপর জেসুইটদের সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ছিল।
প্রোটেস্ট্যান্টরা এসে সেই সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত তাদের সেই দখল বজায় ছিল। কিন্তু জেসুইটরা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারঙ্গম ছিল।[15]
ম্যারোনাইটরা অটোমান সাম্রাজ্যকে একটি বিদেশী দখলদার রাষ্ট্র হিসাবে দেখত, অথচ বিদেশী ফরাসি সেনাবাহিনীর দ্বারা তাদের দেশ দখল হওয়াকে তারা নিজেদের স্বাধীনতার বিরোধী বলে মনে করতো না। তাদের বিশ্বাস ছিল, ফরাসি উপস্থিতি তাদের স্বাধীনতাকে কিছু মাত্রও ব্যাহত করে না।[16]
লেভান্টের জেসুইট মিশনারিরা স্কুল চালু করতে এবং বিশেষ করে ম্যারোনাইটদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করতে কাজ করত। এভাবেই তাদের দল লেভান্টের সবচেয়ে শিক্ষিত ও প্রভাবশালী দলগুলোর অন্যতম হয়ে ওঠে। রোমের পোপ ক্যাথলিক সম্প্রদায়কে সাহায্য করতে দ্বিধা করেননি, বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচাররোধ, বিশেষ করে আমেরিকান মিশনারীদের মোকাবেলায় [17] ক্যাথলিকদেরকে সহায়তা করতে তাদের কাছে পাদ্রী প্রেরণ করেন।
অর্থোডক্সকে ক্যাথলিক মতাদর্শে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারকদের তৎপরতার ফলশ্রুতিতে অটোমান সাম্রাজ্য তার প্রতি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে আলেপ্পোর গভর্নরের প্রতি ইউরোপীয় সেসব পাদ্রীর কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য শরীফ হুমায়ুনীর নির্দেশ জারি হয়, যারা একাজে তৎপর ছিল।
এরপর ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্য এই একই অবস্থান গ্রহণ করে। তাই সুলতান; মুহাম্মদ আলী পাশা, বিচারক ও পণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে একটি ডিক্রি জারি করেন। তাতে তিনি ওইসব ক্যাথলিক মিশনারির কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্য সতর্ক করে দেন, যারা অর্থোডক্স মতাদর্শকে ক্যাথলিক ধর্মে রূপান্তর করতে তৎপর ছিল।
এভাবেই, অটোমান সাম্রাজ্য সেসব ক্যাথলিক মিশনারির মুখোমুখি হয়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিল, যেগুলো অর্থোডক্স মতাদর্শকে ক্যাথলিক ধর্মে রূপান্তর করার জন্য তৎপর ছিল। সেই মিশনারীগুলোকে আদেশ মেনে চলতে বাধ্য করা হয়েছিল, কারণ রাষ্ট্র তখনও ক্ষমতায় বেশ পাকাপোক্ত ছিল। তাই মিশনারিগুলো সেরকম স্বাধীনভাবে আন্দোলন পরিচালনা করতে সাহস করেনি, পরবর্তীতে যা তারা করতে সক্ষম হয়েছিল।
উলামায়ে কেরাম এই মিশনের ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছিলেন এই ভিত্তিতে যে, তাদের কার্যকলাপ অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল। কারণ তারা মনে করেছিলেন, গোটা কুফুরি বিশ্ব একজোট; এক জাতি। তারা বুঝতে পারেননি, পরবর্তীতে এই মিশনারি মুসলমানদেরকে খ্রিস্টান বানাবার জন্য তৎপর হয়ে উঠবে। যখন আমেরিকান মিশন তাদের বিরুদ্ধে নিবিড়ভাবে কাজ শুরু করে, তখন মুসলিম খৃস্টানাইজেশন ক্যাথলিকরা ঠিকই আরম্ভ করেছিল।
পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রের দুর্বলতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে ১৮৩৯ থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিন্যাস প্রক্রিয়াগুলোর পর এবং সেসব প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে যে সমস্ত নিয়মকানুন জারি করতে রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছিল, সেই সময়টার পর ক্যাথলিক কার্যক্রম আর সেভাবে ঠেকানো যায়নি। এছাড়াও অপরদিকে আরো বিভিন্ন মিশনারি কার্যক্রম বিশেষ করে আমেরিকান কার্যক্রম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তারা লেভান্টে [18] খ্রিস্টানাইজেশন আরম্ভ করে দিয়েছিল।
অটোমান সাম্রাজ্যে বিদেশী সুযোগ-সুবিধা:
গবেষণার এই পয়েন্টে আমি সংক্ষেপে ঐ সমস্ত সুযোগ সুবিধা নিয়ে আলোচনা করতে চাই, অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে পশ্চিমারা যেগুলো আদায় করে নিয়েছিল। মুসলমানদের মাঝে পশ্চিমা মিশন পরিচালনার ক্ষেত্রে সেসব সুযোগ-সুবিধা ধর্মপ্রচারকদের জন্য বেশ সহায়ক ছিল।
এগুলো উসমানীয় সাম্রাজ্যে থাকা বিদেশী দেশগুলির নাগরিকদের, সেখানের পর্যটকদের বা সে অঞ্চল অতিক্রমকারীদের সুবিধা দানের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল। অটোমানদের নিজেদের সে সমস্ত সুযোগ সুবিধা ছিল না।
সে সব সুযোগ-সুবিধার মাঝে অন্যতম প্রসিদ্ধ কিছু নিম্নরূপ:
• এই বিদেশীদের প্রত্যক্ষ কর এবং শুল্কের একটি বড় অংশ থেকে অব্যাহতিদান।
• অটোমান কর্তৃপক্ষের যে কোন কারণেই বিদেশী বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না থাকা, এমনকি যদি সেই বাড়িতে কোনও অপরাধও সংঘটিত হয়ে থাকে, তবু অটোমান কর্তৃপক্ষ তদন্তের জন্য সেখানে প্রবেশ করার অধিকার রাখত না। বরং, যার তদন্ত ও বিচার করার ক্ষমতা থাকত, সে হলো ওই বাড়ির কনসাল - সেই বাড়ির বাসিন্দা ও গৃহকর্তা। নিজ দেশের আইন অনুসারে তার ফয়সালা করার বিধান ছিল। তবে শাস্তি কার্যকর করার জন্য অটোমান কর্তৃপক্ষকে সহায়তার অনুরোধ করার অধিকার ছিল তার।
• সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী সকল বিদেশি বসবাসকারীর বাড়িকে তাদের মাতৃদেশের অংশ বলে বিবেচনা করা।
• বিশেষ সে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগের অধিকার প্রাপ্ত প্রত্যেক বিদেশীর নিজের পছন্দ মতো অটোমান দেশে ঘোরাঘুরি করার অধিকার থাকা। এমতাবস্থায় দুর্ভাগ্যক্রমেও যদি তার সঙ্গে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তবে তার সরকার কয়েক গুণ বেশি ক্ষতিপূরণ অটোমান সরকারের কাছে দাবি করতে পারা। আবার কখনও কখনও এমন দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্গত ব্যক্তির সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও নূতন নূতন বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের জন্য কঠোরতা দেখাতো।
• অটোমান আইন অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসকারী বিদেশীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল না।
