Announcement

Collapse
No announcement yet.

‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-৯ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-৯ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

    কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত:
    পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি


    রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা

    (প্রথম খণ্ড)

    -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ


    মূল প্রকাশনায়:

    আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)

    সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
    • ইসলামের ব্যাপারে জেসুইটদের মিথ্যাচার সম্পর্কে লেভান্টের লোকদের অভিযোগ
    এর অন্যতম উদাহরণ হল আল-মানার[1] পত্রিকায় যে অভিযোগ এসেছে যে, ম্যাগাজিন (আল-মাশরিক) প্রকাশ্যে ইসলামের সমালোচনা শুরু করেছিল।
    শাইখ মুহম্মদ রশিদ রিদা রহিমাহুল্লাহ (আল-মাশরিক) ম্যাগাজিনের বাড়াবাড়ির ব্যাপারে খুব সুন্দর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগকারীদেরকে তাদের বিস্তারিত অভিযোগ নামা তুলে ধরতে বলেছেন। এরপর ওই সমস্ত ধর্মতত্ত্ববিদ ও পণ্ডিতদের বক্তব্য দিয়ে তিনি ম্যাগাজিনকে খণ্ডন করেছেন, যারা এ শতাব্দীতে যীশুর দেবত্বের বিশ্বাস থেকে ফিরে আসতে শুরু করেছেন।[2].[3]
    • শাইখ মুহাম্মাদ রশিদ রিদা রহিমাহুল্লাহ রচিত 'আল-ওয়াহইয়ুল মুহাম্মাদী' গ্রন্থের সমালোচনা করতে গিয়ে আল-মাশরিক ম্যাগাজিনে ইসলাম ও কোরআন সম্পর্কে একজন জেসুইট লেখকের মিথ্যাচার
    শাইখ মুহাম্মাদ রশিদ রিদা রহিমাহুল্লাহ বিশদ আকারে ওই ব্যক্তির বক্তব্য অপনোদন করেছেন। শাইখের ওই আলোচনায় খ্রিস্টান ধর্মে বিকৃতির আলোচনা সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে।[4].[5]
    এসব উদাহরণের দ্বারা প্রতীয়মান হয়ে ওঠে যে, আল-মাশরিক ম্যাগাজিন এবং জেসুইটদের সমস্ত পত্র পত্রিকার কাজ হল, তাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক আলোচনার আড়ালে ইসলামের ব্যাপারে মিথ্যাচার করা।

    ***

    ৩. ক্যাথলিক প্রিন্টিং প্রেস
    ক্যাথলিক প্রিন্টিং প্রেস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়। এটি প্রথমে পাথরের ওপর বিভিন্ন বই মুদ্রণ করে, তারপর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে অক্ষরে বই ছাপে প্রতিষ্ঠানটি।[6]
    অনেক ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক বই ও ম্যাগাজিন ছাড়াও তাদের ছাপা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর মধ্যে একটি ছিল খ্রিস্টান বাইবেল। ক্যাথলিক প্রিন্টিং প্রেস ছিল খ্রিস্টীয়করণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, যা জেসুইটরা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল।[7]

    *****
    (চলবে, ইন শা আল্লাহ)
    [1] আল-মানার, সংখ্যা: শাবান ১৩৪০ হিজরি, এপ্রিল ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ, খণ্ড: ২৩, পৃষ্ঠা: ২৬৭

    [2] আল-মানার ম্যাগাজিনে মূল অভিযোগ এবং তার খণ্ডন
    বৈরুত থেকে আমাদেরকে পত্র মারফত জানানো হয়েছে, জেসুইট ম্যাগাজিন (আল-মাশরিক) খোলাখুলি ইসলামের ব্যাপারে মিথ্যাচার করতে আরম্ভ করেছে। যেহেতু অটোমান সরকার এখন আর নেই, তাই তারা সুযোগ পেয়েছে। অটোমান সরকার থাকাকালে তাদের এই খোলাখুলি মিথ্যাচারের পথে বাধাপ্রাপ্ত হতে হতো। তাই কখনো কখনো এই ম্যাগাজিন মূলভাব অপব্যাখ্যার সুযোগ রেখে ইশারা-ইঙ্গিতে বিভিন্ন বার্তা দিত।
    যাই হোক, আল-মানার কর্তৃপক্ষ তাদেরকে অপনোদনের ব্যাপারে আমাদের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করে। কারণ ইসলামের প্রতিরক্ষা এবং ইসলামবিরোধী সকল অপপ্রচারের জবাব দেয়া আল-মানার ম্যাগাজিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। তাদের মনে হয়েছিল, এ বিষয়ে নীরবতা ক্ষতিকর অভ্যাসের দিকে নিয়ে যাবে ম্যাগাজিনকে। যেহেতু আমাদের নানামুখী বহু কাজের চাপে ওই ম্যাগাজিন পুরোটা পড়ে দেখার সুযোগ আমাদের হয়ে উঠতো না যে, আমরা ওই ম্যাগাজিনের মাধ্যমে প্রচারিত সবকিছু সম্পর্কে জানতে পারব, তাই আমরা আল-মানার কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি, তাদের মিথ্যাচারপূর্ণ বক্তব্য আমাদেরকে উদ্ধৃত করে দিয়ে কিংবা সুনির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে দিয়ে তারা যেন আমাদেরকে সাহায্য করে।
    এ ছিল একদিকের কথা। অপরদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট প্রচারকেরা মিশর সহ অন্যান্য অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপারে মিথ্যাচার, ইসলাম থেকে মানুষকে দূরে সরানো এবং নিজেদের ধর্মের পথে আহ্বানের লক্ষ্যে বরাবরই তাদের প্রকাশনা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি তাদের বক্তব্যের দুর্বলতা, অযৌক্তিকতা, অন্তঃসারশূন্যতা বারবার একই রকম হবার কারণে তাদের প্রকাশিত বুলেটিনগুলো পাঠ করে দেখার আগ্রহ আমাদের ছিল না। এ কারণেই ওই সময়টাতে আমরা এ সম্পর্কে নীরব ছিলাম। তাদের পত্র-পত্রিকার উপরও আমরা নজর দিতে পারিনি। তবে সুদানে আল-মানার প্রবেশে বাধা দিয়ে তারা যেভাবে সফল হয়েছে, সে সম্পর্কে আমরা নীরব থাকতে পারিনি। তাদের এমন কর্মকাণ্ড প্রমাণ করেছে, ধর্মীয় স্বাধীনতার দাবি তুলে ইংরেজদের দেখানো দাম্ভিকতা মূলত লৌকিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
    আমরা ইতিপূর্বেও সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছি, আমরা মনে করি, তাদের ওই সমস্ত মিথ্যাচার ধর্মীয় ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য কোন ক্ষতি ডেকে আনবে না। খ্রিস্টান ধর্মের দিকে মুসলমানদেরকে আহ্বান করার ক্ষেত্রেও তারা সুবিধা করতে পারবে না। বরং তাদের এমন কর্মকাণ্ড মুসলমানদের মাঝে খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে আরো বেশি ঘৃণা সৃষ্টি করবে। যারা তাদের ধর্ম সম্পর্কে জানে, তারা ইসলামকে আরো ভালোভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং আগলে রাখবে।
    --------------------------------
    আর ইসলাম সহজাত রুচিবোধ, বিজ্ঞান ও যুক্তির ধর্ম। এদিকে বর্তমান খ্রিস্টধর্ম নির্বিচারে অন্ধভাবে চার্চকে অনুকরণ করার বাধ্যবাধকতার উপর ভিত্তিশীল হয়ে আছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের যারা এই অন্ধ অনুকরণ পরিত্যাগ করবে, চার্চের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, গির্জার কাছে অথবা নিজেদের কাছেই তারা দলিল-প্রমাণ খোঁজ করবে এবং ধর্মীয় বুঝ লাভের ক্ষেত্রে বুদ্ধি-বিবেচনাকে নিরপেক্ষভাবে ছেড়ে দেবে, নিঃসন্দেহে তারা ইসলামের আনীত বিষয়ের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত; চাই তারা কুরআনে সাব্যস্ত বাস্তবতাসমূহ সম্পর্কে অবগতি লাভ করুক কিংবা না করুক। বর্তমানে কতগুলো ইউরোপীয় রাষ্ট্রে এটাই বাস্তবতা। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফম্যাগাজিন থেকে আমরা এখানে যা উদ্ধৃত করেছি, তা থেকেই এই বাস্তবতা প্রমাণ হয়। এ ধরনের আলোচনা নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া তাওহীদের বিশ্বাস, ট্রিনিটি ও খ্রিস্টের দেবত্বের বিশ্বাস থেকে প্রত্যাবর্তন, এ বিষয়ে কুরআন কর্তৃক সাব্যস্ত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ, সর্বত্র কুরআনের হেদায়েত ও আলো ছড়িয়ে দেয়া এবং কিতাবুল্লাহর মাধ্যমে বস্তুবাদের কুফল ও সমাজতন্ত্রের অনিষ্ট থেকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবে। সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত আয়াতে বিধৃৎ স্বীয় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন
    سَنُرِيْهِمْ اٰيٰتِنَا فِى الْاٰ فَا قِ وَفِيْۤ اَنْفُسِهِمْ حَتّٰى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ اَنَّهُ الْحَـقُّۗاَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ اَنَّهٗ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيْدٌ
    "আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব দূর দিগন্তে (অর্থাৎ দূর পর্যন্ত ইসলামের আলো বিচ্ছুরিত হবে) আর তাদের নিজেদের মধ্যেও (অর্থাৎ কাফিররা নতজানু হয়ে ইসলাম কবুল করবে) যখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এ কুরআন সত্য। এটা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার প্রতিপালক সব কিছুরই সাক্ষী।" (সূরা ফুসসিলাত ৫৩)
    ---------------------------------
    ইউরোপে বসবাসকারী একজন বিচক্ষণ মুসলিম ব্যক্তি ইউরোপের ধর্মীয়, সাহিত্যিক ও সামাজিক বিকাশ পর্যবেক্ষণ করে তার এক বন্ধুকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন: আমি আপনাকে জানাতে চাই, খ্রিস্টের দেবত্বের প্রশ্নটি ইংরেজদের দেশে ধর্মীয় ও দার্শনিক বিষয়াবলী নিয়ে ব্যাপৃত গবেষক ও চিন্তাবিদ মহলেবিশেষ করে অ্যাংলিকান ধর্মযাজকদের মাঝেসবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজি পত্র-পত্রিকার পাতায় সাম্প্রতিক সময়ে যা প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে এটা স্পষ্ট। আমি এক্ষণে ওই সমস্ত তর্কালাপের একটি উদাহরণ আপনাকে পাঠাচ্ছি, যা আমরা সংবাদপত্র দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফথেকে সংগ্রহ করেছি। লেখক সংবাদপত্র (দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ) থেকে যা সংগ্রহ করেছেন তার অনুবাদ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

