উইঘুর জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনঃ কি করছে জাতিসংঘ?
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা মুসলিম বিদ্বেষী চীনের কিছু গোপন নথি ফাঁস করে দিয়েছে। নথিগুলো চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশের সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর সন্ত্রাসী সরকারের পীড়ননীতি সম্পর্কিত। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের সন্ত্রাসী প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মুসলিমদের প্রতি ‘বিন্দুমাত্র দয়ামায়া না দেখানোর’ জন্য চীনা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে। উইঘুরদের দুর্ভোগের ওপর এটিই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসা সর্বশেষ তথ্য।
চীনের উত্তর-পশ্চিম অংশে সবচেয়ে বড় প্রদেশ জিনজিয়াং। এর আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার (বাংলাদেশের ১২ গুণ)। এ এলাকা আয়তনে চীনের প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ। এর পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে আছে মুসলিম দেশ তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান ও কাজাখস্তান; আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে আফগানিস্তান এবং জম্মু-কাশ্মির। স্বর্ণ, তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরাই উইঘুর মুসলমান। তারা মূলত তুর্কি বংশোদ্ভূত এবং তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত উইঘুর ভাষায় কথা বলেন।
এ ভাষার বর্ণলিপি আরবি। এখানকার অর্থনীতি কৃষি ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। জিনজিয়াং ছাড়াও উইঘুররা বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে আছে। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, জিনজিয়াংয়ে দেড় কোটির মতো উইঘুর বসবাস করে। এ ছাড়া কাজাখস্তানে দুই লাখ ২৩ হাজার, উজবেকিস্তানে ৫৫ হাজার, কিরঘিজস্তানে ৪৯ হাজার, তুরস্কে ১৯ হাজার, রাশিয়ায় চার হাজার, ইউক্রেনে এক হাজারের মতো উইঘুর মুসলিমের বসবাস। এ ছাড়া নির্যাতন থেকে বাঁচতে অনেক উইঘুর জিনজিয়াং থেকে পালিয়ে অভিবাসী হিসেবে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। জিনজিয়াং কাগজ-কলমে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ হলেও চীনের কথিত কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।
চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে উইঘুর মুসলিমদের বিরোধের ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এক সময় ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’ স্বাধীন ছিল। কিন্তু ১৯১১ সালে স্বাধীন তুর্কিস্তানে চীনের মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে প্রত্যক্ষ চীনা শাসন চালু করে এ অঞ্চলকে চীনের জিনজিয়াংয়ের সাথে একীভূত করা হয়। তবে সেটি স্থায়ী করতে চীনাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। চীনের সন্ত্রাসী সৈন্যদের বিপক্ষে মুক্তিকামী উইঘুর মুসলিমরা অস্ত্র তুলে নেয় এবং ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে দুইবার তারা স্বাধীনতাও অর্জন করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে চীনের কথিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কিছু দিন পর কমিউনিস্ট সরকার উইঘুরদের বৃহত্তর চীনের সাথে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব নাকচ করে দিলে শুরু হয় নির্যাতন, নেমে আসে বিভীষিকাময় অত্যাচার। কমিউনিস্টরা অস্ত্রের জোরে জিনজিয়াং দখল করে নেয়। তবে উইঘুর অধ্যুষিত জিনজিয়াংকে দৃশ্যত স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। কিন্তু এর পরও চীন সরকার তাদের ওপর প্রতিনিয়ত দমন ও নিপীড়ন অব্যাহত রাখে।
উইঘুরদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর গায়ের জোরে কমিউনিজম চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়। মসজিদ-মাদরাসা-মক্তব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া ছাড়াও ধর্ম পালনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় হাজার হাজার নিরীহ উইঘুরকে হত্যা করা হয়। অনেককে করা হয় গৃহহীন। কমিউনিস্টরা উইঘুরদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্ম ধ্বংস করে দেয়ার জন্য চীনের অন্য অঞ্চল থেকে হান চীনাদের এখানে এনে পুনর্বাসন করেছে।