বাইজেন্টাইন রাষ্ট্র ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোকে এই সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতো। নিজেদের দুর্বলতার কথা চিন্তা করে তারা এমনটা করত। অতঃপর অটোমান সাম্রাজ্য যখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য দখল করে, তখন পশ্চিমা দেশগুলো বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে অটোমান কর্তৃক দখলকৃত অঞ্চলে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষাধিকার বজায় রাখার ব্যাপারে আকাঙ্ক্ষী ছিল।
কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো ষোড়শ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। যখন সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসিয়েন্ট ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়াকে তার প্রজাদের ব্যাপারে অটোমান রাষ্ট্রসীমানায় অবস্থানকালে কিংবা সেখান থেকে অতিক্রমকালে কিছু বাণিজ্যিক ও আইনগত সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সম্মত হয়েছিলেন, সে সময় থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরম্ভ করে।
এখানে দু'টো বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথমত: যে ব্যক্তিকে ফ্রান্সের পক্ষে এসব সুযোগ-সুবিধা লাভের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি হলেন পাদ্রী ডি লা ফাউস্ট। সেন্ট জন ক্রুসেড যুদ্ধের অন্যতম নাইট তিনি। পরবর্তীতে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যে ফ্রান্সের প্রথম রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত: এই সুবিধাগুলো একজন দুর্বল তুর্কি সুলতান একজন বিজয়ী খ্রিস্টান রাজাকে দেননি। বরং, সেসময় অটোমান সাম্রাজ্য তার ক্ষমতার শীর্ষে ছিল। কারণ প্রথম ফ্রাঁসোয়ার তখনও দশ বছর আগের ইতালির পাভিয়ার যুদ্ধে নিজের পরাজয়ের প্রভাব নিয়ে আক্ষেপ ছিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে। আর সেই দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি দেশগুলোর অনিষ্ট বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন বিদেশী সুযোগ-সুবিধাগুলো কেবল ফরাসিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ডাচ, ইতালীয় এবং স্পেনীয়দের জন্যও সেগুলো অবারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমেরিকান, অস্ট্রিয়ান, রাশিয়ান এবং গ্রীকরা এমনকি খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর ভেতর বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ এসব সুযোগ-সুবিধার আওতায় চলে আসে।
অবশেষে, অটোমান সাম্রাজ্যের অমুসলিম জনগণ ও গোষ্ঠীগুলো ব্যক্তিগত মর্যাদা এবং সামরিক দায় দায়িত্ব সহ বিভিন্ন ট্যাক্স ও আইনি মামলা থেকে অব্যাহতি সম্পর্কিত গোষ্ঠীগত স্বাধীনতা উপভোগ করতে আরম্ভ করে। এমনকি কোনো অপরাধী যদি অপরাধে লিপ্ত হবার পর তার কন্সালের কাছে আশ্রয় নিত কিংবা সুযোগ-সুবিধার অধিকারী কোন বিদেশীর ঘরে আত্মগোপন করত, তাহলে তদন্ত কমিশন এবং উসমানীয় বিচার বিভাগ তার কাছে পৌঁছুতে পারতো না।
কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই সুযোগ-সুবিধা বাতিল করা হয়।
এই সুবিধাগুলোর কারণে বিদেশী দেশগুলোর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স অটোমান সাম্রাজ্যের সেসব বিদেশি গোষ্ঠীর ব্যাপার (সুরক্ষা) নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছিল, যাদের ইস্তাম্বুলে কোন প্রতিনিধি ছিল না। আর্মেনিয়ান, বুলগেরিয়ান, মন্টেনেগ্রিনরা এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশ যেমন আর্জেন্টিনা, চিলি ও মেক্সিকোর লোকেরা, অটোমান সাম্রাজ্যে তাদের দেশের কোনো প্রতিনিধি বা কন্সাল না থাকার কারণে, বিদেশী সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারত না। কিন্তু তারা যদি ফ্রান্স অথবা ইংল্যান্ডের সহায়তা ও নিরাপত্তা লাভ করতে সক্ষম হতো, যা তাদের পক্ষে ছিল খুবই সহজসাধ্য ব্যাপার, তখন আবার তারা অটোমান সাম্রাজ্যে ফরাসী ও ইংরেজদের মত সকল সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারত।
ব্রিটিশ ও ফরাসি কতক মন্ত্রী ও কনসাল 'আস্তানা'য় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব না করা দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই কর্তৃত্বের অপব্যবহার করেছিলেন এবং তারা সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
অতঃপর অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতা বৃদ্ধি পায়। সেইসঙ্গে এ জাতীয় সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদানে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের দুঃসাহস বাড়তে থাকে। তাই তারা নিজেরাই অটোমান প্রজাদের এমন বেশ কয়েকজনের জন্য সে সব সুযোগ-সুবিধা মঞ্জুর করে, যারা বিভিন্নভাবে সেগুলো কাজে লাগানোর জন্য বড় অংকে এই দুই দেশের নিরাপত্তা ক্রয় করেছে কিংবা যাদের দিয়ে আশা ছিল যে, ফ্রান্স ইংল্যান্ড কোন না কোনভাবে তাদেরকে দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করতে পারবে।
মিশনারিরা বুঝতে পেরেছিল যে, তারা বিদেশী সুযোগ-সুবিধার আশ্রয় নিয়ে কিভাবে লাভবান হতে পারবে। তাই তারা সেগুলো লুফে নিয়ে সারাদেশে বিদেশি সেজে ঘোরাঘুরি করতো আর ভেতরে ভেতরে ধর্মপ্রচার করত।[19]
জেসুইটরা ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে আলেপ্পোতে আসে। তারা ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে মঠ স্থাপন করে এবং ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে সিডন পর্যন্ত এবং ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপোলি পর্যন্ত নিজেদের বিস্তার ঘটায়। ১৭৩৪ সালে মাউন্ট লেবাননের কেসরোয়ান জেলার আইন তোরাতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাদের মঠ বন্ধ করে লাজি পাদ্রীদের হাতে অর্পণ করা হয়। ১৮৩১সালে যখন পোপ ষোড়শ গ্রেগরি তাদেরকে সিরিয়ায় যেতে এবং সেখানে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এর আগে তারা আর লেভান্টে ফিরে আসেনি। সে সময় আমেরিকান মিশনারিদের আগমন অনুসরণ করে তারা বৈরুতে ফিরে আসে। এরপর ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে তারা বিকফায়ায় এবং ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে গাজিরে পৌঁছে যায়। তারা একটি করে ছাপাখানা, গ্রন্থাগার, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বিভিন্ন পুস্তক-পুস্তিকা ও সংকলন গ্রন্থ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈরুতকে তাদের বিশেষ কেন্দ্রে পরিণত করে।[20]