    ***
    আল্লাহর সঙ্গে খ্রিস্টের সম্পর্ক
    ১৩-৮-১৯২১ তারিখ, আমাদের নিজস্ব বার্তাবাহক, ক্যামব্রিজ
    উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্যগত মতবাদ থেকে আধুনিক ধর্মতত্ত্ববিদদের প্রস্থানের মাত্রা আজ পাদ্রিদের সম্মেলনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পূর্ণ শ্রদ্ধাভাজন কার্লাইলের আর্চবিশপ 'হাস্টেন্স রাশেডোল' ‘খ্রিস্ট আল্লাহর বাণী ও পুত্রবিষয়ে বক্তৃতা করেছিলেন এবং বলেছিলেন : মুক্ত ধর্মতত্ত্ববিদদের চাহিদা বাড়ছে।
    [আল-মানার ম্যাগাজিন এখানে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছে:
    (৩) আল-মানার: স্বাধীনচেতা এ সমস্ত ধর্মতত্ত্ববিদের বিপরীতে রয়েছে এমন কতক অন্ধ অনুসারী পণ্ডিত, যারা দলিল-প্রমাণের দিকে একদমই নজর দেয় না। এরপর ডক্টর সাহেবের সুস্পষ্ট বক্তব্য এদিকেই ইঙ্গিত করছে যে, স্বাধীনচেতা কতক ধর্মতত্ত্ববিদ তাদের ধর্মে অন্ধানুসরণ বাতিল হবার বিষয়টা তাদের কাছে স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তা প্রকাশের দুঃসাহস করতে পারেন না। তাই তারা লেখালেখির মাধ্যমে কিংবা ব্যাখ্যার অবকাশযুক্ত ইঙ্গিত প্রদানের মাধ্যমে সে কথা ব্যক্ত করে থাকেন।]
    স্বাধীনচেতা ধর্মতত্ত্ববিদদের চাহিদা এ কারণে বাড়ছে, যেন তারা যা বোঝাতে চান, দ্ব্যর্থহীনভাবে তা প্রকাশ করে দেন। কারণ তারা তো খ্রিস্টের দেবত্ব সম্পর্কে সেই অন্ধানুকরণ মূলক বাক্যগুলো ব্যবহার করে আসছেন দেখা যায়। ডক্টর সাহেব (রাশেডোল) এ বিষয়টাকে তার নেতিবাচক দিক থেকে পরীক্ষা করতে আরম্ভ করে বলেছেন: নিশ্চয়ই যীশু নিজের জন্য দেবত্বের অধিকারী হবার দাবি করেননি। জি হ্যাঁ, এটা হতে পারে কখনো তিনি নিজেকে 'মাসায়া' ডেকেছেন অথবা কেউ ডেকে থাকলে তাতে সায় দিয়েছেন।
    [আল-মানার ম্যাগাজিন এখানে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছে:
    (৪) مسيا بتشديد الياء - এ শব্দটিতে ইয়া অক্ষরে তাশদীদ হবে। অর্থ হল মসীহ। এ হলো ওই বাদশা, ইহুদীরা বরাবরই যার অপেক্ষায় বসে আছে।]
    অথবা যীশু নিজেকে ইবনুল্লাহ (আল্লাহর পুত্র বা বান্দা) ডেকেছেন। কিন্তু তার থেকে এমন কোন বর্ণনা সাব্যস্ত হয়নি যার দ্বারা বোঝা যায়, তিনি আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ককে আল্লাহর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্কের বাইরে মনে করতেন। তার তো তেমনি সম্পর্ক ছিল, যা প্রতিটা মানুষ অনুভব করতে চায়। এই উক্তি থেকে এ কথা বুঝতে পারা যায়, 'কালিমা' শব্দের যে কোন অর্থই ধরা হোক, মাসীহ একজন মানব ছিলেন। তিনি কেবল দৈহিকভাবেই মানব ছিলেন না; বরং তার ব্যক্তিসত্তা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছুই মানবিক ছিল। গির্জা সর্বদা এ বিষয়টি স্বীকার করে নেয় না।
    -----------------------------
    ***
    মাসীহের অনুভূতি
    রিবন হলের (অক্সফোর্ড) প্রধান মেজর পাদ্রি এইচ ডি এ তাকে অনুসরণ করেছেন এবং (ঈশ্বরীয় পুত্রত্বে খ্রিস্ট বা খ্রিস্টের ঈশ্বরীয় পুত্রত্ব) দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কেই স্বীয় আলোচনা রেখে বলেছেন: গসপেলের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে অন্যতম কঠিন একটা সমস্যা হল, নিজ সম্পর্কে খ্রিস্টের মতের প্রকৃতি জানা যে, তিনি আল্লাহর পুত্র কিনা?!
    ------------
    অতঃপর বক্তা সে বিষয়টা তুলে ধরেছেন যে, মাসীহ দাবি করেছেন, তিনি আপন অস্তিত্বের আগেই অনুভূতি ও জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। চতুর্থ গসপেলে এমনটাই সাব্যস্ত হয়েছে। তাই তিনি বলেছেন: তিনি মনে করেন, ধর্মতত্ত্ববিদরা আজ পুরোপুরি স্পষ্ট করে দিতে পারে যে, মসীহের অনুভূতি ছিল পুরোপুরি মানবিক। অস্তিত্বে আসার আগে তার কোন অনুভব-অনুভূতি ও ক্ষমতা ছিল না। আর এতে অলৌকিকতার কিছু নেই। এখানে কোন মুজেজা নেই। কারণ তিনি ছাড়া অন্য কারো কর্মকাণ্ডকে মুজেজা বা অলৌকিক বিষয় বলা সম্ভব নয়। আর তার ঈশ্বর পুত্র হবার ব্যাপারে কথা হলো, তিনি ধর্মতত্ত্ববিদদের জন্য তাকে ইলাহি বা ঐশ্বরিক ডাকাকে বৈধ করেছেন। চতুর্থ গসপেলের মাঝে এভাবেই ডাকা হয়েছে। কারণ, পাদ্রি মেজর মনে করেন, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য এমন শব্দ ব্যবহার সঠিক রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ব্যবহার মাসীহ অনুমোদন করেননি। এমনটা যেন কেউ মনে না করে, মাসীহকে যে উপাধিতে ভূষিত করা হয়, তার উপর তিনি কোন গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
    ..............
    (দীর্ঘ আলোচনার শেষ পর্যন্ত) যা ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এসেছে।
    এ থেকে পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তারা এ বিষয়ে সে যাচাই, বিবেচনা, সংশোধন ও পরিশুদ্ধির পথে ফিরে আসছে, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য বর্ণনা করে দিয়েছেন। সত্য-সঠিক বর্ণনাকারী রুহুল আমীন (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) মাধ্যমে পরিশুদ্ধির সেই বাণী সম্পর্কে ঈসা মাসীহ সুসংবাদ প্রদান করেছেন এবং বলেছেন: নিশ্চয়ই তিনি তাদেরকে সবকিছু শিক্ষা দান করেন! এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজাহানের পালনকর্তা।

    [3] শাইখ আহমাদ দীদাত রহিমাহুল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার আহমদ আব্দুল ওয়াহাব, সেই সাথে ব্রিটিশ এনসাইক্লোপিডিয়া এমনটাই বর্ণনা করেছে। الجواب الفسيح فيما لفقه عبد المسيح গ্রন্থের ব্যাপারে মন্তব্য করার সময় শাইখ আহমদ হেজাজী আল-সাক্কার উক্তি নিয়ে আলোচনা কালে এ বিষয়টা অচিরেই আসছে (ইনশা আল্লাহ) যে, কপটিক অর্থোডক্সরা তাওহীদপন্থী, কিন্তু তারা এই বিশ্বাসের কারণে কাফের যে, ঈসা আলাইহিস সালামের মাঝে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দৈহিকভাবে প্রবেশ করেন। খ্রিস্টানদের বাইবেলে বিকৃতি নিয়ে আলোচনাকালে ইনশা আল্লাহ, আমি এদিকে ইঙ্গিত করব।


