||পর্ব ১||
বাংলাদেশে জঙ্গি ন্যারেটিভ পুনর্গঠনের চেষ্টা: আমাদের করণীয় কী?
বাংলাদেশে জঙ্গি ন্যারেটিভ পুনর্গঠনের চেষ্টা: আমাদের করণীয় কী?
"নীরবতা নয়, এখন প্রতিরোধের সময়"
রাত তখন গভীর। ঢাকার আকাশে যেন অদ্ভুত এক চাপা গর্জন। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে শুরু হয় নতুন করে ইতিহাস লেখার প্রস্তুতি। শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে এক স্লোগান, যার প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি বিস্ফোরণ—"আমি কে? তুমি কে? রাজাকার! রাজাকার!" এটা শুধু স্লোগান ছিল না—ছিল চাপা ক্ষোভের বিস্ফোরণ, এ ছিল দীর্ঘশ্বাসে মোড়া প্রতিবাদ, ছিল ইতিহাসের ঘুম ভাঙানো এক চিৎকার।
১৫ জুলাইয়ের গভীর রাতে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক ঘটনার পর, আমি অনুভব করেছিলাম—হাসিনার পতন শুধু সম্ভাবনা নয়, তা এক অনিবার্য বাস্তবতা এবং তা অতিশীঘ্রই। কারণ, হাসিনার শাসনক্ষমতার ভিত্তি সে রাতেই কেঁপে উঠেছিল। যে ন্যারেটিভের উপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতার প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল, ১৫ জুলাইয়ের গভীর রাতে সেই প্রাসাদের ভিত্তি (ন্যারেটিভ) ভেঙে পড়ে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে ধ্বনিত হওয়া এক অগ্নিঝরা স্লোগানে। সেই মুহূর্তে শব্দ শুধু প্রতিবাদ ছিল না, ছিল ক্ষমতার মূল ভিত্তিমূলে আঘাত হানা এক ঐতিহাসিক বিস্ফোরণ।
অতঃপর, হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়তে থাকে তাদের শাসনব্যবস্থা এবং ক্ষমতাকে ঘিরে গড়ে ওঠা অন্যান্য ন্যারেটিভও। যে ভিত্তির ওপর সেইসব বয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, তা একে একে দুর্বল হয়ে পড়ে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় বিশ্বাসের খোলস। বিলীন হতে থাকে সেই নির্মিত ইতিহাস, নিঃশব্দে ভেঙে পড়ে তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন।
ঘটনার ধারা কখনো সরল পথ ধরে চলে না। পতনের মুহূর্ত যতই চূড়ান্ত মনে হোক না কেন, ক্ষমতার ছায়া সহজে বিলীন হয় না। হাসিনা ও আওয়ামী শাসনব্যবস্থার পতনের পর, শুরুতে মনে হয়েছিল সব ভেঙে পড়েছে—যে ন্যারেটিভগুলো তাদের শাসনের ভিত্তি ছিল, সেগুলোর অস্তিত্ব যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে, তত স্পষ্ট হতে থাকে—সবকিছু শেষ হয়নি। ডিপ স্টেটের নীরব ইশারায়, সেই পুরনো বয়ানগুলো আবারও ধীরে ধীরে পুনর্জন্ম নিতে শুরু করে।
বিশেষ করে, "জঙ্গি ন্যারেটিভ"—যেটি এক সময় ক্ষমতার অপব্যবহারের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র ছিল, তা আবারও ফিরে আসতে শুরু করে নতুন মুখোশে, নতুন ভাষায়, কিন্তু সেই পুরনো উদ্দেশ্যেই।
এক ভয়াবহ ঝড় আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এই ঝড় শুধু বাতাসের নয়, এটি এক ছায়াময় বয়ানের—যা ইতিহাসের গলিপথ থেকে বারবার ফিরে আসে, বদলায় রূপ, বদলায় নাম, কিন্তু বদলায় না তার বিষাক্ততার কিছুই। আজ আবার সেই পুরোনো "জঙ্গি ন্যারেটিভ" ফেরানোর চেষ্টা চলছে—আরও ধূর্তভাবে, আরও সংগঠিত ছদ্মবেশে। এই সেই পুরোনো ‘জঙ্গি ন্যারেটিভ’—যা রক্তে রাঙিয়েছে অতীত, এখন ফের ছড়িয়ে দিতে চায় ভয়ের বিষ। তাদের লক্ষ্য—সত্যকে আচ্ছন্ন করা বিভ্রান্তির কুয়াশায়, আর বাংলার জমিনে ইসলামের নবজাগরণকে রুদ্ধ করে দেওয়া।