লেবাননের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মিশনারিদের স্বার্থ উদ্ধার:
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে লেবাননে ড্রুজ এবং ম্যারোনাইটদের মধ্যে একটি বড় সংঘর্ষ হয়। তাতে উভয় পক্ষের হাজার হাজার লোক নিহত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল খ্রিস্টানদের দিকে।
ম্যারোনাইটরা ফ্রান্সের সুরক্ষার ওপর নির্ভর করে এবং ফরাসি 'স্কুল অব থট'কে প্রাধান্য দেয়, আর ফ্রান্সও তাদের নিকট অস্ত্র সরবরাহ করে। এদিকে ড্রুজ ব্রিটেনের সুরক্ষার ওপর নির্ভর করে এবং আমেরিকান স্কুলগুলোকে বেছে নেয়। সে হিসেবে ইংল্যান্ড তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করে।
কতক জেসুইট সেসব সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যেমন জেসুইট পাদ্রী ফার্দিনান্দো বোনাচিতা। তিনি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে জাহেলে সাতজন ড্রুজকে হত্যা করার পর নিহত হন।
১৮৬০ সালের ঘটনাগুলো ক্রুসেডার পশ্চিমের অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে লেবাননে মিশনারি কার্যক্রম ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার মিশনে অনুদান ও সাহায্য-সহায়তা সংগ্রহে তারা ওই ঘটনাগুলোকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে ঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
তাইতো আমেরিকান ধর্মপ্রচারক হেনরি হ্যারিস জেসপে এই বিবাদকে একটি সফল বিজ্ঞাপন মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করে বলেছিলেন: "ইউরোপ এবং আমেরিকা এ ঘটনায় কেঁপে উঠেছে এবং লেবানন এ ঘটনার দ্বারা পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। তাই আমরা এই অঞ্চলের নামে সহায়তা ও অনুদান সংগ্রহ করতে পারি এবং তথায় ধর্ম প্রচার কার্যক্রম চালাতে পারি।"
জার্মানির জুলিয়াস রেখটার বলেছিলেন: "এই গণহত্যা খ্রিস্টান বিশ্বে শক্তিশালী সহানুভূতি ও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে দিয়েছিল।" এরপর তিনি যোগ করেছেন: "এবং এই পথে নিকট প্রাচ্যে প্রোটেস্ট্যান্ট লড়াইয়ের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হল।"
১৮৫৯ ও ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনীয়দের গণহত্যার আগে ১৮৬০ সালে লেবাননের ঘটনা ছাড়া আর দ্বিতীয় এমন কিছু ঘটে নি, যা এই ভূখণ্ডে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার মিশনে বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারি গোষ্ঠীকে একযোগে কাজ করার জন্য এভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
এসব ঘটনার সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিণতিগুলোর একটি ছিল, বৈরুতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠান, যেখানে উসমানীয় কমিশনার ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়ার প্রতিনিধিদের সাথে উপস্থিত ছিলেন। তারা জোর প্রস্তাব পেশ করে এই সিদ্ধান্ত আদায় করে নিয়েছিল যে, মাউন্ট লেবাননের প্রশাসন অন্যান্য দেশের সম্মতিতে অটোমানদের পক্ষ থেকে একজন খ্রিস্টান প্রশাসকের হাতে থাকা উচিত এবং সেই প্রশাসক হবেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী একজন ইউরোপীয় খ্রিস্টান।[21]
ঐ প্রশাসকের মাধ্যমেই মাউন্ট লেবাননে খ্রিস্টান মিশনারি কার্যক্রমের দ্বার পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
তাই ফরাসী ম্যাগাজিন (ইসলামিক ওয়ার্ল্ড)-র প্রধান সম্পাদক লে চ্যাটেলিয়া প্রোটেস্ট্যান্ট মিশন বিষয়ক নিজ প্রতিবেদনে দ্বীন ইসলাম প্রতিরোধে জেসুইট মিশনারিদের প্রশংসা করেছেন। তিনি বিশেষভাবে বৈরুতের জেসুইট মিশনারি এবং তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সেন্ট জোসেফ কলেজের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন: ফরাসি চিন্তাধারা প্রচারে এদের বিরাট অবদান রয়েছে।[22]
লেভান্টে জেসুইটদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ডক্টর মোস্তফা খালদি এবং ওমর ফররুখ বলেছেন যে, জেসুইট প্রতিষ্ঠান...: "এক জায়গা থেকে দিকনির্দেশন লাভ করত। আর তা হচ্ছে, রোম। কখনও কখনও ফ্রান্স থেকে দিকনির্দেশনা আসতো। রোম থেকে আসতো ধর্মীয় দিকনির্দেশনা আর ফ্রান্স থেকে আসতো রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা।"
বিশেষভাবে সিরিয়া ছিল আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ফরাসি রং মাখা জেসুইটদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা ও শক্তি পরিমাপের ক্ষেত্রে।[23]
***লেবাননের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মিশনারিদের স্বার্থ উদ্ধার:
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে লেবাননে ড্রুজ এবং ম্যারোনাইটদের মধ্যে একটি বড় সংঘর্ষ হয়। তাতে উভয় পক্ষের হাজার হাজার লোক নিহত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল খ্রিস্টানদের দিকে।
ম্যারোনাইটরা ফ্রান্সের সুরক্ষার ওপর নির্ভর করে এবং ফরাসি 'স্কুল অব থট'কে প্রাধান্য দেয়, আর ফ্রান্সও তাদের নিকট অস্ত্র সরবরাহ করে। এদিকে ড্রুজ ব্রিটেনের সুরক্ষার ওপর নির্ভর করে এবং আমেরিকান স্কুলগুলোকে বেছে নেয়। সে হিসেবে ইংল্যান্ড তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করে।
কতক জেসুইট সেসব সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যেমন জেসুইট পাদ্রী ফার্দিনান্দো বোনাচিতা। তিনি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে জাহেলে সাতজন ড্রুজকে হত্যা করার পর নিহত হন।
১৮৬০ সালের ঘটনাগুলো ক্রুসেডার পশ্চিমের অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে লেবাননে মিশনারি কার্যক্রম ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার মিশনে অনুদান ও সাহায্য-সহায়তা সংগ্রহে তারা ওই ঘটনাগুলোকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে ঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