    [4] তিনি কয়েক অংশে যা লিখেছেন, উপকারের আশায় আমি তা উদ্ধৃত করব, যা কিছুটা দীর্ঘ হতে পারে
    'আল-ওয়াহইউল মুহাম্মদী' গ্রন্থের ব্যাপারে জেসুইট লেখকের আপত্তি খণ্ডন
    [বৈরুতের ক্যাথলিক ম্যাগাজিন আল-মাশরিকে লেখক তার লেখা প্রকাশ করেন। আমি তার আলোচ্য বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্তসার উল্লেখ করব; নিজের মতো করে এবং সেগুলোর খণ্ডন তুলে ধরবো।]
    ---------------------------
    (৩) বস্তুবাদী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা ধারার উৎকর্ষের তুলনায় নীতি নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক শিষ্টাচারের অধঃপতন:
    আল-ওয়াহই গ্রন্থের ভূমিকায় এই যে বাস্তবতাটা আমরা বর্ণনা করেছি, সেটার ব্যাপারে ক্যাথলিক জেসুইট লেখক আমাদের মতের বিরুদ্ধে। তার বক্তব্য হল, নীতি নৈতিকতা, আদব শিষ্টাচার ও কল্যাণমুখী ভাবধারা যেকোনো মানদণ্ডেই বিচার করা হোক না কেন, এ যুগে সেগুলো যতটা চর্চাবহুল, প্রাচ্যে বা পাশ্চাত্যে কোন যুগেই তা এতটা চর্চিত হয়নি। আর এটা সম্ভবত হয়েছে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির কল্যাণে!!!
    সুবহানাল্লাহ! খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা একজন লেখক এ কথা বলতে পারে? অথচ সেটাই ঘটেছে। তিনি এসব কথা লিখেছেন এবং জেসুইট আল-মাশরিক ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছেন। এটা তো কোন মানুষের কল্পনাতেও আসার কথা নয়।
    -----------------
    পর্যালোচনাকারী সমালোচকের বক্তব্য: আমি সাধারণভাবে সকল জাতি-গোষ্ঠীর ব্যাপারে ঢালাও হুকুম বর্ণনা করেছি। এজমালিভাবে এটা ঠিক আছে, তবে বিস্তারিতভাবে নয়। আমি প্রথমত এবং মূলগতভাবে ইউরোপের জনগণের ব্যাপারে এই হুকুম পেশ করি। আরো করি ওই সমস্ত লোকের ব্যাপারে, সমস্ত জাতি-গোষ্ঠীর ভেতর যারা বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা এবং স্বেচ্ছাচারিতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। পশ্চিমাদের মাঝে নীতি-নৈতিকতার ব্যবস্থা তাদের মাঝে খ্রিস্টান ধর্মের যত গুণ ও শিষ্টাচার অবশিষ্ট রেখেছিল, আজ সেগুলো থেকেও তারা বিচ্যুত হবার কারণে তাদের প্রতি আমার নিন্দা; ইসলামী গুণাবলী ও শিষ্টাচার সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা তো আছেই।
    ---------------------------
    স্বেচ্ছাচারিতা, অবাধ মেলামেশা, বিবাহের পবিত্র বন্ধন ভেঙে ফেলা ইত্যাদির অন্ধকূপে পশ্চিমা জনগণের আটকে পড়ার কথা আর কি বলবো? আর সম্পদের উপাসনা করার কথা বলাই বাহুল্য। কারণ, জেসুইটরা অর্থের পূজায় ইহুদিদের চেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত। শুধু তাই নয় বরং ইহুদীরা ছাড়াও অন্যান্য শ্রেণীর পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর চেয়েও তাদের বাড়াবাড়ি বেশি। এ বিষয়ে তাদের গোপন নীতির কথা আমার জানা আছে। তারা নিজেদের চর্চিত সেই গোপন নীতির মাধ্যমে গসপেলের উপদেশমালার বিরোধিতায় লিপ্ত। তাদের নিয়ম হলো, “লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাধুতা লক্ষ্য অর্জনের যে কোন মাধ্যমকে বৈধতা দান করে।আর ব্যভিচার, সাময়িক যৌন সঙ্গী বানাবার ফ্যাশন কিংবা যাকে তারা বলে থাকে শ্বেতাঙ্গ দাসী, এমন সংস্কৃতির মাধ্যমে নারীদের সম্মান-সম্ভ্রম বাজারজাত করে ফেলা, জনগণের জন্য সর্বনাশা ভয়ংকর ও এমন ধ্বংসাত্মক মাত্রার সীমালংঘনের সাথে যুদ্ধের হিংস্রতার অনুমোদন, প্রতিদিন ইউরোপকে জড়িয়ে যে সর্বনাশের সংবাদ টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, কে জানে এগুলো সবই তাদের মাঝে চর্চিত সেই নিয়মের আওতাভুক্ত কিনা।
    ------------------
    শুধু তাই নয় বরং ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্মের চর্চা কোথায়? ইংল্যান্ডের কতক বিশপ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, মাসীহ কোন পিতাও নন, ঈশ্বরও নন। জনগণ যখন বাইবেলের সুরক্ষিত থাকা সম্পর্কে কিরূপ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে, এমন কথা জিজ্ঞেস করেছে, তখন হাজার হাজার বিশপ বাইবেল সুরক্ষিত না থাকার ফতোয়া দিয়েছেন। আল-মানার ম্যাগাজিনে আমরা ইতিপূর্বে সে কথা উল্লেখ করেছি।
    অতঃপর শাইখ রহিমাহুল্লাহ পরবর্তী সংখ্যায় অপনোদনমূলক আলোচনা জারি রেখে লিখেছেন:
    'আল-ওয়াহইউল মুহাম্মদী' গ্রন্থের ব্যাপারে জেসুইট লেখকের আপত্তি খণ্ডন
    -(পূর্বের পর থেকে)
    -(২)
    -৪-
    ইসলামের পথে গির্জার প্রতিবন্ধকতা তৈরি
    আমরা আমাদের গ্রন্থের ভূমিকায় ইউরোপে ইসলামের বাস্তবতা প্রবেশের পথে থাকা তিনটে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে যে আলোচনা করেছি, লেখক সংক্ষিপ্ত আকারে সেদিকে ইশারা করেছেন। এরপর সেটার পক্ষে জবাব এভাবে দাঁড় করেছেন যে, ইসলামের পথে গির্জার প্রতিবন্ধকতা তৈরি ও বক্র আচরণ পুনরায় আর ঘটেনি। আর তর্ক-বিতর্কের শিষ্টাচার ও আদব সম্পর্কে লেখক বলেছেন, আমরা গির্জার উপর অপবাদ আরোপ করেছি, শিষ্টাচার রক্ষা করতে পারিনি।
    আমি তার কথার জবাব এভাবে দিতে চাই, আমরা নিজেদের পক্ষ থেকে গির্জার ব্যাপারে কোন মিথ্যাচার করিনি। আর যা কিছু বলেছি, গির্জার যত কর্মকাণ্ড বর্ণনা করেছি, কোনটাই আমাদের উলামায়ে কেরামের কারো সূত্রে বর্ণনা করিনি।
    বরং, কতক পশ্চিমা পণ্ডিত এই বিষয়ে যা লিখেছেন, আমরা তার সংক্ষিপ্তসার উল্লেখ করেছি, বিশেষত মুক্তমনা ফরাসি লেখক এবং তাদের মধ্যে আপেক্ষিক ন্যায়বিচার ও সত্যনিষ্ঠার অধিকারী যারা, যেমন الإسلام: خواطر وسوانح- গ্রন্থের লেখক কাউন্ট ডি ক্যাস্ট্রি। এমনিভাবে অন্যান্য অনেক বই, যার সবগুলোই বা অধিকাংশই জেসুইট কলেজের লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়, সেগুলো থেকেই আমরা উল্লেখ করেছি।
    সম্মানিত সাহিত্যিক লেখক তর্ককালীন শিষ্টাচার রক্ষা এবং গির্জা কর্তৃক ইসলামের পথে বরাবরই প্রতিবন্ধকতা তৈরীর বিষয়ে অস্বীকারের যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তা ধরে রাখা সম্ভব। তখন গির্জাকে রক্ষা করার জন্য শুধু এতোটুকু বলাই যথেষ্ট হবে, ফরাসি যে সমস্ত লেখক গির্জার ব্যাপারে এসব কথা বলেছেন, যারা ক্যাথলিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন এবং এই মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছেন, যাদের মাঝে সর্বশেষ ব্যক্তি হলেন (দ্য লাইফ অফ মুহাম্মাদ) গ্রন্থের ফরাসি ক্যাথলিক লেখক মুসিও ডারমিংহাম, গির্জার পাদ্রিদলসহ অন্যান্যদের ব্যাপারে তারা যা কিছু বলেছেন ও লিখেছেন, সবই হলো তাদের বিরুদ্ধে বানোয়াট কথাবার্তা, অপবাদ ও মিথ্যাচার।
    অতঃপর লেখক আমার এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন: সঠিক কথা হল ইসলাম ধর্ম খ্রিস্টধর্মের মিত্র এবং এ ধর্মের হেদায়েতকে পূর্ণতা দানকারী।তিনি আমার এই বক্তব্যকে শিশুসুলভ সরলতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। যদি আমি বলতাম, ইসলাম হলো গির্জা শাসিত ধর্মের মিত্র, তাহলে আমি এমন সরলতা করেছি বলে কথিত হবার যোগ্য হতাম। কিন্তু দলিল-প্রমাণের দ্বারা সাব্যস্ত ইসলামিক বিশ্বাস মতে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আমার বিশ্বাস হল, গির্জাশাসিত ধর্ম আর সেটি এক নয়। খ্রিস্টধর্মে রয়েছে তাওহীদের হেদায়েত, এমন গুণাবলী ও শিষ্টাচার সমষ্টি, যা ইসরাইলি তাওরাতের হেদায়েতকে পূর্ণতা দানকারী। এমনটা মেনে নিলেই ঈসা আলাইহিস সালামের যে বক্তব্য তারা বর্ণনা করে, তার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের মিল পাওয়া যায়। তিনি ইরশাদ করেছিলেন: "আমি পূর্ব শরীয়ত ভেঙে দিতে আসিনি, আমি এসেছি তাকে পূর্ণতা দান করতে।"
    অথচ গির্জা প্রথমেই পূর্ব শরীয়তের মূল ভিত্তি ভেঙে দিয়েছে। আর তা হল নিখাদ ভেজালমুক্ত তাওহীদ এবং উপাসনা, আচার-অনুষ্ঠান ও নাগরিক প্রশাসনের সবকিছুতে ছবি ও মূর্তি পরিহার।
    এরপর ইসলাম হল খ্রিস্টধর্মের পূর্ণতাদানকারী। কারণ ঈসা আলাইহিস সালামের পর এমন কারো আবির্ভাব ঘটেনি, যার ব্যাপারে ঈসা আলাইহিস সালামের এ কথা প্রযোজ্য হতে পারে: তিনি তোমাদেরকে সবকিছু শিক্ষা দান করবেনঅর্থাৎ এমন সবকিছু, যা একজন নবী ছাড়া কারো পক্ষে নিজ সম্প্রদায়কে বলা সম্ভব নয়। ইনি হলেন প্যারাক্লিট, পবিত্র আত্মা যেমনটা আমরা আমাদের 'আল ওয়াহই' গ্রন্থসহ অন্যত্র বর্ণনা করেছি।
    ........
    শাইখ রহিমাহুল্লাহ পরবর্তী প্রবন্ধে খণ্ডনের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
    তিনি লিখেছেন:
    'আল-ওয়াহইউল মুহাম্মদী' গ্রন্থের ব্যাপারে জেসুইট লেখকের আপত্তি খণ্ডন
    (পূর্বের অংশের পর থেকে)
    কুরআনের মুজেজা বা অলৌকিকতা
    এখানে আমি উদ্ধৃত করব, আল-মাশরিক ম্যাগাজিন কুরআনের অক্ষরসমূহের মুজেজা নিয়ে কিরূপ মিথ্যাচার প্রচার করেছে! অতঃপর আমি দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে তাদের মিথ্যাচার খণ্ডন করব। আমার এই কাজ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কেউই করবে না। ক্যাথলিক সম্প্রদায় হোক বা অন্য শ্রেণী, কেউই না। কারণ, তারা ভালো করেই জানে, যদি তারা আমাদের বক্তব্য তাদের অনুসারীদের কাছে পৌঁছে দেয়, তাহলে অনুসারীদের মনকে আশ্বস্ত করার মত কিছু বলে তারা আর আমাদের বক্তব্য খণ্ডন করতে পারবে না। অনুসারীদের ব্যাপারেই যখন এমন আশঙ্কা, অন্যদের কথা আর কি বলব।
    আল-মাশরিক ম্যাগাজিনের ১৯৩৩ সনের ৯৫৭ ও ৯৫৮ নং পৃষ্ঠায় শাব্দিক ও অর্থগত ভুল সহকারে যা বলা হয়েছে, তা নিম্নরূপ:
    আমরা সকলেই জানি, মুসলমানরা মুহাম্মদের নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণের জন্য তাদের কিতাবকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। এই কিতাব তাদের কাছে সকল নিদর্শনের মূল, এক মহাবিস্ময়, দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা। যুগ যুগান্তরে এ গ্রন্থ তাদের মতে সত্তাগতভাবে মহা দলিল, যা হেদায়েতের পথে আহ্বানকারী। এর জন্য বাইরের এমন কোন দলিল-প্রমাণের প্রয়োজন নেই, যার মাধ্যমে বোঝা যাবে, এ গ্রন্থ মূলগতভাবে বিশুদ্ধ রয়েছে। মনে হয় যেন, এ গ্রন্থ সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক স্বাক্ষরিত। তারা তাদের কথার পক্ষে আরও যা কিছু বলে থাকে তা হল, কুরআনে বর্ণিত এমন বিরাট বিরাট ঘটনা, যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, বড় বড় জাতি-গোষ্ঠী সেসব ঘটনায় ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছে।
    সংক্ষিপ্ত আকারে বললে, কুরআন তাদের দৃষ্টিতে এমনই যেমনটা সাইয়েদ মুহাম্মদ রশিদ রেদা বলেছেন: কুরআন তার অক্ষর ও শব্দাবলী তথা বাহ্যিক রূপ, তার ভাষা শৈলী ও শব্দ বাক্য বিন্যাস, তাতে বিবৃত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও হেদায়েতের আলোক রশ্মিএসব কিছুর কারণে সৃষ্টিকুলের সম্মুখে এক অলৌকিকতা। এই কুরআন তার মধ্য দ্বিতীয়টি সৃজন করার ক্ষেত্রে সৃষ্টিকূলকে অক্ষম প্রমাণিত করেছে। এ কারণেই এ গ্রন্থ সকল নিদর্শনের মূল; অন্য কোন নিদর্শন তার মতো নয়, এ গ্রন্থ সকল আলোর উৎস; অন্য কোন আলো এর মত নয়। (পৃষ্ঠা: ৫৯)
    কিন্তু সেই অলৌকিক ঘটনার মূল্য কী এবং এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার বাস্তবতা কী? ফরাসি "ইন দ্য ল্যান্ড অফ ইসলাম" ম্যাগাজিনের সম্পাদক ফাদার ডি ল্যানভারস বলেছেন: (আজ কেউ কুরআনের সাহিত্যিক মূল্য নিয়ে বিতর্ক করে না, ঠিক যেমন কেউ তাওরাতের ইংরেজি অনুবাদ বা এর লেখক লুথারের জার্মান অনুবাদের ভাষাগত মূল্য নিয়ে সন্দেহ করে না। অথচ তাওরাত গ্রন্থের ভাষাগত এই উৎকর্ষ সম্পূর্ণ মানবিক। প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে সাহিত্যিক এমন ঐশী সৃষ্টিকে ভাষা জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ অথবা গ্রন্থ অবতরণের প্রেক্ষাপট, সময়কাল ও অঞ্চলের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে ভিন্নভাবে বিচার-বিবেচনা ও যাচাই করা সম্ভব। কিন্তু সাহিত্যিক উৎকৃষ্টতার মান এমন কোন বিষয় নয়, যা ধর্মীয় গ্রন্থের মূল বক্তব্যের গুরুত্ব ও মান হ্রাস বা বৃদ্ধি করে। (আমরা কুরআনের বক্তব্যের ধর্মীয় মান ও গুরুত্ব অস্বীকার করছি না। আল্লাহর ইচ্ছার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়া, সালাতের মাধ্যমে আনুগত্য প্রকাশ করা এবং সম্পূর্ণরূপে নিজেকে সঁপে দেয়ার অনুভূতি জাগরণে কুরআনের প্রভাবের ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ সজাগ ও সচেতন। ওদিকে অধিকাংশ সুফিবাদি সত্যনিষ্ঠ লোকেরা কোরআনিক উৎস থেকে যুগ যুগ ধরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি নিখাদ ভালোবাসার অমীয় সুধা পান করে এসেছেন।
    (কিন্তু আমাদের মূল আলোচ্য বস্তু এটা নয় যে, কুরআন অন্তরসমূহে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে কিনা? আমাদের মূল প্রশ্ন হল, কুরআন সত্তাগতভাবে দলিল কিনা? মূলগতভাবেই কি এ গ্রন্থ সকল নিদর্শন ও অলৌকিকতার সর্বোচ্চ স্তর যেমনটা সাইয়েদ মুহাম্মদ রেদা দাবি করছেন? (পৃষ্ঠা নং ৫৯) এবং সৈয়দ সাহেবের আগেও বড় মাপের মুসলিম আইম্মায়ে কেরামের অনেকেই দাবি করেছেন? কুরআনটাই কি মূলত ওহীর ভাষ্য? এটাই কি ঐশী ভাষ্য? আমরা ওহী বলতে কাব্যিক ওহী বা ভাষা অলংকার হিসেবে ওহীর কথা বোঝাচ্ছি না; যেমনটা ভাষা অলঙ্কারবিদ ও কবিরা মহান কিছুকে ঐশী বলে থাকেন (যেমনটা লেখক উল্লেখ করেছেন ২৯ নং পৃষ্ঠায়); বরং ওহীর ভাষ্য বা ঐশী ভাষ্য বলে আমরা বোঝাতে চাচ্ছি, ধর্মবিদদের ভাষায় পূর্ণ অর্থের সেই ওহী ও ঐশী ভাষ্য, যা দ্বারা আল্লাহর সরাসরি অমর বাণী বোঝানো হয়ে থাকে?
    (এটা বলা আমাদের জন্য দুষ্কর, আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি ওহী হিসেবে অবতীর্ণ কোন গ্রন্থ বাইরের (খারেজি) কোন দলিল-প্রমাণ ব্যতিরেকে তা মূলগতভাবে ঐশী ও ঐশ্বরিক হবার কথা জানান দেবে। এটা অসম্ভব, কোন গ্রন্থ নিজেই নিজের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে আর সেই সাক্ষের ভিত্তিতে সে গ্রন্থে আল্লাহর নিদর্শন ও স্বাক্ষর প্রমাণিত হয়ে যাবে। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন বিষয় যেটা তা হলো, ঐশী সে নিদর্শন প্রমাণিত হয়ে যাবে আর আমরা কোন প্রকার বিভ্রান্তির ভয় করব না এবং আমাদের যাচাই-বাছাইয়ে কোন ভুল-ভ্রান্তি ঘটে যাবার আশঙ্কা করব না। ভেতরগত (বাতেনি) দলিলের সমস্যাটাই তো হল একমাত্র সমস্যা। তাফসীরবিদদের নিকট এ দলিলটাই প্রসিদ্ধ। কারণ ওহী বিশুদ্ধ হবার পক্ষে ভেতরগত দলিলের মূল্য নিয়ে তো কোন তর্ক নেই। তর্ক হল সেই নিদর্শন ও ভেতরগত দলিলের এমন বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে, যা সংশয়ের কোনো অবকাশ রাখবে না। এ কারণেই মুফাসসিরীন এ বিষয়ে একমত, খারিজি দলিল বাতেনি দলিল অপেক্ষা অধিক প্রভাব সৃষ্টিকারী। কারণ, খারিজি দলিলে বাতেনি দলিলের চেয়ে ত্রুটির আশঙ্কা কম এবং তা কোন বিষয় সঠিক হবার ব্যাপারে জোর আরোপের ক্ষেত্রে অধিক নিরাপদ।)
    (তাই বাস্তব প্রেক্ষাপটে বাতেনি দলিলের মূল্য কেবলই নেতিবাচক অর্থাৎ বাতেনী দলিল কোন রচনা ও গ্রন্থের ব্যাপারে এই সম্ভাবনা নাকচ করে যে, সে গ্রন্থ ও রচনা গোটা আক্ষরিক বিন্যাস সহকারে কোন মানব মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত হয়েছে।)
    (আল-মানার): উপরোক্ত বক্তব্যে কিছু সংশয় রয়েছে আমরা সংক্ষিপ্ত আকারে ইঙ্গিতে সেগুলো খণ্ডন করবো

