“দাওয়াতে খিলাফত ও মানহাজে রাসূল ﷺ” ।।
মাওলানা আসেম উমর হাফিযাহুল্লাহ ||
এর থেকে – ৫ম পর্ব
===================
মাওলানা আসেম উমর হাফিযাহুল্লাহ ||
এর থেকে – ৫ম পর্ব
===================
পাঁচ. অবস্থার ভিন্নতায় নির্দেশের ভিন্নতা
দাঈর জন্য জরুরি হলো, সে অবস্থা ও পরিবেশের পরিবর্তন অনুভব করে শরঈ সীমারেখার ভিতরে থেকে নিজের দাওয়াতের মধ্যেও পরিবর্তন আনবে। হযরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) এক মহল্লায় মানুষকে নামাজ পড়াতেন। একদিন সেই মসজিদের মুসল্লিরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমরা ক্ষেত-খামারে কাজ করা কৃষক মানুষ-সারাদিন পরিশ্রম করে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ফিরি, মু’আজ (রা.) অনেক দীর্ঘ নামাজ পড়ান যা আমাদের জন্য খুবই কষ্ট হয়। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মু’আজ (রা.)- কে ডেকে বললেন
يا معاذ أفتان انت
হে মু’আজ! তুমি কি মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলতে চাও?
হযরত মুআজ (রা.) যেখানে নামাজ পড়াতেন সেখানের বিশেষ অবস্থার চাহিদাই ছিলো যে নামাজ সংক্ষিপ্ত পড়ানো। [সহীহ বুখারী হাদীস নং -৬৬৪]
এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানের অবস্থার ওপর লক্ষ্য করে মু’আজ (রা.) কে সংক্ষিপ্ত নামাজ পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন, যদিও মূলত স্বাভাবিক অবস্থায় নামাজ দীর্ঘ পড়াই উত্তম।
ছয়. প্রতিপক্ষের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হিজরতের পূর্বে যখন উৎবা কুরাইশের প্রতিনিধি হয়ে আসল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথা পূর্ণ মনোযোগের সাথে শুনলেন, এমন কি সে যখন নিজের কথা সম্পূর্ণ শেষ করে চুপ হল, তারপরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্ষিপ্তভাবে তার সাথে কথাবার্তা বললেন।
সাত. গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ ব্যক্তিদের ওপর মেহনত করা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত আমাদেরকে এটাই শিক্ষা দেয়, সমাজের এমন বিশেষ ব্যক্তি যার সহযোগিতা আপনার আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করবে, তার ওপর বিশেষ মেহনত করা চাই, এমনকি তার জন্য দু’আ এবং তাকে নিজেদের সম্পৃক্ত করার জন্য চেষ্টা করা চাই যেমন আমরা দেখতে পাই যে ইমামুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’আ করেছেন, হে আল্লাহ! উমর ইবনে খাত্তাব অথবা উমর ইবনে হিশাম (আবু জাহেল) এই দুই জন থেকে যে কোন একজনকে আমাকে দান করুন। আল্লাহ তা’আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু’আ কবুল করেছেন এবং হযরত উমর ফারুক (রা.) কে দিয়ে দিলেন যার দ্বারা ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে এবং মক্কায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া শুরু হয়েছে।
আট. সাধারণ দাওয়াত ও বিশেষ দাওয়াতের মধ্যে পার্থক্য করা
সাধারণ দাওয়াতের বিষয় বিশেষ দাওয়াতের বিষয় থেকে ভিন্ন হওয়া চাই। সাধারণ দাওয়াতে (অর্থাৎ জনসাধারণকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে) কথাবার্তা খুবই সতর্কতামূলক মাপজোখা হওয়া যাতে শ্রোতাদের সর্বশ্রেণির মন মানসিকতা লক্ষ্য রাখা যায়। এই দাওয়াতে এমন ধরনের তথ্য উপাত্ত বেশি আলোচনা করা চাই যা আপনি এবং আপনার শ্রোতাদের মাঝে সম্পৃক্ত। তার বিপরীত বিশেষ দাওয়াতের ক্ষেত্রে আপনি খোলামেলা কথা বলতে পারেন এবং বিশেষ শ্রোতার বিশেষ মানসিকতা ও মেজাজ অনুযায়ী বিস্তারিত আলোচনা করতে পারেন।
নয়.নির্বাচিত বাক্য ও উপযুক্ত শব্দ চয়ন