তাইতো আমেরিকান ধর্মপ্রচারক হেনরি হ্যারিস জেসপে এই বিবাদকে একটি সফল বিজ্ঞাপন মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করে বলেছিলেন: "ইউরোপ এবং আমেরিকা এ ঘটনায় কেঁপে উঠেছে এবং লেবানন এ ঘটনার দ্বারা পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। তাই আমরা এই অঞ্চলের নামে সহায়তা ও অনুদান সংগ্রহ করতে পারি এবং তথায় ধর্ম প্রচার কার্যক্রম চালাতে পারি।"
জার্মানির জুলিয়াস রেখটার বলেছিলেন: "এই গণহত্যা খ্রিস্টান বিশ্বে শক্তিশালী সহানুভূতি ও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে দিয়েছিল।" এরপর তিনি যোগ করেছেন: "এবং এই পথে নিকট প্রাচ্যে প্রোটেস্ট্যান্ট লড়াইয়ের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হল।"
১৮৫৯ ও ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনীয়দের গণহত্যার আগে ১৮৬০ সালে লেবাননের ঘটনা ছাড়া আর দ্বিতীয় এমন কিছু ঘটে নি, যা এই ভূখণ্ডে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার মিশনে বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারি গোষ্ঠীকে একযোগে কাজ করার জন্য এভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
এসব ঘটনার সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিণতিগুলোর একটি ছিল, বৈরুতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠান, যেখানে উসমানীয় কমিশনার ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়ার প্রতিনিধিদের সাথে উপস্থিত ছিলেন। তারা জোর প্রস্তাব পেশ করে এই সিদ্ধান্ত আদায় করে নিয়েছিল যে, মাউন্ট লেবাননের প্রশাসন অন্যান্য দেশের সম্মতিতে অটোমানদের পক্ষ থেকে একজন খ্রিস্টান প্রশাসকের হাতে থাকা উচিত এবং সেই প্রশাসক হবেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী একজন ইউরোপীয় খ্রিস্টান।[21]
ঐ প্রশাসকের মাধ্যমেই মাউন্ট লেবাননে খ্রিস্টান মিশনারি কার্যক্রমের দ্বার পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
তাই ফরাসী ম্যাগাজিন (ইসলামিক ওয়ার্ল্ড)-র প্রধান সম্পাদক লে চ্যাটেলিয়া প্রোটেস্ট্যান্ট মিশন বিষয়ক নিজ প্রতিবেদনে দ্বীন ইসলাম প্রতিরোধে জেসুইট মিশনারিদের প্রশংসা করেছেন। তিনি বিশেষভাবে বৈরুতের জেসুইট মিশনারি এবং তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সেন্ট জোসেফ কলেজের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন: ফরাসি চিন্তাধারা প্রচারে এদের বিরাট অবদান রয়েছে।[22]
লেভান্টে জেসুইটদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ডক্টর মোস্তফা খালদি এবং ওমর ফররুখ বলেছেন যে, জেসুইট প্রতিষ্ঠান...: "এক জায়গা থেকে দিকনির্দেশন লাভ করত। আর তা হচ্ছে, রোম। কখনও কখনও ফ্রান্স থেকে দিকনির্দেশনা আসতো। রোম থেকে আসতো ধর্মীয় দিকনির্দেশনা আর ফ্রান্স থেকে আসতো রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা।"
বিশেষভাবে সিরিয়া ছিল আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ফরাসি রং মাখা জেসুইটদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা ও শক্তি পরিমাপের ক্ষেত্রে।[23]
৪- তাদের প্রধান কার্যক্রমসমূহ:
ক - খ্রিস্টানাইজেশন
খ - শিক্ষা
গ - অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য আরব জাতীয়তাবাদী আহ্বানকে উৎসাহিত করা
ঘ - জনকল্যাণমূলক সামাজিক কার্যক্রম
ঙ - রচনা ও প্রকাশনা
চ - জনসাধারণের প্রতি আহ্বান
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামিক বিশ্বে জেসুইট সহ অন্যান্য খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রধান লক্ষ্য হল খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার। অর্থাৎ মুসলমানদেরকে এবং তাদের বাইরে সকলকেই তাদের মত খ্রিস্টান মতাবলম্বী করে তোলা, চাই তারা অন্য উপ শাখার খ্রিস্টান হোক কিংবা ইহুদি পৌত্তলিক হিন্দু বা যেকোনো ধর্মের কাফের হোক।
আমি সংক্ষেপে লেভান্টে জেসুইট খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপের দু’টি পর্যায় উল্লেখ করতে চাই।
প্রথম পর্যায়: লেভান্টে জেসুইটদের আগমনের শুরু থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত
দ্বিতীয় পর্যায়: ফরাসি ম্যান্ডটে অন্তর্ভুক্তির পর থেকে।
***আমি সংক্ষেপে লেভান্টে জেসুইট খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপের দু’টি পর্যায় উল্লেখ করতে চাই।
প্রথম পর্যায়: লেভান্টে জেসুইটদের আগমনের শুরু থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত
দ্বিতীয় পর্যায়: ফরাসি ম্যান্ডটে অন্তর্ভুক্তির পর থেকে।
প্রথম পর্যায়: লেভান্টে জেসুইটদের আগমনের শুরু থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসি ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হবার আগ পর্যন্ত
লেবাননে ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারকদের আগমন শুরু হয়েছিল খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে ক্রুসেড আরম্ভ হওয়ার সময় থেকে।
আমি পূর্বেও উল্লেখ করেছি, রাজা নবম লুই মনসুরাতে বন্দী হবার পর অনুধাবন করতে পেরেছিলেন; সেই সঙ্গে চার্চও উপলব্ধি করতে পেরেছিল, যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে খ্রিস্টান বানানো অসম্ভব। তাই তারা মিশনারি কার্যক্রমের পথ অবলম্বন করে।
জেসুইটরাই সর্বপ্রথম লেবাননে আধুনিক অর্থে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার মিশন আরম্ভ করে[24]।
ফ্রান্স নিজেকে প্রাচ্যের খ্রিস্টানদের, বিশেষ করে লেবাননের মারোনাইটদের রক্ষাকারী মনে করত এবং ম্যারোনাইটরাও সমানভাবে ফ্রান্সের আনুগত্য করত। ফ্রান্স ধর্মীয় লেবাসে এ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। তখন ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টান মিশনারিরা লেবাননে আসতে আরম্ভ করে। ফ্রান্সের রাজা খোদ মিশনারীদের কার্যক্রম এবং গির্জা নির্মাণের তদারকি ও তত্ত্বাবধায়ন করতেন। ফ্রান্স লেবাননের ধর্মযাজকদের গ্রহন, তাদের ধর্মীয় বিদ্যালয়ে নিজেদের মতো করে শিক্ষাদান আরম্ভ করে এবং প্রাচ্যে তাদের মিশনকে বরাবরই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যায়; অথচ সে সময় ফ্রান্সের মাটিতেই তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো।
