সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার সবচেয়ে বড় দরপতন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে টাকার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৩রা জুলাই। এদিন বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে ১০৮.৮৫ টাকা আন্তঃব্যাংক হারে মার্কিন ডলার বিক্রি শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে একদিনে স্থানীয় মুদ্রার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২ টাকা ৮৫ পয়সা অবমূল্যায়ন হয় বলে জানিয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
একাধিক বিনিময় হার-ভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে বাজার-ভিত্তিক একটি একক বিনিময় হার চালুর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ প্যাকেজের যোগ্যতা অর্জনের জন্য আরোপিত একটি শর্ত পূরণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়।
এর মাধ্যমে গত এক বছর ধরে বাংলাদেশী টাকার অবমূল্যায়িত হওয়ার বিষয়টি আরও গতি পেল। বাংলাদেশী মুদ্রা গত এক বছরে ডলার প্রতি ৯৩.৪৫ টাকা থেকে ১৫.৪ টাকা অবমূল্যায়িত হয়ে বর্তমানে ১০৮.৮৫ টাকা হয়েছে।
করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের শুরুতে বিশ্ব-অর্থনীতিতে এক বিরাট চাপ পড়ে। তেল, গ্যাস, কয়লাসহ বিভিন্ন অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও নিত্যদিনের খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ পড়ে।
কিন্তু গত ৬ মাসে সব দেশেরই মূল্যস্ফীতির চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। নিজেদেরকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশগুলো। এমনকি সম্প্রতি নিজেদের দেওলিয়া ঘোষণা করা শ্রীলংকাও নানা সংকট মোকাবেলা করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনেছে। দেশটি ৬০% থেকে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে নিয়ে এসেছে ১২% এ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উন্নত করেছে – বাংলাদেশী সুশীলরা উঠতে-বসতে যাদের কটাক্ষ করে সেই আফগানিস্তান। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, আফগানিস্তানের মূল্যস্ফীতি -১%। আফগানিস্তানে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য দ্রব্য এবং পেট্রোলিয়ামের মূল্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম এবং স্থিতিশীল। আফগানিস্তানের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্য কমছে এবং আফগানিস্তানের মুদ্রা সর্বাধিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে।
এভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের দামও কমে ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারে নেমেছে। নিয়মিত কমছে অন্যান্য দ্রব্য ও খাদ্যশস্যের দামও। ভোগ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে কোভিড-পূর্ব স্থিরতা আসছে।
কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বাজারে। এখানে এখনও যেন করোনা-মহামারীর স্থবিরতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমস্ত ব্যয়ভারের দায়িত্ব যেন পড়েছে বাংলাদেশের উপর! বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য দ্রব্যাদির দাম প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি কাঁচা মরিচের মতো দ্রব্যের দাম বেড়ে হয়েছিল কেজি প্রতি ১০০০ টাকার ওপরে। পরে দাম কিছুটা কমলেও ফিরে আসেনি আগের জায়গায়। এদেশে একবার কোনো জিনিসের দাম বেড়ে গেলে, সেটা আগের জায়গায় ফিরে আসা যেন অসম্ভব। এর আগে একবার ২০-২৫ টাকা কেজি পেঁয়াজের দাম একলাফে বেড়ে হয়েছিল ৩০০ টাকা! এরপর পেঁয়াজের দাম কমেছে, তবে আর কখনও ৪০-৫০ টাকার নিচে নামতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে সরকারি দলের ব্যবসায়ি নেতাদের সিন্ডিকেট, সরকারের দুর্নীতি আর নজরদারি ও সদিচ্ছার অভাবই মূল অনুঘটক।
দেশের অর্থনীতির এমন দুরাবস্থার অবসানে সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদগণ।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বণিকবার্তাকে বলেন, ‘কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে যেসব উদ্যোগের মাধ্যমে সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেধে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়।’
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে না কমার কারণ হিসেবে বাজার ব্যবস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতাকেই তুলে ধরেন এই অর্থনীতিবিদ।
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমানও দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেছেন, ‘দেশে আমদানি থেকে ভোক্তা এবং উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। চাহিদা ও সরবরাহ, সরকারের নিজস্ব মজুদ এবং আমদানির মধ্যে সমন্বয় থাকলে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি কিছুটা কমানো যেত।’
কিন্তু বাংলাদেশের সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না। তারা যেন মূল্যস্ফীতিকে পুঁজি করে নিজেদের পকেট ভারী করার উপায় খুঁজছে। সাধারণ কোনো জিনিস কেনার নাম করে বিদেশ ভ্রমণ কিংবা বিভিন্ন অপরিকল্পিত আমদানির নামে দুর্নীতি করে টাকা মেরে দেওয়া এই সরকারের অত্যন্ত পছন্দনীয় ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। এর কারণে ভাটা পড়েছে দেশের বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভে, কমেছে টাকার মান, বেড়েছে মূল্যস্ফীতি।
তথ্যসূত্র:
1. Taka sees biggest fall against dollar
– https://tinyurl.com/n6uy24as
2. সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমছে, বাংলাদেশে নয়
– https://tinyurl.com/4n5bzcub
3. Inflation rate in Afghanistan dropped to negative one – https://tinyurl.com/4d4r8xhc
4. Inflation Rate Statistics
– https://tinyurl.com/2wr55fet
Comment