কিতাবুল্লাহ ও হুকুমত:
পারস্পরিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতি
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও ভাবনা
(প্রথম খণ্ড)
-শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
মূল প্রকাশনায়:
আস-সাহাব মিডিয়া (উপমহাদেশ)
সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী
(গ) প্রাক-ইসলামী (আইয়ামে জাহেলিয়াতে) আরবদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম এবং এর শিষ্টাচার
লুইস শেইখো আইয়ামে জাহেলিয়াতে আরবদের মাঝে খ্রিস্টধর্ম এবং তার রীতি-নীতি ও আদব শিষ্টাচার নিয়ে বই রচনা করেছেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, আইয়ামে জাহেলিয়াতে আরবদের মাঝে খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক চর্চা ছিল। শুধু তাই নয় বরং তিনি আরও প্রমাণ করতে চেয়েছেন, ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্টের ঘটনাগুলো এবং খৃষ্টান সাধুদের কাহিনীগুলো তারা বেশ চর্চা করত। তাদের দাবি, কুরআন সেই কাহিনীগুলো পুনরাবৃত্তি করেছে। তাদের ইঙ্গিত এ দিকে যে, খৃষ্টানদের বাইবেল থেকেই কুরআন বিভিন্ন কাহিনী এবং নানা বিষয়ের আলোচনা চয়ন করেছে। তিনি শুধু ইঙ্গিত দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং স্পষ্টভাবে সেটা বলেছেন। সেইসঙ্গে 'দেওয়ান আবুল আতাহিয়া' প্রকাশনায় তার কর্মপন্থা তুলে ধরতে গিয়ে তার যেই রচনাভঙ্গি নিয়ে আমি আলোচনা করেছি, সেই তথ্য বিভ্রাট এবং দলীল-প্রমাণের অপমিশ্রণ তো আছেই সে গ্রন্থে।
তার সেই গ্রন্থ অনেক সমালোচনার জন্ম দেয়। সেই কারণে জেসুইটদের সঙ্গে যুক্ত সে গ্রন্থের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দারুল মাশরিক পাঠকদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করে।
ইনশা আল্লাহ, সামনে আমি সেই সংশয় তুলে ধরব, যা লুইস শেইখো দাবি করেছেন। ইহুদীদের বর্তমান তাওরাত এবং খ্রিষ্টানদের বাইবেলের সঙ্গে কুরআনের ঘটনাবলীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে বিভিন্ন প্রাচ্যবিদদের কাছ থেকে তিনি যা উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
এখানে আমি কেবল তার তথ্য বিভ্রাট এবং ঘটনাপ্রবাহ বয়ানে অপমিশ্রণের পন্থা বোঝাতে সহায়ক কিছু উদাহরণ পেশ করেই ক্ষান্ত দেব।
• লুইস শেইখো তার প্রণীত গ্রন্থে কথিত আরবের খৃষ্টান গোত্রগুলো সম্পর্কে লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ আমরা উল্লেখ করতে পারি:
আউস খাজরাজ: তিনি দাবি করেছেন তারা খৃষ্টান ছিল। প্রিয় পাঠক আপনি লক্ষ্য করুন তিনি কি লিখেছেন: “ইয়াসরিব এবং তার আশেপাশে ইহুদীদের বাইরে অবশিষ্ট গোত্রগুলো সহ আউস খাজরাজ গোত্রের ধর্মের ব্যাপারে বলতে হয়, একথা প্রকাশ্য বিষয় যে, তারা প্রথমদিকে শিরকে লিপ্ত ছিল এবং মানাত মূর্তির উপাসনা করত। আল মিলাল ওয়ান নিহাল গ্রন্থে (পৃষ্ঠা নং ৪৩৪, লন্ডন সংস্করণ) শাহরিসতানী এমনটাই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা খৃষ্টান মতাদর্শে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। এ বিষয়ে আমাদের কাছে এমন দলীল-প্রমাণ রয়েছে, যেগুলো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পেয়ে আমরা বর্ণনা করতে পারি।[1]”
অতঃপর তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে এমন সব উদ্ধৃতি এনেছেন, যেগুলো আসলে তার পক্ষে কোনই কাজে দেবে না।[2] তিনি বেমালুম ভুলে বসেছেন, আউস খাজরাজ গোত্র হজের মৌসুমে একাধিকবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে, এমনকি স্বেচ্ছায় জেনে-বুঝে তারা নবীজিকে বাইয়াত দিয়েছে। তারা ছিলো ইহুদীদের প্রতিবেশী। সে সুবাদে তাদের জানা ছিল, একজন নবীর আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে।
ইবনে হিশাম রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন:
“ইবনে ইসহাক বলেন: যখন আল্লাহ তায়ালা আপন দ্বীনকে প্রকাশিত করতে এবং আপন নবীকে সম্মানিত করতে চাইলেন, যখন তিনি আপন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করার ইচ্ছা করলেন, তখন এরূপ ঘটালেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজের মৌসুমে আরবদের মাঝে বের হয়ে পড়লেন, সেখানে আনসার দলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটলো। তিনি আরবের গোত্রগুলোর সামনে নিজেকে পেশ করে দিলেন যেমনটা তিনি প্রতিটি হজের মৌসুমে করতেন। যখন তিনি আকাবা বা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছলেন, তখন খাজরাজ গোত্রের এক দলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটল; যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কল্যাণের ফয়সালা করেছেন।