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে এমতাবস্থায় নীরবতা কখনো কৌশল হতে পারে না। যে বয়ান একবার বুকে আগুন ধরিয়েছিল, তা যদি আমরা থামাতে না পারি, তবে সে আগুন আবার জ্বলবে—আরও তীব্র হয়ে। আজ তাই, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোর মধ্য থেকে অন্যতম একটি—এই বিকৃত বয়ানকে প্রতিহত করা। আমাদের থামিয়ে দিতে হবে সেই বয়ানকে, যেটির উদ্দেশ্য: ভয় ছড়িয়ে নাগরিক মনকে বশে আনা এবং চিন্তার স্বাধীনতায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া।
আমাদের জেগে উঠতেই হবে—প্রতিটি কণ্ঠ, প্রতিটি কলমকে হতে হবে প্রতিরোধের দীপ্ত প্রতীক। কারণ, যদি আমরা আজ দাঁড়াতে না পারি, যদি আমরা নীরব থাকি, তবে আমাদের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যাবে ইতিহাসের শূন্যতায়, আর ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে ভয়ের অন্ধকারে।
এটাই সময়—সত্যের পাশে দাঁড়ানোর।
এটাই সময়—বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল প্রতিরোধরেখা টানার।
ভয়ের নির্মাতা কারা: জঙ্গি ন্যারেটিভের কারিগর ও তাদের ছদ্মবেশী কৌশল
১৫ জুলাইয়ের অগ্নিঝরা রাত কেবল একটি প্রতিবাদ ছিল না, ছিল এক দুঃস্বপ্নের ভাঙন। সেই রাতে কেঁপে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় বয়ানের ভিত। কিন্তু প্রতিটি ভাঙনের মধ্যেই থাকে পুনর্গঠনের চেষ্টা—আর যারা ক্ষমতা হারায়, তারাই সবচেয়ে আগ্রহী পুরনো অস্ত্রকে নতুন মোড়কে ফিরিয়ে আনতে। আজ, আমরা সেই চেনা অস্ত্রের ফিরে আসা দেখছি—আরও ছায়াময়, আরও ছলনাময় এক ছদ্মবেশে। এটি সেই পুরোনো “জঙ্গি ন্যারেটিভ”, যার মুখোশে বারবার দেখানো হয় নিরাপত্তার মুখ, কিন্তু যার প্রকৃত উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল—ইসলামকে দমন করা, মুসলিম পরিচয়কে সন্দেহের চশমায় উপস্থাপন করা, এবং ইসলামী নবজাগরণকে পথেই থামিয়ে দেওয়া।কিন্তু প্রশ্ন হলো—বর্তমানে কারা এই ন্যারেটিভ পুননির্মাণের সাথে জড়িত?
বাংলাদেশের গণমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা, এনজিও এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলস্থানে আজ অবস্থান করছে সেকুলার এলিটদের অনুসারীরা। তারা 'জঙ্গি' শব্দটির এমন এক নির্মাণ উপস্থাপন করেছিল এবং আবারও করতে চায়—যার ফলে ইসলামের প্রতি আন্তরিকতা, শুদ্ধ জীবনযাপন কিংবা পরিশীলিত চিন্তাচর্চাও যেন হয়ে ওঠে সন্দেহের বিষয়, বিপদসংকেত। এইভাবে, একটি গোটা প্রজন্মকে তারা ঠেলে দিতে চায় আত্মসংকোচে; এমন এক মানসিক বন্দীত্বে, যেখানে নিজের ধর্ম ও পরিচয়ই হয়ে ওঠে অপরাধবোধের উৎস।
অতীতে তারা স্বল্পমেয়াদে কিছুটা সফল হলেও, আজ তারা ব্যর্থ। আর আমরা—যদিও এই প্রক্রিয়ায় সাময়িক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি—তবু এখন কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছি। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—তারা যখন ব্যর্থতার ধুলো ঝেড়ে আবার নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তখন আমরা কী করছি? এই সামান্য স্বস্তিই কি আমাদেরকে হেলান দিয়ে বসে পড়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে? নাকি এটাই সময় আরও সজাগ, সচেতন এবং সক্রিয় হবার?