    ***
    প্রথম সংশয়:
    সাহিত্য ও ভাষা অলংকারের ক্ষেত্রে কুরআনকে তাওরাত ইঞ্জিলের সঙ্গে তুলনা করা।
    তিনি তাদের কোন এক পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, “বর্তমানে এমন কেউ নেই যে কুরআনের ভাষাগত মূল্য নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হবেঅথচ তিনি দাবি করছেন, তাওরাতের ইংরেজি ও জার্মান অনুবাদ কুরআনের সাহিত্যমানের সঙ্গে তুলনীয়। আমরা দু'ভাবে এর জবাব দেব:
    প্রথমতঃ কুরআন আপন ভাষাগত বর্ণনা ভঙ্গির দ্বারা মানব সম্প্রদায়কে অক্ষম প্রমাণিত করেছে। কুরআন ফাসাহাত বালাগাত তথা উচ্চমানের আরবি সাহিত্য ও ভাষা অলংকার শাস্ত্রবিদ আরবের প্রসিদ্ধ জাঁদরেল পণ্ডিতদেরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে, তার কোন একটি সূরার মত অপর কোন সূরা তারা রচনা করে দেখাক। এদিকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত লাভের পূর্বে সাহিত্যিক অঙ্গনে এমন উচ্চ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আল্লাহ সেই শ্রেণীকে এই চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, তারা একটি সূরা রচনা করুক, আবার সুস্পষ্টভাবে এ কথাও বলে দিয়েছেন, তারা কখনোই সেটা পারবে না। অথচ এই শ্রেণীটিই নবীজিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য সবচেয়ে বেশি মুখিয়ে ছিল। তারা যদি আসলেই সক্ষম হতো, তাহলে অবশ্যই রচনা করে দেখাত। আজ পর্যন্ত মানবজাতিকে অক্ষম প্রমাণকারী কুরআনের সেই চ্যালেঞ্জ বাকি রয়েছে। ইংরেজ বা জার্মান কোন লেখক সাহিত্যিক একথা বলেননি, তাওরাতের অনুবাদ কর্ম এক অলৌকিক বিষয়। এই সৃষ্টি মানব জাতিকে অক্ষম প্রমাণ করে দিয়েছে। কোন মানুষের পক্ষে এমন সৃজনশীলতা দেখানো সম্ভব নয়। অতএব, তাওরাত গসপেলের সঙ্গে কুরআনের পার্থক্য ঝলমলে রোদের মতো কিংবা তার চেয়েও পরিষ্কারভাবে আমাদের সামনে ধরা দিয়েছে।
    দ্বিতীয়তঃ কেন তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনীত কুরআনের সঙ্গে মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যেই তাওরাত এনেছেন সেটার তুলনা করছে না অথচ তাদের ধর্মের মূল ভিত্তিই হলো ওই গ্রন্থ? কোথায় তাহলে আসল তাওরাত? কোথায় সেই ইঞ্জিল গ্রন্থ, যা ঈসা মাসীহ আলাইহিস সালাম নিয়ে এসেছেন? খ্রিস্টানরা নিউ টেস্টামেন্টের বইগুলোতে উল্লেখ করে, যীশু তার ছাত্রদেরকে সারা বিশ্বে এই গ্রন্থ প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই মূল গ্রন্থের সাহিত্যিক মানের সঙ্গে কেন তারা কুরআনের সাহিত্যিক মানকে তুলনা করে না? এটা এ কারণেই, কুরআন হলো ওই গ্রন্থ যা খাতামুন্নাবিইয়ীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছেন। অতঃপর এই গ্রন্থের দ্বারা দ্বীনে মোহাম্মদী অকাট্টভাবে জানা গিয়েছে। কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপর দুই ভাই হযরত মুসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাতু ওয়াসসালাম যে গ্রন্থদ্বয় নিয়ে এসেছেন, সেগুলো আক্ষরিক বিন্যাস সহকারে বিদ্যমান নেই। আর সেগুলোর যত অনুবাদ বিদ্যমান রয়েছে, কোনটাই মূল গ্রন্থ থেকে চয়নকৃত বলে প্রমাণিত নয়। কারণ মূল গ্রন্থ পৃথিবীতেই নেই। এ কারণেই অনুবাদগুলো এতটা স্ববিরোধী পরস্পর বিরোধী হয়ে থাকে। তাহলে কিভাবে এ কথা বিশ্বাস করা যায়, মূল গ্রন্থ বিদ্যমান থাকলে অনূদিত সংস্কারগুলো মূলানুগ দেখা যেত?
    ***