লেবানন ও লেভান্ট নিয়ে ফ্রান্সের আগ্রহ, গুরুত্ববোধ ও হস্তক্ষেপ তখনই বৃদ্ধি পেতে থাকে যখন প্রাচ্যের ব্যাপারে বৃটেনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ফ্রান্স মনে করে।[25]
ইতিপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি যে,
ভ্যাটিকান ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে রোমে ম্যারোনাইট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জেসুইট প্রশাসনের অধীনে চালু ছিল।
অটোমান সাম্রাজ্যে জেসুইটরা আমেরিকান মিশনারিদের আগে থেকে ব্যাপক স্বাধীনতা উপভোগ করে আসছিল এবং কর থেকে মুক্তির মতো সুবিধাও তারা ভোগ করত। ১৮৬৫ সালের আগ পর্যন্ত আমেরিকানরা এমন কোন স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। পরবর্তীতে তুর্কি সরকার করমুক্তির এই সুবিধা বাতিল করে দেয়। কারণ সরকার জানতে পারে, এ সমস্ত খ্রিস্টান মিশনারি; যারা জনহিতকর কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলে এখানে থাকছে, তারা করমুক্তির এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে কিংবা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তাদের লোকদের কাছে সেগুলো বিক্রয় করে।[26]
এমনিভাবে নিজের ভূমি থেকে তাদের বিতাড়নকারী ফ্রান্স লেভান্টে তাদের জন্য কয়েক মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক ব্যয় করেছিল, যেন তারা রাজনৈতিক এজেন্ট, সামাজিক উকিল এবং সমস্যা সৃষ্টিকারী হিসাবে ফ্রান্সের পক্ষে কাজ করে।
এদিক থেকে জেসুইটরা ফ্রান্স বিরোধী যে কোন কিছুকে স্বয়ং পোপের বিরুদ্ধাচারণ হিসাবে বিবেচনা করত।[27]
রাজনীতি মিশ্রিত এই খ্রিস্টানাইজেশন; বরং আরো শুদ্ধ করে বললে, খ্রিস্টানাইজেশনের মোড়কে এই রাজনীতিই ঔপনিবেশিকতার প্রকৃতি ও মূল পরিচয়। ফ্রান্সের রাজনীতিতে এটা তার সবচেয়ে কদাকার চেহারায় প্রকাশিত হয়েছে। জেসুইট ফাদার মায়েস 'লা ক্রোয়েসেড ডু লেভান্ট' (লেভান্টের ক্রুসেড আক্রমণ) নামক স্বীয় গ্রন্থে ফ্রান্সের ধর্মীয় রাজনীতির রূপরেখা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন: (পৃ. ২৩): "সপ্তদশ শতাব্দীতে আমাদের ধর্মপ্রচারকেরা যে শান্ত ক্রুসেড আরম্ভ করেছিলেন, তা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে। প্রাচ্যে এখনও অনেক ফরাসি পাদ্রি ও সিস্টার রয়েছেন।"
১৪ ও ১৫ নং পৃষ্ঠায় তিনি যোগ করেছেন: “ফ্রান্স দীর্ঘকাল ধরে ক্রুসেডের চেতনা এবং এসব যুদ্ধের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে নিজের মাঝে জাগরূক রেখেছে। ফ্রান্সের রাজারা প্রায়শই (প্রাচ্যের বিরুদ্ধে) একটি নূতন ক্রুসেড অভিযানের চিন্তা করতেন। কিন্তু (নিজের স্বার্থের পক্ষে) বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা ইউরোপ সর্বদাই সুদূরপ্রসারী বড় কোন হামলা পরিচালনাকে ফ্রান্সের পক্ষে অসম্ভব করে রেখে ছিল।”
তিনি আরও বলেন (পৃষ্ঠা: ১৫ ও ১৬): “বিদেশী বিশেষাধিকার ও সুযোগ-সুবিধাগুলোর একটি লক্ষ্য ছিল, সর্বদা (ফ্রান্স) কর্তৃক তার পাদ্রিদের দ্বারা পরিচালিত ভূমিকা ধরে রাখা এবং সেই ভূমিকার পরিসর বিস্তৃত করা। আমাদের কনসাল ও রাষ্ট্রদূতদের কাছে খ্রিস্টানদেরকে সুরক্ষা প্রদানের এ বিষয়টা স্বীকার করা হয়েছে। তারা এমন গুরুত্বপূর্ণ জটিল কাজ সম্পন্ন করেছেন, যা গির্জাগুলোতে পূণ্যার্থীদের উপস্থিতির সম্মান তাদেরকে প্রদান করেছে। তারা সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের উত্তপ্ত প্রতিক্রিয়া শান্ত করতে এবং অটোমান সাম্রাজ্যে ধর্মপ্রচারক মিশনারিদেরকে সহায়তা করতে বিরাট প্রয়াস চালিয়েছেন।"
তিনি আরো লিখেছেন: (পৃষ্ঠা নং. ২২): "এবং ফ্রান্সের প্রতিনিধিরা আমাদের ধর্মপ্রচারকদের কাজকে সমর্থন করেছিলেন।"
অতঃপর তিনি উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা নং: ৫০): "অধিকাংশ সময়ই; বিশেষ করে সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের কনসালদের মাঝে প্রেরিত দূত বা প্রতিনিধি দল থাকতো।[28]
এভাবে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, ধর্মীয় মিশনারিগুলো সর্বদাই প্রাচ্যে উপনিবেশবাদ অনুপ্রবেশের একটা বাহানা ও কৌশল ছিল। লেবাননের ম্যারোনাইট জেলা কমিশনার আমীর হায়দার আবি আল-লামা ম্যারোনাইট প্যাট্রিয়ার্ক এবং ফরাসি জেনারেল কনসালের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হন। তাদের এমন প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল, ফ্রান্সের অধীনে সিরিয়ার ক্যাথলিকদের সকলের কাছে পৌঁছার জন্য লেবাননকে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের প্রভাবের আওতায় নিয়ে আসা।[29]
দ্বিতীয় পর্যায়: ফরাসি ম্যান্ডেটের পরে জেসুইটদের মিশনারি কার্যকলাপ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে মাউন্ট লেবাননের প্রশাসক (দাউদ পাশা) এমন একজন আর্মেনিয়ান ছিলেন, যিনি ফ্রান্সকে তুষ্ট করতে আগ্রহী ছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রোটেস্ট্যান্টদের মূলোৎপাটন করার জন্য ম্যারোনাইট পুরোহিতদের স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হবার আগ পর্যন্ত মাউন্ট লেবাননে পরিস্থিতি এমনই ছিল। অতঃপর উসমানীয় সাম্রাজ্য মুতাসাররিফিয়া ব্যবস্থাকে নিজের জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচনা করে এ ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে দেয়। এভাবেই খ্রিস্টানাইজেশন আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। এর চার বছর পর যখন ব্রিটিশ ও ফরাসিরা সিরিয়া দখল করে অটোমান সাম্রাজ্যকে পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে বিতাড়িত করে, তখন আরো জোরালোভাবে বিস্তৃত পরিসরে এ আন্দোলন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
যৌথ এই দখলদারিত্ব বেশিদিন টেকেনি। বরং ইংরেজরা সে সময়টাতে সিরিয়ার দুই দক্ষিণ দিক (ফিলিস্তিন ও জর্ডানের পূর্বাঞ্চল)-এ সরে আসে আর ফরাসিরা উত্তর দিকে (সিরিয়া ও লেবানন) থেকে যায়।