ফলে ১৯৪৯ সালে জিনজিয়াংয়ে যেখানে উইঘুর মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৯৫ শতাংশ, ১৯৮০ সালের মধ্যেই তা ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। বর্তমানে নিজেদের ভূখণ্ডে উইঘুরদের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ। চীনাদের দমনপীড়ন থেকে মুক্তিলাভ এবং স্বাধীন হওয়ার জন্য ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি। এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করার চেষ্টা চলে, কিন্তু চীনা সরকার ১৯৯০ সালে সেখানে ভয়াবহ দাঙ্গা উসকে দেয়। পরে এই দাঙ্গার অভিযোগেই হাজার হাজার উইঘুর তরুণকে অন্যায়ভাবে হত্যা এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
এক রিপোর্টে বলছে, ওই দাঙ্গার পর সন্ত্রাসী চীনা সরকারের সমালোচনা করে মতামত প্রকাশের দায়ে চীন সরকার গোপনে বেশ কয়েকজন উইঘুর মুসলিম বুদ্ধিজীবীর বিচার করেছে। বেশ ক’জন বিশিষ্ট উইঘুর ব্যক্তিত্ব গত কয়েক বছরে আটক বা অদৃশ্য হয়ে গেছেন জিনজিয়াং থেকে। এদের মধ্য উল্লেখযোগ্য হলেন ইসলামী শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ সালিহ হাজিম, অর্থনীতিবিদ ইলহাম তোকতি, নৃতাত্ত্বিক রাহাইল দাউদ, পপশিল্পী ও বেহালাবাদক আবদুর রহিম হায়াত, ফুটবল খেলোয়াড় এরফান হিজিম প্রমুখ।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে চীনের ‘সন্ত্রাসবাদ’ কেন্দ্রগুলোতে আটক রাখা হয়েছে। আর ২০ লাখ মানুষকে ‘রাজনৈতিক ও দীক্ষাদান কেন্দ্রে’ অবস্থান করতে বাধ্য করা হচ্ছে। যেসব লোকজনের ২৬টি ‘স্পর্শকাতর দেশে’ আত্মীয়স্বজন আছেন তাদের এসব ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান ও তুরস্ক এবং আরো ২৩টি দেশ। এ ছাড়াও যারা মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করেছে, তাদেরও টার্গেট করেছে কর্তৃপক্ষ।
সংগঠনটি জানায়, জিনজিয়াংয়ে উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘরের দরজায় লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে বিশেষ কোড; বসানো হয়েছে মুখ দেখে শনাক্ত করা যায়- এ রকম ক্যামেরা। ফলে কোন বাড়িতে কারা যাচ্ছেন, থাকছেন বা বের হচ্ছেন তার ওপর কর্তৃপক্ষ সতর্ক নজর রাখতে পারছে। নানা ধরনের বায়োমেট্রিক পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে।
গত মে মাসে প্রথমবারের মতো ওই সব আটককেন্দ্রে কর্মরতদের একজন অকথ্য নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন। একটি আটককেন্দ্রে চাকরি করা সারায়গুল সাউতবে সিএনএনের কাছে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের ভয়াবহতা বর্ণনা করেন। সাউতবে বলেন, তাদের কষ্ট লাঘবে আমার কিছুই করার ছিল না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই যে একদিন এই সত্য প্রকাশ করব।
চীন অস্বীকার করলেও পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা প্রকাশ পেয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সর্বশেষ রিপোর্টে। অভিযুক্ত উইঘুর পরিবারের সন্তানদের নিজের পরিবারে বা এলাকায় রাখা হয় না। তাদের ভিন্ন প্রদেশে ‘শিক্ষা’ গ্রহণ করতে পাঠিয়ে দেয় সরকার। যখন তারা নিজের বাড়িতে ফেরে তখন তাদের জানানো হয়, তোমার পরিবারের লোকজন ‘প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠগ্রহণ’ করছে। তাদের সাথে দেখা হবে যখন তাদের শিক্ষা সমাপ্ত হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানদের সেই অপেক্ষার আর অবসান ঘটে না। ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস বলেছে, বন্দীদের কোনো অভিযোগ গঠন ছাড়াই আটকে রাখা হচ্ছে এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির স্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বন্দীদের ঠিকমতো খেতে দেয়া হয় না। চরম নির্যাতন করা হয়।