    দ্বিতীয় সংশয়:
    কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়ার বিষয়ে এর ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা ও হেদায়েতকে দলিল মনে করা
    অর্থাৎ এমন মনে করা, কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে তার প্রমাণ হলো কুরআনের হেদায়েত ও অন্তঃকরণে প্রভাবক চরিত্র।
    তিনি একথাও স্বীকার করেছেন, তারা কুরআনের ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা অস্বীকার করেন না। যেমন আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার সামনে সকল কিছু সঁপে দেয়া, একনিষ্ঠভাবে তার ইবাদত ও অর্চনা করা ইত্যাদি। কিন্তু তারা অস্বীকার করে, কুরআনের এই প্রভাব সৃষ্টিকারী চরিত্রটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ গ্রন্থ অবতীর্ণ হওয়া এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার দলিল। আমরা তিনভাবে এ কথার জবাব দেব:
    প্রথমতঃ কুরআন যে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়ে এসেছে, সে বিষয়ের পক্ষে আমরা শুধু এটাকেই দলিল মনে করি না যে, কুরআন মানুষের জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং মানব হৃদয়ে হেদায়েতের বারিধারা বর্ষণকারী এক মহাগ্রন্থএমনিভাবে ভাষাগত অলংকার ও উচ্চস্তরের সাহিত্য মানসম্পন্ন হওয়াটাও আমরা একমাত্র দলিল মনে করি না। বরং আমরা الوحي المحمديগ্রন্থে এবং আরো বিভিন্ন জায়গায় কুরআনের আয়াতের তাফসীরে যৌক্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈজ্ঞানিক আরো বহু দলিল-প্রমাণ হাজির করেছি। তন্মধ্যে আমি মনে করি শুধু এটাই যথেষ্ট যে, ইউরোপের বিজ্ঞ মহল বর্তমান যুগে এসেও এ বিষয়ে একমত, কোন মানুষের পক্ষে এতটা উচ্চস্তরের ভাষাগত ফাসাহাত বালাগাত সহকারে এমন গ্রন্থ প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। শুধু তাই নয় বরং সে ব্যক্তি যদি শৈশবকালে বা যৌবন বয়সে এ ধরনের কোন সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত না থাকেন এবং অনুশীলন না করেন, আর এমতাবস্থায় তার চল্লিশ বছর পার হয়ে যায়, তবে তো এমন ব্যক্তির পক্ষে আরও সম্ভব নয়। এমনিভাবে চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হবার পর ধর্মীয়, শিল্প সাহিত্য, নাগরিক আইন অথবা রাজনৈতিক বিষয়ে স্বতন্ত্র এমন অনন্য গ্রন্থ প্রণয়ন করা এমন মানুষের সাধ্যে নেই, যিনি ইতিপূর্বে কারো সাহচর্যে অথবা শিক্ষা লাভ ও গবেষণার মাধ্যমে এ সকল শাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত নন অথবা এসব বিষয়ে অনুশীলন নেই। আর অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক ধারা পরম্পরাগতভাবে প্রমাণিত, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক উম্মী সম্প্রদায়ের মাঝে উম্মী (নিরক্ষর) হয়ে বেড়ে উঠেছেন। উপরোক্ত কোন বিষয়েই তার অনুশীলন ছিল না পূর্বে থেকে। আর এই বিষয়টা দিয়ে তিনি নিজেও তার সময়কার লোকদের বিপক্ষে দলিল দাঁড় করিয়েছেন, যেমনটা আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন নিম্নোক্ত আয়াতে
    قُلْ لَّوْ شَآءَ اللّٰهُ مَا تَلَوْتُهٗ عَلَيْكُمْ وَلَاۤ اَدْرٰٮكُمْ بِهٖۖفَقَدْ لَبِثْتُ فِيْكُمْ عُمُرًا مِّنْ قَبْلِهٖۗاَفَلَا تَعْقِلُوْنَ
    "বল, ‘‘আল্লাহর ইচ্ছে হলে আমি তোমাদের কাছে তা তিলাওয়াত করতাম না, আর আল্লাহও তোমাদেরকে তার খবর দিতেন না। আমি তো এর পূর্বে একটা দীর্ঘ সময় তোমাদের মাঝে অতিবাহিত করেছি, তা সত্ত্বেও তোমরা কি বুঝবে না?" (সূরা ইউনুস: ১৬)
    যে গ্রন্থের ভাষাগত ও সাহিত্যিক উচ্চস্তর, ধর্মীয় গুরুত্ব ও মূল্যমান, বিশ্বজুড়ে তার সুফল বিস্তার ইত্যাদির ব্যাপারে বর্তমান সময়ে তার চরম শত্রু, ঘোর বিরোধী ও প্রতিপক্ষও স্বীকৃতি দেয়, সে গ্রন্থ যখন আমাদের আলোচ্য বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক প্রমাণের মাধ্যমে মুহাম্মদের রচনা হওয়া অসম্ভব প্রমাণিত হলো, তবে কি সে গ্রন্থ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ওহীকৃত হওয়া ছাড়া অন্য কোন কিছু হওয়া সম্ভব? ওহীকৃত গ্রন্থসমূহের মাঝে যেগুলোর ব্যাপারে তাদের ঈমান রয়েছে, সেগুলোর ভেতর থেকে কোন গ্রন্থ কি রয়েছে যেটি এই প্রমাণের ভিত্তিতে কুরআনের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে?
    দ্বিতীয়তঃ লক্ষ লক্ষ মানুষকে আল্লাহ তায়ালার পরিচয়, একনিষ্ঠভাবে তাঁর এবাদত, মূর্তিপূজা, বৃক্ষ, নক্ষত্র, প্রাণী, মানব বিভিন্ন কিছুর উপাসনা পরিত্যাগ করিয়ে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কুরআনের যে ভূমিকা ও প্রভাব রয়েছে, এটাই তো অন্যতম সর্ববৃহৎ দলিল যে, এ গ্রন্থ আল্লাহর ওহীকৃত এবং তাঁর বাণী। এই উদ্দেশ্য ছাড়া আর কেনই বা আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলদেরকে প্রেরণ করবেন এবং কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করবেন?
    এভাবে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আল্লাহর অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবসমূহের কোনোটির কি এর চেয়ে বেশি কিংবা এর বরাবর প্রভাব রয়েছে? الوحي المحمديগ্রন্থে আমরা এমন প্রশ্নের বিস্তারিত নাবাচক জবাব উল্লেখ করেছি।
    যাহা দেখিবো না তাহা মানিবো নামতবাদের বস্তুবাদীরা অথবা ওহী ও নবুওয়াত গোড়া থেকেই অস্বীকারকারীরা ওহী প্রমাণের এই নিদর্শন অস্বীকার করতে পারে কারণ, এই নিদর্শন মূল বিষয়ের প্রতি ঈমান আনার শাখা স্বরূপ। আর মূল বিষয় হলো আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব এবং রাসূলদের রিসালাত। কিন্তু তাই বলে যারা এই মূল বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, তারা কেমন করে ওহী প্রমাণের নিদর্শনকে অস্বীকার করতে পারে? জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষার অধ্যাপক মিউসিও মন্টেট এ বিষয়টাতে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলেছেন: এ কথা বোঝে আসে না যে, একজন মানুষ কেমন করে বনী ইসরাঈলের নবীদের নবুওয়াত স্বীকার করে অথচ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত অস্বীকার করে!!
    এ বিষয়ে বিস্তারিত আমরা 'খুলাসাতু আস সীরাহ আল মুহাম্মাদিইয়াহ' 'আল ওহী' গ্রন্থে আলোচনা করেছি। অর্থাৎ এক ব্যক্তি যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোন গ্রন্থ আমাদের কাছে নিয়ে আসে, আর আমরাও যাচাই করে দেখতে পাই, অসুস্থ লোকেরা যারাই এ গ্রন্থের নিয়মকানুন মেনে চলেছে, তারা আরোগ্য লাভ করেছে, তবে কি এ বিষয়টা সে গ্রন্থে থাকা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সত্যতা ও বিশুদ্ধতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বহন করবে না? কেন নয়?!
    আর নিশ্চয়ই সে গ্রন্থের বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য কারো এই সাক্ষ্যের প্রয়োজন নেই যে এটি চিকিৎসা বিষয়ক একটি উপকারী গ্রন্থ। কারণ, শুধুমাত্র মৌখিক অনেক সাক্ষ্যের চেয়ে কার্যকারিতার অকাট্য সাক্ষ্য বেশি শক্তিশালী। কার্যকারিতার সাক্ষ্য সকলেই বুঝতে পারে।
    তাই প্রথম যুগে অধিকাংশ অনারবের ইসলাম গ্রহণের বড় কারণ ছিল সেটাই, যা তারা প্রত্যক্ষ করেছিল। তারা লক্ষ্য করেছে, নবীজির আবির্ভাবের আগে অজ্ঞ মুশরিক আরবদের অবস্থা কতটা শোচনীয় ছিল, আর নবীজির আগমনের পর তাঁর হেদায়েত ও সুন্নাহর মাধ্যমে আরবদের মাঝে কিরূপ বিপ্লব ঘটে গেছে?! এভাবেই তারা সত্যের অভিযাত্রীদেরকে চিনে গেছে, যারা সত্যের আলো প্রচার করে এবং সে মতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। তখন অনেক ইহুদি, রোমান এবং বেশিরভাগ খ্রিস্টান, যার মধ্যে সিরিয়ান, ক্যালডীয়, অ্যাসিরিয়ান, আর্মেনিয়ান, কপ্টস এবং বারবার জাতি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সকলেই খ্রিস্টধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। একই কথা প্রযোজ্য অগ্নিপূজক ও ভারতীয়দের ক্ষেত্রে, যারা নিজেদের সভ্যতা ও দর্শনে রোমানদের সঙ্গী ছিল।
    এবার আসি আরবদের কথায়। তাদের ঈমান আনয়নের কারণ ছিল, কুরআনের ভাষাগত ও বৈজ্ঞানিক অলৌকিকতা, মন-মননে ও হৃদয়ে-অন্তরে কুরআনের আয়াতসমূহের অপার্থিব প্রভাব ও কর্তৃত্ব এবং এই আশ্বস্ততা ও বিশ্বাস যে, এ গ্রন্থ তাদের জন্য কল্যাণের ঘোষণাপত্র ও সত্য বিধৃত এক মহা প্রণয়নসে সঙ্গে যিনি এ গ্রন্থ নিয়ে এসেছেন, তার সামগ্রিক অবস্থা ও পূর্ব জীবনের কথা তো তাদের সামনেই ছিল। সে ব্যক্তি চল্লিশ বছর পর্যন্ত ভাষা সাহিত্য, বালাগাত, ফাসাহাত ও অক্ষর জ্ঞানের ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই অপরিচিত। এই অঙ্গনে নিজ পরিবেশ ও মাতৃভূমিতে তাঁর কোন বৈশিষ্ট্য ও কৃতিত্ব ছিল না। কিন্তু সততা বিশ্বস্ততা ও নৈতিক উৎকর্ষে তিনি ছিলেন অনন্য।
    আল-মাশরিক ম্যাগাজিনের সমালোচক এতসব বিষয়কে বাতিনি দলিল প্রমাণ বলে ধরে নিচ্ছেন, যেগুলোর কেবল নেতিবাচক মূল্য রয়েছে। অর্থাৎ এ বিষয়গুলো শুধু এই প্রমাণ বহন করে যে, এ গ্রন্থ কোন মানব মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত হতে পারে না। অথচ সমালোচকের কোন খবরই নেই, আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর ওহীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তি এমন বিষয়কে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মেনে নিতে বাধ্য মন থেকেই। যেহেতু কুরআন ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থের ব্যাপারে এসব বিষয় পাওয়া যায় না তাই সহজেই কুরআনের পক্ষে দলিল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