দাওয়াতের ক্ষেত্রে উত্তম বাক্য ও উপযুক্ত শব্দ চয়ন আপনার দাওয়াতকে আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করে তুলবে এবং বহুদূর এগিয়ে দেবে আবার এই শব্দ চয়নে অসতর্ক আপনার দাওয়াতকে প্রতিক্রিয়াহীন বানিয়ে দিতে পারে। কুরআনে কারীমের তো এটাও একটি মু’জিজা যে, কুরআনের আয়াত তার শব্দ এবং বিন্যাস এতটা পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ যে সমগ্র মানবজাতি তার উপমা দিতে অক্ষম। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
و أوتيت جوامع الكلم
আমাকে উত্তম বাক্য দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। [সহীহ মুসলিম হাদীস নং -৮১৪]
আমাদের এই যুগে আল্লাহ তা’আলা শায়েখ উসামা (রহ.) কে সম্ভবত দাওয়াতে নববীর পদ্ধতি এলহাম করেছিলেন। শায়েখ (রহ.)- এর বয়ান শুনলে এমন মনে হয় যেন একেকটি বিষয়, একেকটি বাক্য, একেকটি শব্দ তার কণ্ঠে উচ্চারণ করানো হয়েছে। যেই শ্রেণিকেই সম্বোধন করেছেন পরিপূর্ণ করেছেন। সহজবোধ্য, হৃদয়-মন আকর্ষণ কারী সর্বজনমান্য যুক্তিনির্ভর এমন বয়ান যাকে যে কেউ সমর্থন করতে বাধ্য। শায়েখ উসামা (রহ.) একবার পশ্চিমা বিশ্বকে সম্বোধন করতে গিয়ে তাদেরকে বুঝালেন তোমরা ইয়াহুদিদের গোলাম; কিন্তু শায়েখ (রহ.) উক্ত বয়ানে ইয়াহুদি শব্দের পরিবর্তে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি শব্দটি ব্যবহার করলেন, কেননা পশ্চিমা বিশ্বে যদি ইহুদিদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়া হয় তাহলে তারা তাদের গোত্রীয় টানের কারণে এই বক্তব্যকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে মারবে। এ জন্য শায়েখ এমন এক বাক্য ব্যবহার করেছেন যা তাদের সকল পরিশ্রমকে পণ্ড করে দিয়েছে এবং বিকল্প এমন এক শব্দ ব্যবহার করেছেন যার ফলে তার দাওয়াতের আকর্ষণও অনেক গুণ বেড়ে গেছে; কেননা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নির্যাতনের স্টিম রোলারে পিষ্ঠ পশ্চিমা জনসাধারণের জন্য এই বয়ান অনেক আকর্ষণীয় ছিলো, বরং তা তাদের চেতনার সঠিক প্রতিনিধিত্বই করেছিলো। বি. বি. সি এই বয়ানের ওপর অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলে, মনে হয় যেনো এই বয়ান অনেক অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা হয়েছে।
দশ.যে সকল বিতর্ক দাওয়াতের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা থেকে নিজেকে বাঁচানো
খেলাফত প্রতিষ্ঠার শত্রুরা আপনাকে এমন বিতর্কে লিপ্ত করতে চাইবে যাতে লিপ্ত হয়ে আপনি আপনার মূল উদ্দেশ্য হতে ছিটকে পড়বেন এবং অন্য কোথাও লিপ্ত থাকবেন। যেমন মতবিরোধপূর্ণ ও বিতর্কিত বিষয় এবং মতভেদগত বিষয় ইত্যাদি। একবার যদি আপনি এই সকল মাসআলায় জড়িয়ে পড়েন তাহলে আপনার নিকট খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেয়ে এই মাসআলাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। এতে আপনি আপনার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে অন্য কোথাও গিয়ে পড়ে থাকবেন। এজন্য সর্বদা এমন বিতর্ক থেকে বেঁচে থাকতে হবে যা দাওয়াতের গতি অন্য কোন দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশেষ করে দায়িত্বশীলদের ওপর কর্তব্য যে তারা তাদেরকে অত্যন্ত কঠোরতার সাথে এমন বিষয়ে বিতর্কে জড়ানো থেকে নিষেধ করবে।
দাঈদের উচিত হলো তারা যেনো দাওয়াত দেয়ার সময় সেই দোকানদারের মতো হয়ে যায় যে তার পণ্য বিক্রির সময় তার সামনে তা ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য রাখে না যে কিভাবে তার পণ্য গ্রাহকের নিকট বিক্রি করবে। সে তার পণ্যকে গ্রাহকের নিকট এমনভাবে উপস্থাপন করে মনে হয় যেনো এই পণ্য তৈরীই হয়েছে এই গ্রাহকের জন্য এবং এই গ্রাহকের চেয়ে উপযুক্ত এই পণ্যের পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারে না। এমন বুদ্ধিমান দোকানদার আপনার সাথে অন্য কোন বিতর্কে জড়াবে না, আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে, আপনার পক্ষালম্বন করবে কিন্তু ঘুরে ফিরে সে তার পণ্যের গুণাগুণই বর্ণনা করবে।