এভাবেই জেসুইট মিশনারিরা ফরাসি ম্যান্ডেটের এলাকায় বিস্তৃত পরিসরে যাত্রা শুরু করে। এক সময় মেপে মেপে পা ফেললেও পরবর্তীতে তারা সদর্প অবস্থান গ্রহণ করে। Les Jesuites en Syrie (সিরিয়ায় জেসুইটরা) (পৃষ্ঠা নং: ১০) গ্রন্থে এসেছে, তারা বলতো: "১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে যখন যুদ্ধ বিরতি সন্ধি নতুন করে মিশনারীদের জন্য সিরিয়ার পথ খুলে দিল, তারা তখন হাউরানে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ক্যাথলিক বিশপরা উক্ত এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার কারণে তাদের হাতে অর্পণ করে গিয়েছিল।"
তাদের এর চেয়েও তীব্র বক্তব্য হল: (পৃষ্ঠা নং: ১০: ২৬) "হে মিশনারীরা! তোমাদের কাছে এমন সুযোগ এসে ধরা দিয়েছে, যা ইতিপূর্বে কখনো আসেনি।"
তারা আরো বলেছে: (পৃষ্ঠা নং: ১০: ৬৬) "ম্যান্ডেটের পর থেকে নতুন যে বিষয়গুলো ঘটেছে তার মধ্যে একটা হলো, গোটা লেবাননে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তা বিস্তার। প্রাচীন মিশনারিরা সবসময় লোমহর্ষক ঘটনার মুখে কিংবা বেদুইন অ্যামবুশ বা অজ্ঞাত উৎস থেকে গুলিবর্ষণের ভয় নিয়ে কাজ করতেন। কখনো বা ডাকাত দলের হাতে তাদেরকে পড়তে হতো। কিন্তু আজকাল বন্দুকের কোন চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। ফরাসিরা সব কিছু বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। যারা মিশনারিদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে, তাদেরকে ভারী মূল্য চুকাতে হয়েছে।"
বস্তুত ফরাসি প্রশাসন জেসুইটদের সহায়তায় দেশে একটি বিস্তৃত খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার আন্দোলন চালাতে চেয়েছে। তাই সে লাতাকিয়ার আশেপাশে আলাবীদের দেশ বেছে নিয়েছে। এজন্যই পূর্বোক্ত বইয়ে বলা হয়েছে: (পৃষ্ঠা নং: ১০: ৩৭) ফ্রান্স চেয়েছিল, আলাবিদের একটি মুক্ত সংবিধান হোক। খ্রিস্টধর্মে তাদের প্রবেশের সুবিধার্থেই ফ্রান্স এমনটা করতে চেয়েছিল। তবে সেখানে শর্ত থাকবে যে, এ লক্ষ্য অর্জনে উক্ত সংবিধান সবকিছু রেখেঢেকে করবে। তাই (শোফলার) আলাবীদের জল্লাদ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। তাতে এই বিধান ছিল, কোনরকম জটিল প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই সাধারণ আদালতে ক্যাথলিক ধর্মমত গ্রহণ করা যাবে।[30]
পূর্বোক্ত বইয়ে আরো এসেছে: (পৃষ্ঠা নং: ১০: ৮) আমরা কি ক্রুসেডারদের উত্তরাধিকারী নই? মিশনারি কার্যক্রম নিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া, খ্রিস্টান নগরায়ন পুনরায় আরম্ভ করা, ফরাসি পতাকা চলে গির্জার নামে যীশুর রাজ্য পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে আমরা কি ক্রুশের পতাকা তলে সমবেত হইনি?[31]
জেসুইটরা আলাবীদের দেশের প্রতি নিজেদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল সেই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে, যা আলাবিদের দেশে ছেয়ে গিয়েছিল। কারণ জেসুইটরা কেবল ব্যক্তি পরিসরে নয়; বরং সামষ্টিক পরিসরে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের চিন্তা করছিল।
তাইতো ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথম সেপ্টেম্বরে (বৃহত্তর লেবাননের ঘোষণা বার্ষিকীতে) ফরাসি হাইকমিশনার বেশ কয়েকজন সিস্টারকে আলাবীদের দেশে সাফিতার কাছে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
‘লেস জেসুইটস এন সিরি’ নামক বইটিতে (পৃষ্ঠা নং: ১১: ২৭) সাফিতার নান স্কুল সম্পর্কে জেসুইটদের এ বক্তব্য উল্লেখ রয়েছে: “নিশ্চয়ই এই প্রতিষ্ঠানটি একদিন ধর্ম প্রচারের ওই মিশনে বিরাট ভূমিকা পালন করবে, যা অনেকদিন আগে আলাবীদের মাঝে চালু করা হয়েছিল।"
জেসুইটরা এই সুযোগ মিস করেনি। কারণ তারা পাদ্রীদল ও নমনীয় দাওয়াতি পন্থা নয় বরং ফরাসিদের বর্শা দিয়ে এই ধর্ম প্রচার কার্যক্রমের সুযোগ লাভ করেছে, যা ছিল তাদের আশানুরূপ। 'Les Jesuites en Syrie' গ্রন্থে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে (পৃষ্ঠা নং: ১০: ২৩): ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তারা (রাসলান গার্ডেনে) আলাবীদের একটি দলকে জড়ো করে এবং তাদেরকে ক্যাথলিক ধর্মমত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
উল্লেখ্য যে, ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া ও লেবাননে ফরাসি হাইকমিশনার জেসুইটদের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন, যদিও তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন; ধার্মিক ছিলেন না, কিন্তু খ্রিস্টানাইজেশনের সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থ যুক্ত হবার কারণেই তিনি এমনটা করতেন।
ফরাসি ম্যান্ডেট সিরিয়া ও লেবাননে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার মিশনের জন্য ব্যাপক স্বাধীনতার ব্যবস্থা করে দেয় এবং ক্যাথলিক চার্চ জেসুইটদলের মতো তার সক্রিয় বাহু থাকা সত্ত্বেও ফরাসি ক্যাথলিক কর্মকর্তাদের সহায়তায় নিজের জন্য সেই স্বাধীনতার রূপরেখা এঁকে নেয়।
আর ম্যান্ডেটরি শাসনাধীন রাষ্ট্র আসলে প্রকাশ্যভাবে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার আন্দোলনের সঙ্গে সহযোগিতা করত না এবং মুসলমানদেরকে খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা খ্রিস্টান বানাবার কার্যক্রমকে আশীর্বাদও করত না, কিন্তু তারা যেটা করত সেটা কোন হৈচৈ না করে সন্তর্পণে করে ফেলত। তা সত্ত্বেও, স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ, হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসমূহ, সামাজিক সংগঠন এবং প্রত্যক্ষ ধর্ম প্রচার কার্যক্রম যেগুলো গির্জা ও মিশনারিরা চালিয়ে যাচ্ছিল, সবকিছুই কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়া ধর্ম প্রচার মিশনের অংশ হিসেবে বেশ ভালোভাবেই চলছিল।
বিদেশি নিয়োগ প্রাপ্তদের কর্মচঞ্চল্য ও বহিরাগত আর্থিক অনুদানের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই এই কার্যক্রমগুলোর মাঝে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও জমজমাট ছিল।[32]