    অতঃপর শাইখ পরবর্তী প্রবন্ধে সমালোচনার জবাব প্রদানের ধারা অব্যাহত রেখে লিখেছেন:

    (চতুর্থখণ্ডে থাকা পূর্বাংশের পর থেকে)

    খ্রিস্টান ঐতিহ্যের তৃতীয় দিকটি হল, গসপেলের অনুসারী দাবিদাররা ঈসা আলাইহিস সালাম হতে বর্ণনা করেছে, তিনি তাঁর পরে মিথ্যা নবীদের উৎপাত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং সত্যবাদী এবং মিথ্যাবাদীদের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য একটি সাধারণ নিয়ম শিখিয়ে গিয়েছিলেন। নিয়মটা হলো তার এই উক্তি: "তাদের কর্মফল দ্বারাই তোমরা তাদের চিনতে পারবে।" তাই আল-মাশরিক ম্যাগাজিনের লেখক এবং হর্তাকর্তারা আমাদেরকে এমন একজন নবীর কথা বলুক, যার এটুকু বৈশিষ্ট্য হলেও চলবে যে, যে কল্যাণ ও পুণ্যের স্বীকৃতি তারা পরোক্ষভাবে হলেও দিয়ে দিয়েছে, সে রকম কল্যাণের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেহনতের মাধ্যমে লক্ষ-কোটি মানুষের হেদায়েত প্রাপ্ত হবার সমুদ্র তুল্য প্রভাবের ছিটেফোঁটা কোন নবীর রয়েছে।
    এই সাধারণ নিয়মের সমর্থনে রয়েছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের প্রমাণ বহনকারী খারিজি অনেক বিষয়। তন্মধ্যে রয়েছে নবীজির ব্যাপারে ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্টের বইসমূহের সেসব সাক্ষ্য বাণী, যেগুলো আমরা আল-মানারের বিশ্লেষণমূলক আলোচনায় বিস্তারিত তুলে এনেছি। এছাড়া অন্যান্য ব্যক্তিরা আরো বিশদভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন যেমন- শাইখ রহমাতুল্লাহ আল-হিন্দি তাঁর রচিত ইজহারুল হক গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। এমনিভাবে খারিজি দলীলসমূহের মধ্যে রয়েছে ইহুদী-খ্রিস্টানদের যেসব আলেম নবীজির প্রতি ঈমান এনেছিলেন তাদের সাক্ষ্য বাণী। এছাড়াও আরও অনেক প্রমাণ রয়েছে, যেগুলো এখানে আলোচনার সুযোগ নেই।
    এরপর আমরা তাদেরকে বলব: আজ যে সমস্ত পুস্তক পুস্তিকাকে আপনারা গসপেল নাম দিচ্ছেন, সেগুলো ওহীকৃত (ঐশীভাবে অবতীর্ণ) বা এলহামকৃত হবার ব্যাপারে আপনাদের কাছে কোন খারিজি দলিল প্রমাণ নেই। আমরা তো আপনাদের বইগুলোতে দেখেছি, আপনারা এমন ভেতরগত দলিল দিয়ে আপনাদের দাবি সত্য প্রমাণ করতে চান, যেগুলো দলিল হিসেবে টিকবে না। আপনারা বলেন: ' যদি এগুলো সত্য ও সঠিক না হয়, তাহলে এগুলোর লেখকরা অনাচারকারী মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হবে'এটা যুক্তির কথা নয়। আপনাদের প্রতিপক্ষ আপনাদের এমন বক্তব্য মেনে নেবে না। কারণ, এটাও তো বলা সম্ভব, 'অবশ্যই এটার সুযোগ রয়েছে যে, লেখকরা ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা লেখেননি অথবা সত্যানুসন্ধান করেননি।' 'আবার এটাও ঘটবার সুযোগ রয়েছে, কনস্টানটিনের বাহিনী বা অন্য কেউ তাদের বইগুলোতে নিজেদের থেকে কিছু প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে'কারণ, আপনাদের কাছে তো তাদের পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন কোন মুতাওয়াতির তথা ধারাপরম্পরাগত সূত্র নেই। এ নিয়ে আমরা সামনে আলোচনা করব। তবু যদি ধরে নেয়া হয়, এ দলিল সত্য, তাহলে তো সেটা আপনাদের চেয়ে আমাদের পক্ষেই বেশি খাটে। যদিও আপনাদের মত আমাদের এমন দলিলের প্রয়োজন নেই। কারণ, আমাদের কাছে এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী ও বিশুদ্ধ দলিল রয়েছে।

    ***

    তৃতীয় সংশয়:

    কুরআন ঐশীভাবে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে খারিজি সাক্ষ্য

    আমরা الوحي المحمدي গ্রন্থে কুরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী হওয়ার ব্যাপারে বাতিনী দলিল প্রমাণ ও সাক্ষ্য সমূহই কেবল উপস্থাপন করিনি, যেমনটা দাবি করেছেন আল-মাশরিক ম্যাগাজিনের অভিযোগকারী। বরং আমরা অনেক খারিজি সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উল্লেখ করেছি প্রথম সংস্করণে। কিন্তু যখন আমি ক্যাথলিক জেসুইট এ ধরনের সংশয়গুলো দেখতে পেলাম, তখন দ্বিতীয় সংস্করণে প্রথম সংস্করণের চেয়ে বেশি এগুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যুক্ত করেছি। সে আলোচনাগুলো আমি এনেছি প্রথম পরিচ্ছেদে, যা শেষের সংস্করণে পরিবর্ধন করা হয়েছিল। তন্মধ্যে একটি বিষয় হলো, খ্রিস্টানরা ঈসা আলাইহিস সালাম সূত্রে তার নিজের সম্পর্কে যে সাক্ষ্যবাণী বর্ণনা করে থাকে এবং অন্যান্যদের মাধ্যমে ঈসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে যে সাক্ষ্য বর্ণনা করে থাকে, সেটার ব্যাপারে আমি আপত্তি এনেছি। ঈসা আলাইহিসসালাম থেকে যোহন বর্ণনা করেছেন, তিনি ইরশাদ করেছেন: ৫:৩১
    যদি আমি নিজের পক্ষে সাক্ষ্য দিই, তবে আমার সাক্ষ্য সত্য নয়৷ ৩২ যে আমার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে, সে অন্যজন, আর আমি জানি যে, সে আমার বিষয়ে যে সাক্ষ্য দেয়, তা সত্য৷ ৩৩ তোমরা যোহনের কাছে পত্র পাঠিয়েছিলে, তখন সে সত্যের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছিল।"
    অতঃপর তার হতে বর্ণনা করে: "৮:১৩ তখন ফরীশীরা তাকে বলল: আপনি নিজের পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং আপনার সাক্ষ্য সত্য নয়।১৪ যীশু তাদের উত্তর দিয়ে বললেন, “আমি যদি নিজের পক্ষে সাক্ষ্য দিই, তবে আমার সাক্ষ্য সত্য।" মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার সাক্ষ্যদান প্রসঙ্গে আমি উপরোক্ত বিষয়গুলো উল্লেখ করেছিলাম।
    لٰـكِنِ اللّٰهُ يَشْهَدُ بِمَاۤ اَنْزَلَ اِلَيْكَ اَنْزَلَهٗ بِعِلْمِهٖۚوَا لْمَلٰٓئِكَةُ يَشْهَدُوْنَۗوَكَفٰى بِا للّٰهِ شَهِيْدًا
    "কিন্তু আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, যা তিনি নাযিল করেছেন তা তাঁর জ্ঞানের ভিত্তিতেই নাযিল করেছেন। ফেরেশতারাও সে সাক্ষ্য দিচ্ছে আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট।" (সূরা আন নিসা: ১৬৬)
    নবীজির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার সাক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত হলো সেসব মুজেজাসমূহ, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি তার নবীকে শক্তিশালী করেছেন এবং কুরআন ও এতদ্সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া আরো যেসব মুজেজা তিনি প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ। যেমন- তাঁর অনুসারীরা কেসরা কায়সারের রাজত্ব দখল করার ব্যাপারে যখন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তখন সাহাবীরা সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা ও দারিদ্র্যের অবস্থা পার করছিলেন, সময়টা ছিল খন্দক যুদ্ধের। সে সময় মুশরিক গোত্রগুলো ইহুদিদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে মদিনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদেরকে মূলোচ্ছেদ করে দেয়া। তখন আল্লাহ তায়ালা এমন বায়ুপ্রবাহ ও ফেরেশতাদের বাহিনী দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করেছিলেন, যা কাফেররা দেখতে পায়নি। তাদের অন্তরে তিনি ভীতি সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। কোনো সাফল্য ছাড়াই নিজেদের ক্রোধ নিয়ে আল্লাহ তাদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিলেন। وكفى الله المؤمنين القتالঅর্থ: আল্লাহ লড়াইয়ে মুমিনদের জন্য যথেষ্ট (সূরা আল আহযাব: ২৫) সূরাতুল আহযাবের শুরুতে বিস্তারিত এ আলোচনা রয়েছে।
    ***