২০১৬ সালে ‘মেকিং ফ্যামিলি’ নামের একটি উদ্যোগ চালু করে বেইজিং সরকার। এর মাধ্যমে উইঘুর পরিবারকে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে পাঁচ দিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের অতিথি হিসেবে থাকতে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। মুসলিমদের সাথে পার্টির ‘সুসম্পর্ক সৃষ্টির’ জন্য নাকি এই উদ্যোগ। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মুসলিম নারীদের সম্ভ্রমহানির অভিযোগ ওঠে। মানসিকভাবে শিশুদেরও নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে কমিউনিস্ট পার্টির শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। সেই সাথে শিশুদের মাতৃভাষার পরিবর্তে ম্যান্ডারিন তথা চীনা ভাষা শেখানো হচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বের আরেক প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব সবসময়ই উইঘুরদের ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব থেকেছে। এমনকি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসিসি) কোনো পরিসরেই উইঘুরদের বিষয়ে আলোচনার সুযোগ দেয়নি। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান চীন সফরে গিয়ে উল্টো সুর শুনিয়ে এসেছে। ইহুদি ঘেষা এই প্রিন্স বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে ‘উগ্রবাদ প্রতিহত করা’ ও ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের অধিকার বেইজিংয়ের রয়েছে। তুরস্কের দূতাবাসে ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক আদনান খাশোগিকে খুন করিয়ে সালমান যখন বেকায়দায়, তখনই সে চীনের আনুকূল্য পেতে চেষ্টা করে ওই বক্তব্য দিয়ে। তবে সমালোচিতও হয়েছে এজন্য।
উইঘুর মুসলিমদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ যে থেমে যাবে, এমনটি মনে হয় না। গায়ের জোরে নিপীড়ন চালিয়ে কাউকে চিরকালের জন্য দমিয়ে রাখা যায় না। উইঘুর সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট কবি পেরহাত তুরসুন। তারই একটি কবিতার অংশ দিয়ে তাদের যন্ত্রণার উপলব্ধিটুকু বলে যাই :
‘ময়লাওয়ালার কুৎসিত- কর্কশ হাঁক,/ দালানের ওপর সূর্যালোকের লাবণ্য,/ কম্বল থেকে পাকিয়ে ওঠা বিছানার কড়া গন্ধ,/ একজন মানুষকে ঘাড় ধরে কবুল করতে বাধ্য করে, আহা/ নিশ্চয়ই সূর্য উঠেছে- সূর্য উঠেছে এখানে!’
কবি তুরসুনকে সরকারি বন্দিশিবিরে নিয়ে যেতে দেখেছে এলাকার মানুষ। তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি। কিন্তু তার বাণী রয়ে গেছে! কোনো-না-কোনো উইঘুরের বুকের ভেতরে তা নিশ্চয়ই অনুরণন তোলে। একদিন তা বাক্সময় হবেই।
কিন্তু এসবের মধ্যেই প্রশ্ন জাগে মানবতার পক্ষে অবস্থানকারী কথিত জাতিসংঘের প্রতি। তারা আজ কোন নীরব কারনে নিশ্চুপ? মুসলিম বলে?
সূত্র: https://alfirdaws.org/2019/11/21/28840/
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা মুসলিম বিদ্বেষী চীনের কিছু গোপন নথি ফাঁস করে দিয়েছে। নথিগুলো চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশের সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর সন্ত্রাসী সরকারের পীড়ননীতি সম্পর্কিত। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের সন্ত্রাসী প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মুসলিমদের প্রতি ‘বিন্দুমাত্র দয়ামায়া না দেখানোর’ জন্য চীনা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে। উইঘুরদের দুর্ভোগের ওপর এটিই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসা সর্বশেষ তথ্য।
চীনের উত্তর-পশ্চিম অংশে সবচেয়ে বড় প্রদেশ জিনজিয়াং। এর আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার (বাংলাদেশের ১২ গুণ)। এ এলাকা আয়তনে চীনের প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ। এর পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে আছে মুসলিম দেশ তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান ও কাজাখস্তান; আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে আফগানিস্তান এবং জম্মু-কাশ্মির। স্বর্ণ, তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরাই উইঘুর মুসলমান। তারা মূলত তুর্কি বংশোদ্ভূত এবং তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত উইঘুর ভাষায় কথা বলেন।
এ ভাষার বর্ণলিপি আরবি। এখানকার অর্থনীতি কৃষি ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। জিনজিয়াং ছাড়াও উইঘুররা বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে আছে। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, জিনজিয়াংয়ে দেড় কোটির মতো উইঘুর বসবাস করে। এ ছাড়া কাজাখস্তানে দুই লাখ ২৩ হাজার, উজবেকিস্তানে ৫৫ হাজার, কিরঘিজস্তানে ৪৯ হাজার, তুরস্কে ১৯ হাজার, রাশিয়ায় চার হাজার, ইউক্রেনে এক হাজারের মতো উইঘুর মুসলিমের বসবাস। এ ছাড়া নির্যাতন থেকে বাঁচতে অনেক উইঘুর জিনজিয়াং থেকে পালিয়ে অভিবাসী হিসেবে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। জিনজিয়াং কাগজ-কলমে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ হলেও চীনের কথিত কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।
চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে উইঘুর মুসলিমদের বিরোধের ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এক সময় ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’ স্বাধীন ছিল। কিন্তু ১৯১১ সালে স্বাধীন তুর্কিস্তানে চীনের মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে প্রত্যক্ষ চীনা শাসন চালু করে এ অঞ্চলকে চীনের জিনজিয়াংয়ের সাথে একীভূত করা হয়। তবে সেটি স্থায়ী করতে চীনাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। চীনের সন্ত্রাসী সৈন্যদের বিপক্ষে মুক্তিকামী উইঘুর মুসলিমরা অস্ত্র তুলে নেয় এবং ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে দুইবার তারা স্বাধীনতাও অর্জন করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে চীনের কথিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কিছু দিন পর কমিউনিস্ট সরকার উইঘুরদের বৃহত্তর চীনের সাথে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব নাকচ করে দিলে শুরু হয় নির্যাতন, নেমে আসে বিভীষিকাময় অত্যাচার। কমিউনিস্টরা অস্ত্রের জোরে জিনজিয়াং দখল করে নেয়। তবে উইঘুর অধ্যুষিত জিনজিয়াংকে দৃশ্যত স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। কিন্তু এর পরও চীন সরকার তাদের ওপর প্রতিনিয়ত দমন ও নিপীড়ন অব্যাহত রাখে।
উইঘুরদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর গায়ের জোরে কমিউনিজম চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়। মসজিদ-মাদরাসা-মক্তব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া ছাড়াও ধর্ম পালনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় হাজার হাজার নিরীহ উইঘুরকে হত্যা করা হয়। অনেককে করা হয় গৃহহীন। কমিউনিস্টরা উইঘুরদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্ম ধ্বংস করে দেয়ার জন্য চীনের অন্য অঞ্চল থেকে হান চীনাদের এখানে এনে পুনর্বাসন করেছে।
ফলে ১৯৪৯ সালে জিনজিয়াংয়ে যেখানে উইঘুর মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৯৫ শতাংশ, ১৯৮০ সালের মধ্যেই তা ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। বর্তমানে নিজেদের ভূখণ্ডে উইঘুরদের হার প্রায় ৪৬ শতাংশ। চীনাদের দমনপীড়ন থেকে মুক্তিলাভ এবং স্বাধীন হওয়ার জন্য ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি। এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করার চেষ্টা চলে, কিন্তু চীনা সরকার ১৯৯০ সালে সেখানে ভয়াবহ দাঙ্গা উসকে দেয়। পরে এই দাঙ্গার অভিযোগেই হাজার হাজার উইঘুর তরুণকে অন্যায়ভাবে হত্যা এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
এক রিপোর্টে বলছে, ওই দাঙ্গার পর সন্ত্রাসী চীনা সরকারের সমালোচনা করে মতামত প্রকাশের দায়ে চীন সরকার গোপনে বেশ কয়েকজন উইঘুর মুসলিম বুদ্ধিজীবীর বিচার করেছে। বেশ ক’জন বিশিষ্ট উইঘুর ব্যক্তিত্ব গত কয়েক বছরে আটক বা অদৃশ্য হয়ে গেছেন জিনজিয়াং থেকে। এদের মধ্য উল্লেখযোগ্য হলেন ইসলামী শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ সালিহ হাজিম, অর্থনীতিবিদ ইলহাম তোকতি, নৃতাত্ত্বিক রাহাইল দাউদ, পপশিল্পী ও বেহালাবাদক আবদুর রহিম হায়াত, ফুটবল খেলোয়াড় এরফান হিজিম প্রমুখ।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে চীনের ‘সন্ত্রাসবাদ’ কেন্দ্রগুলোতে আটক রাখা হয়েছে। আর ২০ লাখ মানুষকে ‘রাজনৈতিক ও দীক্ষাদান কেন্দ্রে’ অবস্থান করতে বাধ্য করা হচ্ছে। যেসব লোকজনের ২৬টি ‘স্পর্শকাতর দেশে’ আত্মীয়স্বজন আছেন তাদের এসব ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান ও তুরস্ক এবং আরো ২৩টি দেশ। এ ছাড়াও যারা মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করেছে, তাদেরও টার্গেট করেছে কর্তৃপক্ষ।
সংগঠনটি জানায়, জিনজিয়াংয়ে উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘরের দরজায় লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে বিশেষ কোড; বসানো হয়েছে মুখ দেখে শনাক্ত করা যায়- এ রকম ক্যামেরা। ফলে কোন বাড়িতে কারা যাচ্ছেন, থাকছেন বা বের হচ্ছেন তার ওপর কর্তৃপক্ষ সতর্ক নজর রাখতে পারছে। নানা ধরনের বায়োমেট্রিক পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে।