ফ্রান্স যখন সিরিয়া ও লেবানন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় এবং আলাবীদের দেশ যখন সিরিয়ার সীমানায় পুনরায় চলে আসে, তখন ফ্রান্স বিভিন্ন ফেতনা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না করে সেখান থেকে বের হয়নি। তাই সুলেমান আল-মুর্শিদের ফিতনা সৃষ্টি করা হয়।
সে আল-জুবা গ্রামের বাসিন্দা, যেটি সিরিয়ার লাত্তাকিয়া প্রদেশের আল-হাফা জেলার অন্তর্গত। ফরাসি ম্যান্ডেটের যুগে সুলেমান আল-মুর্শিদ ইলাহ্ বা উপাস্য হবার দাবি করেছিল এবং তার অনুসারীরা কয়েক বছর যাবত তার প্রতি ঈমান এনে রেখেছিল। ফরাসি উপদেষ্টা এই দাবি দিয়ে নুসাইরী আল-হাফ্ফাহকে প্রতারিত করতে অবদান রেখেছিলেন। কারণ বলা হয় যে, সে সুলেমানের বিশেষ ক্ষমতার সত্যতার ব্যাপারে অনুসারীদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য তাদের সামনে প্রভু সুলেমানকে সেজদা করত। সে তার কথিত প্রভুর কাছে এমন বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করে দিত, যেগুলো অনুসারীরা রেডিও টেলিফোন সহ অন্যান্য আধুনিক উপায়ে জানতে পেত না। তখন কথিত প্রভু অনুসারীদেরকে সেসব তথ্য সম্পর্কে অবহিত করত। তখন তাদের ঈমান ও আস্থা আরো বেড়ে যেত। সে বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে প্রভুর জন্য একটি জিলবাব বানিয়েছিল, যা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতো। তা দেখে ভক্ত অনুরাগীরা তার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়তো।
এভাবেই পুরো একটা গোষ্ঠীর প্রধানকে কিনে নেয়ার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তি পুরো গোষ্ঠীকে কাবু করে ফেলতে সক্ষম হতো। কারণ গোষ্ঠীর সাধারণ সকলেই তাদের প্রধানকে অন্ধভাবে অনুসরণ করত। সিরিয়ায় স্বাধীনতা ঘোষণার পর নুসাইরিরা তাদের সুরক্ষিত দুর্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করত। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তাদের মাঝে কি চলছে কিছুই জানতে পেতো না। তারা এ কথা পর্যন্ত জানতে পারেনি যে প্রভু সুলেমান নিজ শক্তিমত্তা দ্বারা প্রতারিত হয়ে লুটপাট, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড আরম্ভ করে দিয়েছে। সুলেমান স্বায়ত্তশাসন এবং লাতাকিয়া শহরের জন্য একজন নুসাইরি মন্ত্রী নিয়োগের দাবি তুলে বসে। সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং নাগরিক আইন অমান্যের কথা ঘোষণা করে। এমনকি যদি তার দাবি মেনে নেয়া না হয়, তাহলে সে সিরিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাবার হুমকি দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সিরিয়া সরকার সামরিক বাহিনী প্রস্তুত করে তার প্রভুবাদী শাসন কেন্দ্র অভিযান পরিচালনা করে। এরপর তাকে গ্রেফতার করে একটি পাবলিক ট্রায়ালে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ শোনায়। ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রপতি শুকরি আল-কুওয়াতলির আমলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার পরে তার পুত্র মুজিব এই প্রভুবাদী কর্তৃত্ব লাভ করে।
ডঃ মোস্তফা খালদি এবং ওমর ফররুখ এই বলে মন্তব্য করেছেন: "জেসুইটরা এমন একটি দেবতা বানাতে চেয়েছিল, যা উদীয়মান সিরিয়া রাষ্ট্রের শক্তিকে দুর্বল করবে। কিন্তু তারা একটা মানুষের সঙ্গে অন্যায় করে এবং তাকে ফাঁসির মঞ্চে ঠেলে দেয়। এভাবেই সুলেমান আল মুরশিদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আলাবীদের দেশে জেসুইট ও ফরাসিদের আশা চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায়।"[33]
এরপর যে বিষয়টা ঘটেছে তা হলো, এতদিন রাষ্ট্রগুলো নিজেদের সমর্থিত মিশনারিদেরকে সাহায্যের যে ধারা চালু রেখেছিল, সেটা এ পর্যায় থেকে উন্নীত হয়ে সর্বজাতিক সহযোগিতা চুক্তিতে গিয়ে পৌঁছে। তাইতো ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের চার তারিখে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই বছরের আগস্টের ১৩ তারিখে তারা সেই চুক্তির কথা ঘোষণা করে।
সে চুক্তিতে বলা হয়েছে: "দশম অনুচ্ছেদ: ম্যান্ডেটরি কর্তৃত্বশালী রাষ্ট্র কর্তৃক সিরিয়া ও লেবাননে ধর্মীয় মিশনারিদের তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্যই নিরাপত্তা সংরক্ষণ ও সুব্যবস্থাপনা বজায় রাখার মাঝেই সীমাবদ্ধ হতে হবে। এসব মিশনারির বহুমুখী কার্যক্রম এমন কোন দৃষ্টিভঙ্গির আওতাধীন হওয়া জরুরী নয়, যার দরুন তাদের কাজের ক্ষেত্র সংকীর্ণ হয়ে আসে। এমনিভাবে মিশনারী সদস্যেরাও এমন কোন দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হবে না যা জাতিগত ভিন্নতার কারণে তাদের কাজের ক্ষেত্র সীমিত করে আনে। তবে শর্ত হলো, বহুমুখী তাদের সকল কার্যক্রম ধর্মীয় সীমারেখার ভেতরে থাকতে হবে।"
এই অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট আকারে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্র কর্তৃক সিরিয়া ও লেবাননে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার মিশনে সহায়তার কথা বলা হয়েছে। তাই বলা যায়, পশ্চিমের সবগুলো দেশ এসব ধর্মীয় মিশনের মাঝে নিজেদের এমন রাজনৈতিক স্বার্থ খুঁজে পায়, যা রক্ষা করা এবং যার পথ হতে বাধা-বিপত্তি দূর করা তারা আবশ্যক মনে করে।
এই চুক্তি ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত সিরিয়া ও লেবাননে বলবৎ ছিল।[34]
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ফ্রান্স বিভিন্ন মিশনারি দলের সুযোগ-সুবিধা ফরাসি মিশনারিগুলোর জন্য বিশেষায়িত করার প্রতিটি সুযোগ গ্রহণ করেছিল। তাই ১৯২৫ সালের নভেম্বরে বৈরুতে মিশনারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধানের যেই অধিকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানির ছিল, জার্মান সংস্থাগুলোর সেই অধিকার ফরাসি সরকার নিজ দেশের শিক্ষা কেন্দ্র ও সংস্থাগুলোর হাতে তুলে দেয়। এরপর ফরাসি সংস্থাগুলোকে ফরাসি সরকার এবং সিরিয়াতে তাদের হাইকমিশনারের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসে।[35]
(চলবে, ইন শা আল্লাহ)
[1] أصول المارونية السياسية - পৃষ্ঠা: ২৭—৩০, تاريخ المسيحية الشرقية- পৃষ্ঠা: ৪৮৯—৪৯১, الطائفة الكاثوليكية পৃষ্ঠা: ১৯৩—২০৩, Microsoft Encarta 2009, Maronites.