    কুরআনের ব্যাপারে খ্রিস্টানদের মিথ্যাচার

    আল-মাশরিক ম্যাগাজিনের লেখক ঐ সমস্ত জীর্ণশীর্ণ সংশয় তুলে ধরার পর লিখেছেন: কোন একটা গ্রন্থে এত ধরনের দোষ-ত্রুটি থাকার পর সেই সঙ্গে তাতে সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও অলংকারপূর্ণ বর্ণনাভঙ্গি থাকার দরুন আমরা বলতে বাধ্য হই, এমন গ্রন্থকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত করা সম্ভব নয়।
    এ বক্তব্য দেয়ার পর তিনি তাদের কাছে থাকা কুরআনের ব্যাপারে মিথ্যাচারপূর্ণ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের দাবীকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। সে বই থেকে যে সংক্ষিপ্তসার তিনি তুলে ধরেছেন, সেটাকে আমরা সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে উল্লেখ করব এরপর জবাব দিব এবং সেসব বক্তব্যের অসারতা তুলে ধরব। বিস্তারিতভাবে আমাদের এই জবাবমূলক আলোচনা ‘শুবুহাতুন নাসারা ওয়া হুজাজুল ইসলাম’ নামক গ্রন্থে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। الوحي المحمدي গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে আমি আবারও এ প্রসঙ্গে আলোচনা করব, যেমনটা প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।

    কুরআনের কিছু অংশ হারিয়ে গেছে বলে তাদের দাবির অপনোদন

    প্রথম মিথ্যাচার: ওই মিথ্যাচারকারী দাবি করেছে, কুরআনের কিছু অংশ হারিয়ে গেছে। পুরো কুরআন লিপিবদ্ধ করা যায়নি। যে অংশ হারিয়ে গেছে তা হলো- নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বিষয়গুলো ভুলে গিয়েছিলেন এমনিভাবে ভুলে গিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইন। এভাবেই আর সেই অংশ সংরক্ষণ করা যায়নি। তার বক্তব্য: কুরআনের অনেক আয়াত শুধুমাত্র সাহাবীদের স্মরণেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে সেখান থেকে অনেকটা হারিয়ে গেছে।
    তার এমন বক্তব্যের জবাবে আমরা বলব: এটা এমন মিথ্যাচারপূর্ণ দাবি, যার পক্ষে ন্যূনতম কোন প্রমাণ নেই। কারণ, ধারা পরম্পরাগত সূত্রে আমরা জেনে এসেছি, যখনই কুরআন অবতীর্ণ হতো, অনেক সাহাবী সেগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। সেগুলোর দ্বারা তারা সালাতে ও অন্যান্য মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতেন। স্মরণ শক্তির ব্যাপারে আরবরা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। কাব্য কবিতা, বংশ সূত্র ও ঘটনা প্রবাহ স্মরণ রাখার ব্যাপারে তারা নিজেদের সেই প্রতিভার উপর আস্থাশীল ছিল। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, খ্রিস্টানরা কুরআনের ব্যাপারে এই অপবাদ দিচ্ছে, অথচ এটি এমন গ্রন্থ, যা অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালেই হাজার হাজার আরব তা মুখস্ত করেছে, বিক্ষিপ্তভাবে তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। অতঃপর সেগুলো একত্রিত করা হয়েছে। এরপর প্রতি যুগে লক্ষ কোটি মানুষ তা মুখস্ত করে নিচ্ছে। এদিকে খ্রিস্টানরা তাদের যীশুর গসপেল থেকে তার ভাষ্য ও শব্দ সহকারে কিছুই লিপিবদ্ধ করেনি। যে চারটি পুস্তককে এই শেষ সময়ে তারা ইনজীল বা গসপেল নাম দিচ্ছে, এগুলো প্রথম যুগে যাদেরকে তারা রাসূল বা প্রেরিত বলতো, তাদের জানা ছিল না। কারণ, তাদের কেউই নিজেদের পুস্তকে সেরকম কোন কিছুই উল্লেখ করেননি। এই যেমন চতুর্থ যোহন তার গসপেলের শেষে বলেছেন: ২১:২৪ এই সেই শিষ্য যিনি এটির সাক্ষ্য দিয়েছেন, এটি লিখেছেন এবং আমরা জানি যে তার সাক্ষ্য সত্য। ২৫ এবং আরও অনেক কিছু যা যীশু তৈরি করেছেন। যদি এক এক করে সেগুলো লেখা হতো, তবে আমার মনে হয় না, একই আলেমের পক্ষে লিখিত সকল পুস্তক পরিব্যপ্ত করা সম্ভব হতো।তাহলে কথা হচ্ছে, তিনি অথবা তার কোনো শিষ্য কেন সেগুলোর এক-দশমাংশও লিখলেন না?!
    এমনিভাবে খ্রিস্টানদের কাছে তাদের উভয়ের সময়কার বাইবেলের কোনটারই কোন লিখিত ভিত্তি নেই। যারা সেগুলো নিয়ে এসেছেন তাদের ভাষ্য সহকারে তাদেরই সময়কালে কোনটাই লিপিবদ্ধ হয়নি। আর না তারা কিংবা ইহুদিরা কেউ একথা দাবি করে যে, মূল ভাষ্য ও অক্ষর বিন্যাস সহকারে মূসা আলাইহিস সালাম এবং তাদের অন্যান্য নবীরা যেগুলো নিয়ে এসেছেন, সেগুলোর কোনোটা তারা সংরক্ষণ করেছে মুসলমানদের মতো করে।

    কুরআনে স্ববিরোধিতার উপস্থিতি সম্পর্কিত তাদের দাবির খণ্ডন

    দ্বিতীয় মিথ্যাচার: তারা কুরআনে স্ববিরোধিতা ও দুর্বল বর্ণনার উপস্থিতি রয়েছে বলে দাবি করেছে। বিভিন্ন মুতাশাবিহাত তথা দ্ব্যর্থবোধক আয়াত যেগুলো তাবিল বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ, সেগুলো নিয়ে এবং নাসেখ মানসুখ আয়াত দেখিয়ে তারা এ দাবি করেছে। মুতাশাবিহাতের ব্যাপারে কথা হল, মুফাসসিরীন সেগুলোর ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে নানা রকম বলেছেন। সূরা আলে ইমরানের তাফসীরে অতঃপর সূরা ইউনুসে শেষদিকে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কুরআনের এমন আয়াতগুলোর মাঝে কোন স্ববিরোধিতা বা বর্ণনাগত দুর্বলতা নেই। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক স্বভাবজাত ভিন্নতার কারণে কিছু বিষয়ের মাসআলা-মাসায়েল বুঝতে গিয়ে বিষয়বস্তুর মূল চরিত্র একভাবে ধরতে পারে না। বিশেষ করে ওহী বা ঐশী বর্ণনা এবং গায়েবি জগত সম্পর্কে নবীদের বক্তব্যের ক্ষেত্রে বিষয়টা বেশি হয়ে থাকে।
    আমরা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি, মুতাশাবিহাত বা দ্ব্যর্থবোধক আয়াতসমূহের অর্থ গভীর জ্ঞানের অধিকারীরা জানেন। কিন্তু সেগুলোর তাবিল বা ব্যাখ্যা যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না, সেগুলো আল্লাহ তায়ালার সিফাত ও গুণাবলীর হাকিকত, মূল প্রকৃতি এবং পরজগতে বিভিন্ন সুসংবাদ ও হুমকি-ধমকি ইত্যাদি সংক্রান্ত এমন সংবাদ, যেগুলো গাইবি জগতের বিষয়। পাঠকবর্গ আগের অংশে (খণ্ড ৪) এ মাসআলার ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য দেখতে পাবেন।
    এছাড়াও কথা হচ্ছে, ঈসা আলাইহিস সালামের অধিকাংশ বক্তব্য এমনই ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল, তার শিষ্যরা যার উদ্দেশ্য বুঝতে অপারগ ছিলেন। অথচ তারাই এসব বক্তব্য বোঝার বেশি যোগ্য, বিশেষ করে ওই সমস্ত মাসআলা-মাসায়েল যেগুলোর ব্যাপারে এই চার বইয়ের দাবী হল, এগুলো আকিদার মূল ভিত্তি। যেমন উপাসনালয় ভেঙে যাওয়া এবং তিন দিনের মধ্যে এটি স্থাপন করা। এসব মৌলিক আকিদার অন্তর্ভুক্ত আরো রয়েছে, যোহন তার শেষ পুস্তকে যেমনটা উল্লেখ করেছেসাইমন পিটারকে উদ্দেশ্য করে ঈসা আলাইহিস সালামের উক্তি, যেখানে তাদের উভয়ের মধ্যকার ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। আপন শিষ্য যার সঙ্গে তার সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি রয়েছে, তার উদ্দেশ্যে উক্তি২১:২২ আমি যদি চাই যে আমি না আসা পর্যন্ত সে থাকুক, তাহলে আপনার কী হবে? (জন বললেন) ২৩ তখন ভাইদের মধ্যে এই কথাটি ছড়িয়ে পড়ল: সেই শিষ্য মারা যাবে না, কিন্তু যীশু বলেননি: তিনি মারা যাবেন না... ইত্যাদি) যোহনের সাক্ষ্য অনুসারে সমস্ত শিষ্য এই শব্দটি বুঝতে পারেনি। যোহন তার নিজের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, তাঁর সাক্ষ্য সত্য। কিন্তু কে এই যোহন? যাচাইয়ের মাধ্যমে তাকে জানা যায়নি, সম্ভবত তিনি পলের ছাত্রদের একজন ছিলেন (দেখুন ফ্রান্সের এনসাইক্লোপিডিয়া)।
    যদি প্রাচ্য এই ধরনের অপবাদ আবার আরোপ করে, তবে আমরা এই বিষয়ের অনেক প্রমাণ হাজির করবো যে, ঈসা আলাইহিস সালামের উক্তিতে নিগূঢ় রহস্য থাকার বিষয়ে এবং শিষ্যরা তার বক্তব্য বুঝতে না পারার কথা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছে। তবু কিভাবে তারা অন্যদের চোখে ধুলো রয়েছে বলে দোষ দিতে পারে অথচ নিজেদের চোখে থাকা বিরাট কাণ্ড তারা দেখতে পায় না?!