গত মে মাসে প্রথমবারের মতো ওই সব আটককেন্দ্রে কর্মরতদের একজন অকথ্য নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন। একটি আটককেন্দ্রে চাকরি করা সারায়গুল সাউতবে সিএনএনের কাছে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের ভয়াবহতা বর্ণনা করেন। সাউতবে বলেন, তাদের কষ্ট লাঘবে আমার কিছুই করার ছিল না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই যে একদিন এই সত্য প্রকাশ করব।
চীন অস্বীকার করলেও পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা প্রকাশ পেয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সর্বশেষ রিপোর্টে। অভিযুক্ত উইঘুর পরিবারের সন্তানদের নিজের পরিবারে বা এলাকায় রাখা হয় না। তাদের ভিন্ন প্রদেশে ‘শিক্ষা’ গ্রহণ করতে পাঠিয়ে দেয় সরকার। যখন তারা নিজের বাড়িতে ফেরে তখন তাদের জানানো হয়, তোমার পরিবারের লোকজন ‘প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠগ্রহণ’ করছে। তাদের সাথে দেখা হবে যখন তাদের শিক্ষা সমাপ্ত হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানদের সেই অপেক্ষার আর অবসান ঘটে না। ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস বলেছে, বন্দীদের কোনো অভিযোগ গঠন ছাড়াই আটকে রাখা হচ্ছে এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির স্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বন্দীদের ঠিকমতো খেতে দেয়া হয় না। চরম নির্যাতন করা হয়।
২০১৬ সালে ‘মেকিং ফ্যামিলি’ নামের একটি উদ্যোগ চালু করে বেইজিং সরকার। এর মাধ্যমে উইঘুর পরিবারকে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে পাঁচ দিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের অতিথি হিসেবে থাকতে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। মুসলিমদের সাথে পার্টির ‘সুসম্পর্ক সৃষ্টির’ জন্য নাকি এই উদ্যোগ। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মুসলিম নারীদের সম্ভ্রমহানির অভিযোগ ওঠে। মানসিকভাবে শিশুদেরও নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে কমিউনিস্ট পার্টির শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। সেই সাথে শিশুদের মাতৃভাষার পরিবর্তে ম্যান্ডারিন তথা চীনা ভাষা শেখানো হচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বের আরেক প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব সবসময়ই উইঘুরদের ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব থেকেছে। এমনকি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসিসি) কোনো পরিসরেই উইঘুরদের বিষয়ে আলোচনার সুযোগ দেয়নি। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান চীন সফরে গিয়ে উল্টো সুর শুনিয়ে এসেছে। ইহুদি ঘেষা এই প্রিন্স বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে ‘উগ্রবাদ প্রতিহত করা’ ও ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ পদক্ষেপ বাস্তবায়নের অধিকার বেইজিংয়ের রয়েছে। তুরস্কের দূতাবাসে ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক আদনান খাশোগিকে খুন করিয়ে সালমান যখন বেকায়দায়, তখনই সে চীনের আনুকূল্য পেতে চেষ্টা করে ওই বক্তব্য দিয়ে। তবে সমালোচিতও হয়েছে এজন্য।
উইঘুর মুসলিমদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ যে থেমে যাবে, এমনটি মনে হয় না। গায়ের জোরে নিপীড়ন চালিয়ে কাউকে চিরকালের জন্য দমিয়ে রাখা যায় না। উইঘুর সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট কবি পেরহাত তুরসুন। তারই একটি কবিতার অংশ দিয়ে তাদের যন্ত্রণার উপলব্ধিটুকু বলে যাই :
‘ময়লাওয়ালার কুৎসিত- কর্কশ হাঁক,/ দালানের ওপর সূর্যালোকের লাবণ্য,/ কম্বল থেকে পাকিয়ে ওঠা বিছানার কড়া গন্ধ,/ একজন মানুষকে ঘাড় ধরে কবুল করতে বাধ্য করে, আহা/ নিশ্চয়ই সূর্য উঠেছে- সূর্য উঠেছে এখানে!’
কবি তুরসুনকে সরকারি বন্দিশিবিরে নিয়ে যেতে দেখেছে এলাকার মানুষ। তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি। কিন্তু তার বাণী রয়ে গেছে! কোনো-না-কোনো উইঘুরের বুকের ভেতরে তা নিশ্চয়ই অনুরণন তোলে। একদিন তা বাক্সময় হবেই।
কিন্তু এসবের মধ্যেই প্রশ্ন জাগে মানবতার পক্ষে অবস্থানকারী কথিত জাতিসংঘের প্রতি। তারা আজ কোন নীরব কারনে নিশ্চুপ? মুসলিম বলে?
সূত্র: https://alfirdaws.org/2019/11/21/28840/
Comment