"কাদরউদ্দীন শিশির"
৬ মার্চ ২০২৫, কাদরউদ্দিন শিশির তার ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট করে, যার শিরোনাম ছিল—"তৌহিদী জনতার আড়ালে কারা?"—সেখানে সে শেখ হাসিনার শাসনামলে যাদের ভিত্তিহীন অভিযোগে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেই ঘটনাগুলোর উদাহরণ টেনে দেখানোর চেষ্টা করে যে, বর্তমানের বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেওয়া দাড়ি-টুপিওয়ালা ব্যক্তিরা এবং তাদের নেতৃত্বদানকারীরা আসলে জঙ্গি ও কোনো না কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত।
এরপর, ৯ মার্চ ২০২৫ তারিখে The Business Standard কাদরউদ্দিন শিশিরের দেওয়া ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল—"Unmasking the 'Tawhidi Janata': Faces behind it"। আমার পর্যবেক্ষণে, ৫ আগস্টের পর জঙ্গি ন্যারেটিভ পুননির্মাণের ক্ষেত্রে এটিই ছিল সেকুলার মহলের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় ও আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ।
১৩ মে ২০২৫ তারিখে, কাদরউদ্দিন শিশির "Introducing The Dissent!" শিরোনামে একটি ফেসবুক পোস্টে জানায় যে, তার এবং আরও কয়েকজন সাংবাদিকের যৌথ উদ্যোগে একটি নতুন মিডিয়া আউটলেট—"The Dissent"—আসছে।
সেই পোস্টে সে লেখে —
"তরুণ ও উদ্যোমী কয়েকজন ডিজিটাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টকে নিয়ে আমরা ছোট একটি টিম গঠন করেছি। বাংলাদেশে ট্রাডিশনাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিম এবং ডিজিটাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের মিশেলে স্বাধীন একটি মিডিয়া আউটলেট এর যাত্রা শুরু করার চেষ্টা। এখনও প্রস্তুতি পর্যায়ে থাকলেও কার্যক্রম ভালভাবেই এগোচ্ছে। ইংরেজি এবং বাংলা উভয় ভাষায় এটি প্রকাশিত হবে।"
"আগামী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আশা করছি পুরোদমে কাজ শুরু করা যাবে। ওয়েবসাইট লাইভ হতে কিছুটা সময় লাগবে। তার আগেই আমাদের টিমের সদস্যরা একটা ভালো স্টোরি পেয়েছেন এবং গত দুই সপ্তাহ এটা নিয়ে কাজ করেছেন। যেহেতু স্টোরিটি প্রকাশযোগ্য হয়েছে তাই আমরা ওয়েবসাইটের অপেক্ষা না করে এটি আমাদের ফেসবুক পেইজেই পোস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
এরপর, ১৫ মে ২০২৫ তারিখে The Dissent তাদের ফেসবুক পেজে প্রকাশ করে প্রতিশ্রুত সেই "ভালো স্টোরি", যার শিরোনাম ছিল—"তালেবানের হয়ে পাক-আফগান সীমান্তে যুদ্ধ করছেন বাংলাদেশি তরুণরা"।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি বিষয় একেবারেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে—বাংলাদেশে জঙ্গি ন্যারেটিভ পুননির্মাণের প্রক্রিয়া এবার ঘোষণা দিয়েই, পূর্ণাঙ্গভাবে ও সংগঠিতভাবে শুরু হলো। সেই রিপোর্টের বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না; আশা রাখি আপনারা নিজ দায়িত্বে পড়ে দেখবেন।
শুধু এটুকু বলতে চাই—এখন সময় গভীর মনোযোগের, ভেবে দেখা ও জাগরণের। কারণ, যা ঘটছে তা কেবল মতপার্থক্যের আলাপ নয়—এটি আমাদের অস্তিত্ব, পরিচয় ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক নিঃশব্দ, সুপরিকল্পিত আঘাত। এই আঘাতের মুখে নীরব থাকা মানেই আত্মবিস্মৃত হওয়া। প্রতিরোধ এখন দায়িত্বই নয়, অপরিহার্যতা। এই লড়াই—আমাদের করতেই হবে, করতেই হবে, এবং করতেই হবে।
Comment