    --------------------------

    ওল্ড টেস্টামেন্টের বইগুলোর সঙ্গে কুরআনের বিরোধিতা রয়েছেঃ

    তৃতীয় মিথ্যাচার: ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনা প্রসঙ্গে ওল্ড টেস্টামেন্টের বইগুলোর সঙ্গে কুরআনের বিরোধিতা। এর জবাবে আমরা বলব: ওল্ড টেস্টামেন্টের ইতিহাসের সত্যতার ব্যাপারে কোন দলিল নেই। এমনটাই বিস্তারিতভাবে আমরা আল-মানারের বিশ্লেষণমূলক আলোচনায় তুলে ধরেছি। আর কুরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী হওয়ার ব্যাপারে অনেক দলিল-প্রমাণ রয়েছে। অতএব, এতদুভয়ের মাঝে বৈপরীত্য দেখা দিলে বুঝতে হবে কুরআনের বর্ণনাই চূড়ান্ত।

    ----------------------------------

    কুরআনে এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে ইউসুফের ঘটনা


    চতুর্থ মিথ্যাচার: তিনি দাবি করেছেন, ইউসুফ ইবনে ইয়াকুবের ব্যাপারে কুরআন বলেছেঃ তিনি সত্তাগতভাবে প্রবৃত্তির কাছে দুর্বল হয়ে ছিলেন। এদিকে তাওরাতে তাঁর ঘটনা থেকে জানা যায়, তিনি পুরোপুরি নির্দোষ ছিলেন। এই পার্থক্য দেখে বোঝা যায় তাওরাত আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী কিন্তু কুরআন সেরকম নয়।
    এর জবাব হল, কুরআন আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে সাব্যস্ত করেছে, ইউসুফ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে পরীক্ষা করেছিলেন, যেগুলো দ্বারা তাকে পরিশুদ্ধ করেছেন। তখন তিনি আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত প্রমাণিত হয়েছেন। যৌবন বয়সে আজিজে মিসরের স্ত্রীর কু-প্রস্তাব এমনই পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত। তখন তিনি নিজেকে সংযত রেখেছেন; ফিতনায় নিপতিত হননি। বন্দিত্বকে তিনি হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন। আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীর ব্যাপারে দুটো কথা রয়েছে-
    وَلَـقَدْ هَمَّتْ بِهٖۚوَهَمَّ بِهَا لَوْلَاۤ اَنْ رَّاٰ بُرْهَا نَ رَبِّهٖۗ
    "সেই মহিলা তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল, আর সে (ইউসুফ)ও তার প্রতি আসক্ত হয়েই যেত; যদি সে তার প্রতিপালকের নিদর্শন না দেখত।" (সূরা ইউসুফ: ২৪)

    প্রথম কথা হল: ভাষা বর্ণনাশৈলী থেকে সহজে যেটা বুঝে আসে, তারা উভয়েই অপরকে কাবু করতে চেয়েছে। আল-মানারের প্রথম খণ্ডে শেষদিকে আমরা সেটা ব্যাখ্যা করেছি।
    আর দ্বিতীয় কথা হল: তারা উভয়ই অশ্লীল কাজের ইচ্ছা করেছে। কিন্তু ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাঁর রবের নিদর্শন দেখার দরুন অশ্লীলতা ও পাপাচার থেকে ফিরে এসেছেন। এটি তাঁর অনেক বড় গুণ। এ থেকে বোঝা যায়, স্বভাবগত তাড়না ও প্রবৃত্তির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তিনি কতটা পবিত্র ছিলেন এবং প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কতটা শক্তিশালী ছিলেন!
    কিন্তু মিথ্যাচারকারী লেখক তার এই ফজিলত ও গুণের বিষয়টাকে তাওরাতের বিরোধিতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন, কিভাবে তারা লুত আলাইহিস সালামকে আপন কন্যাদের সঙ্গে যিনায় লিপ্ত হওয়ার অপবাদ দিয়েছে, কেমন করে তারা দাউদ আলাইহিস সালামকে হিট্টাইট উরিয়ার স্ত্রীর সাথে কুৎসিত পূর্বপরিকল্পিত ব্যভিচার এবং তারপর তাকে হত্যার অপবাদ দিয়েছে। অথচ কুরআন এমন জঘন্য মিথ্যাচার থেকে পুরোপুরি পবিত্র! এসবের ধারেকাছেও কুরআন নবীদের ব্যাপারে বাজে মন্তব্য করেনি। আর সুলাইমান আলাইহিস সালামকে নারীদের কারণে শিরিক ও মূর্তি পুজোয় লিপ্ত হবার অপবাদের কথা তো বাদই।

    ---------------------

    ষষ্ঠ মিথ্যাচার:ঈসা আলাইহিস সালামের মাথা মরিয়মকে ইমরানের প্রতি সম্বন্ধ করা

    এর জবাব দু'ভাবে দেয়া যায়। এই সম্বন্ধের ব্যাপারে তাদের কাছে অকাট্য কোন ঐতিহাসিক সূত্র নেই। দ্বিতীয়তঃ কোন ব্যক্তিকে গোত্রপ্রধান অথবা নিকটতম বা অতি উর্দ্ধতন পুরুষের দিকে সম্বন্ধ করার রেওয়াজ রয়েছে। যেমন- তারা ঈসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে বলে থাকে: ইবনে দাউদ।

    ----------------------------

    সপ্তম মিথ্যাচার:কুরআনের এই বর্ণনা যে, মারইয়ামের সম্প্রদায় তাকে উখতে হারুন (হারুনের বোন) (সূরা মারইয়ামের ২৮ নম্বর আয়াতে) বলে সম্বোধন করেছে। ইতিপূর্বে যে রেওয়াজের কথা বলা হয়েছে এটা তারই অন্তর্ভুক্ত। যেমন- সাহসী ব্যক্তিকে বলা হয়: ওহে আল-হিজার ভ্রাতা! হারুন আলাইহিস সালাম ছিলেন পাদ্রিদের প্রধান। এদিকে মারইয়াম আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করার জন্য একাকীত্বে পাদ্রিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তারা ঠাট্টা করে বলে: হে হারুনের বোন! কারণ তারা ঠাট্টা করবেই, যেহেতু মারিয়ামকে অশ্লীল কাজের অপবাদ দিয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর মহান গ্রন্থে এ সমস্ত অপবাদ থেকে তাকে মুক্ত করেছেন। এমনিভাবে খ্রিস্টানদেরও এমন মিথ্যাচার থেকে মুক্ত করেছেন যে, মারইয়ামের পুত্র ঈসা ইবনে ইউসুফ আন নাজ্জার। কুরআন তাদের সকল অপবাদ, মিথ্যাচার, বানোয়াট কথাবার্তা ও অবজ্ঞা থেকে মারইয়ামকে হেফাজত করেছে।


    [5] আল-মানার ম্যাগাজিন, সংখ্যা: সফর ১৩৫৩ হিজরি, জুন ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ, খণ্ড: ৩৪, পৃষ্ঠা: ১৪৭,
    সংখ্যা: রবিউল আউয়াল ১৩৫৩ হিজরি, জুলাই ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ, খণ্ড: ৩৪, পৃষ্ঠা: ২২৭,
    সংখ্যা: রবিউল আখির ১৩৫৩ হিজরি, আগস্ট ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ, খণ্ড: ৩৪, পৃষ্ঠা: ৩১১
    সংখ্যা: জুমাদাল আখিরা ১৩৫৩ হিজরি, অক্টোবর ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ, খণ্ড: ৩৪, পৃষ্ঠা: ৩৭৬


    [6] تاريخ الآداب العربية - খণ্ড: পৃষ্ঠা: ৪৮

    [7] التبشير والاستعمار - পৃষ্ঠা: ২১৩, ২১৪



    “ধৈর্যশীল সতর্ক ব্যক্তিরাই লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত।”-শাইখ উসামা বিন লাদেন রহ.

  • #2
    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। ভূমিকা পর্ব ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

    https://82.221.139.217/forum/%E0%A6%...A6%BE%E0%A6%B9

    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-১ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ


    https://82.221.139.217/forum/%E0%A6%...A6%BE%E0%A6%B9

    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-২ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

    https://82.221.139.217/forum/%E0%A6%...A6%BE%E0%A6%B9

    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-৩ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

    https://82.221.139.217/forum/%E0%A6%...A6%BE%E0%A6%B9


    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-৪ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

    https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A6%BE%E0%A6%B9

    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-৫ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ


    https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A6%BE%E0%A6%B9

    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-৬ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

    https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A6%BE%E0%A6%B9

    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-৭ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ


    https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A6%BE%E0%A6%B9

    ‘আল কিতাব ওয়াস সুলতান – ইত্তিফাক ওয়া ইফতিরাক’ এর বঙ্গানুবাদ ।। কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত: পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি ।। প্রথম খণ্ড ।। পার্ট-৮ ।। -শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ

    https://dawahilallah.com/forum/%E0%A6%AE%E0%A7%82%E0%A6%B2-%E0%A6%AB%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AF/185059-%E2%80%98%E0%A6%86%E0%A6%B2-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AC-%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E2%80%93-%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6%95-%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%87%E0%A6%AB%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E2%80%99-%E0%A6%8F%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6-%E0%A5%A4%E0%A5%A4-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B9-%E0%A6%93-%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A6%A4-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%93-%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A5%A4%E0%A5%A4-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%AE-%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1-%E0%A5%A4%E0%A5%A4-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9F-%E0%A7%AE-%E0%A5%A4%E0%A5%A4-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%96-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%AF-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B9
    “ধৈর্যশীল সতর্ক ব্যক্তিরাই লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত।”-শাইখ উসামা বিন লাদেন রহ.

    Comment

    Working...
    X