Encyclopædia Britannica, 2015, Maronite church.
[2] বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্য: أصول المارونية السياسية- الفصل الرابع: الموارنة والحملات الصليبية- চতুর্থ পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা: ৬১ এবং তৎপরবর্তী, تاريخ الكنيسة الشرقية- পৃষ্ঠা: ৪৯২—৪৯৩
[3] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৮
ম্যারোনাইটদের ওপর মামলুক শাসকদের উপর্যুপরি হামলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আরও দ্রষ্টব্য:أصول المارونية السياسية- الفصل الخامس: حروب كسروان - পঞ্চম পরিচ্ছেদ: حروب كسروان - পৃষ্ঠাঃ ৭৫ এবং তৎপরবর্তী।
[4] الحركة الصليبية - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪৬৪-৪৬৫
[5] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - (লেভান্টের ভূমিতে আমেরিকান মিশনারি) পৃষ্ঠা: ৪৪, ৪৪
[6] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৯
[7] الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب والأحزاب المعاصرة - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৬২৭, ৬২৮
[8] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৯
[9] الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب والأحزاب المعاصرة - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৬২৭, ৬২৮
[10] تاريخ الآداب العربية - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৪৫, ২৪৬
[11] الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب والأحزاب المعاصرة - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৬২৮
[12] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৫
[13] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৫০, ৫১
[14] التبشير والاستعمار - পৃষ্ঠা: ১৩৬
[15] التبشير والاستعمار - পৃষ্ঠা: ১৩৭
[16] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৯
[17] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৫৩
[18] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ২৬৭, ২৬৮
[19] التبشير والاستعمار - পৃষ্ঠা: ১৩২—১৩৪
Encyclopædia Britannica, 2015, capitulation.
[20] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা নং: ৬৭, المستشرقون للعقيقي পৃষ্ঠা নং: ১০৮৫, التبشير والاستعمارপৃষ্ঠা নং: ৭৭ ও ১১১.
[21] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৩৫ — ১৪৩
[22] الغارة على العالم الإسلامي পৃষ্ঠা নং: ১৫, ১৬
[23] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১১১
[24] التبشير في بلاد الشام পৃষ্ঠা নং: ২০
[25] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৫২—১৫৪
[26] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ৫৬
[27] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১২১
[28] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১২৭
[29] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৫৮
[30] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৫১, ১৫২
[31] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১১৫, ১১৬
[32] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১২১—১২৫
[33] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৫৭, مجلة الراصد الإسلامية - সংখ্যা: ২৫, শাওয়াল ১৪২৮ হিজরি, পৃষ্ঠা নং. ৫৩, دعوة المقاومة الإسلامية العالمية - পৃষ্ঠা নং: ৫৬৮
[34] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৬২
[35] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ৫৬, ৫৭
Encyclopædia Britannica, 2015, Maronite church.
[2] বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্য: أصول المارونية السياسية- الفصل الرابع: الموارنة والحملات الصليبية- চতুর্থ পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা: ৬১ এবং তৎপরবর্তী, تاريخ الكنيسة الشرقية- পৃষ্ঠা: ৪৯২—৪৯৩
[3] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৮
ম্যারোনাইটদের ওপর মামলুক শাসকদের উপর্যুপরি হামলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আরও দ্রষ্টব্য:أصول المارونية السياسية- الفصل الخامس: حروب كسروان - পঞ্চম পরিচ্ছেদ: حروب كسروان - পৃষ্ঠাঃ ৭৫ এবং তৎপরবর্তী।
[4] الحركة الصليبية - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪৬৪-৪৬৫
[5] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - (লেভান্টের ভূমিতে আমেরিকান মিশনারি) পৃষ্ঠা: ৪৪, ৪৪
[6] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৯
[7] الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب والأحزاب المعاصرة - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৬২৭, ৬২৮
[8] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৯
[9] الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب والأحزاب المعاصرة - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৬২৭, ৬২৮
[10] تاريخ الآداب العربية - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৪৫, ২৪৬
[11] الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب والأحزاب المعاصرة - খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৬২৮
[12] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৫
[13] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৫০, ৫১
[14] التبشير والاستعمار - পৃষ্ঠা: ১৩৬
[15] التبشير والاستعمار - পৃষ্ঠা: ১৩৭
[16] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৪৯
[17] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ৫৩
[18] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা: ২৬৭, ২৬৮
[19] التبشير والاستعمار - পৃষ্ঠা: ১৩২—১৩৪
Encyclopædia Britannica, 2015, capitulation.
[20] التنصير الأمريكي في بلاد الشام - পৃষ্ঠা নং: ৬৭, المستشرقون للعقيقي পৃষ্ঠা নং: ১০৮৫, التبشير والاستعمارপৃষ্ঠা নং: ৭৭ ও ১১১.
[21] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৩৫ — ১৪৩
[22] الغارة على العالم الإسلامي পৃষ্ঠা নং: ১৫, ১৬
[23] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১১১
[24] التبشير في بلاد الشام পৃষ্ঠা নং: ২০
[25] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৫২—১৫৪
[26] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ৫৬
[27] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১২১
[28] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১২৭
[29] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৫৮
[30] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৫১, ১৫২
[31] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১১৫, ১১৬
[32] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১২১—১২৫
[33] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৫৭, مجلة الراصد الإسلامية - সংখ্যা: ২৫, শাওয়াল ১৪২৮ হিজরি, পৃষ্ঠা নং. ৫৩, دعوة المقاومة الإسلامية العالمية - পৃষ্ঠা নং: ৫৬৮
[34] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ১৬২
[35] التبشير والاستعمار পৃষ্ঠা নং: ৫৬, ৫৭
Comment