আমাকে আসেম ইবনে ওমর ইবনে কাতাদা তার সম্প্রদায়ের কয়েকজন শাইখের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তারা বলেছেন, 'খাজরাজ গোত্রের কিছু লোক যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসলেন। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে- তোমরা কারা? তারা বলল- আমরা খাজরাজ গোত্রের একটি দল।
যাইহোক নবীজি তাদেরকে বললেন: তোমরা ইহুদীদের প্রতিবেশী নাকি? তারা জবাবে বলল: জি, হ্যাঁ। নবীজি বললেন: আমরা কি বসে কথা বলতে পারি? তারা বলল: কেন নয় অবশ্যই! অতঃপর তারা নবীজির সঙ্গে বসলো। তখন নবীজি তাদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলেন, তাদের কাছে ইসলাম পেশ করলেন এবং কুরআন পাঠ করে শোনালেন।
বর্ণনাকারী বলেন, যে কাজের বাহানায় আল্লাহ তাদেরকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এলেন, সেটা হল- তাদের দেশে ইহুদীরা তাদের সঙ্গে বসবাস করত; যারা ছিল আহলে কিতাব এবং বিদ্যা-বুদ্ধির অধিকারী। এদিকে তারা নিজেরা ছিল মূর্তিপূজক এবং শিরকে লিপ্ত। নিজেদের দেশে তাদের পরস্পরের যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিল। যখনই তাদের মাঝে ঝামেলা বেধে যেত, তখন ইহুদীরা তাদেরকে বলতো, একজন নবীর আগমন ঘটতে যাচ্ছে যার আবির্ভাব অত্যাসন্ন। আমরা তাকে অনুসরণ করব এবং তার সঙ্গে মিশে তোমাদেরকে আদ জাতি এবং ইরাম জাতির মত কচুকাটা করবো।
সে দলের সঙ্গে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বললেন এবং আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলেন, তখন তারা একে অপরকে বলল: হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের জানা আছে এবং তোমরা বুঝতে পারছ, আল্লাহর শপথ! ইনি হলেন সেই নবী, যার কথা বলে ইহুদীরা তোমাদেরকে হুমকি দিত। অতএব, ইহুদীরা যেন তোমাদের আগে তাঁর অনুসরণ না করে ফেলে। তখন তারা নবীজির দাওয়াত কবুল করে নিল, নবীজিকে সত্যায়ন করল এবং ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিল। তারা নবীজিকে বলল: আমরা নিজেদের সম্প্রদায়কে রেখে এসেছি। আমাদের নিজেদের মাঝে এত শত্রুতা-বিদ্বেষ আছে, যা অন্য কোন জাতির মাঝে নেই। আশা করছি- আল্লাহ আপনার মাধ্যমে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। তাই আমরা তাদের কাছে যেতে চাই এবং আপনার দ্বীনের দাওয়াত তাদের কাছে পৌঁছাতে চাই। আমরা যে মতাদর্শ গ্রহণ করেছি তা তাদের সামনে পেশ করতে চাই। যদি আপনার অধীনে আল্লাহ তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেন, তবে আপনার চেয়ে অধিক সম্মানিত আর কেউ হবে না।
অতঃপর তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে মুমিন অবস্থায় এবং তাকে সত্যায়নকারী হিসেবে নিজেদের দেশে ফিরে গেল।[3]
প্রিয় পাঠক! নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে তাদের কথোপকথন লক্ষ করুন। তারা কিভাবে জবাব দিলো যে, তারা ইহুদীদের প্রতিবেশী। তারা কখনোই বলেনি যে তারা খৃষ্টান। তারা ছিলো শিরকে লিপ্ত মূর্তিপূজক। তারা এই কথাও বলে দিয়েছে, কিভাবে তারা জানতে পেরেছিল একজন নবীর আগমন ঘটবে। সে কারণেই তো তারা আগেভাগেই ইসলাম কবুল করে নিয়েছিল।
এবার বলুন খৃষ্টানরা কেমন করে মক্কায় হজের উদ্দেশ্যে যাবে? খৃষ্টানদের ধর্মে কি মক্কার হজ রয়েছে?
ইসলাম দাওয়াতের মাধ্যমে মদীনায় প্রবেশ করেছে। মদীনায় ছিল ইহুদীরা। সেখানেই তাদের সুরক্ষিত গ্রাম, কেল্লা, বিভিন্ন গোত্র, ইহুদী উপাসনালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু মদীনায় কোন গির্জা অথবা ক্রুশ ছিল না। ছিল না কোন খৃষ্টান, পাদ্রী আবু আমের ছাড়া যিনি কায়সারের (রোমের বাদশা) কাছে গিয়ে খৃষ্টান হয়ে গিয়েছিলেন এবং কায়সার ইহুদীদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অচিরেই আবু আমের তাদের কাছে ফিরে আসবে।[4]
আসলে তিনি খৃষ্টান ছিলেন না। তিনি ছিলেন ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দ্বীনে হানিফের অনুসারী। এরপর তিনি তাতে এমন কিছু প্রবেশ করান, যা ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের মতাদর্শের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এরপর তিনি কায়সারের সঙ্গে মিলিত হয়ে খৃষ্টান হয়ে যান। এ বিষয়টা তিনি প্রকাশিত না করে গোপন রাখেন।[5]
আমার এত কিছু তুলে ধরার উদ্দেশ্য হলো- এ বিষয়টা দেখানো, লুইস শেইখো কিভাবে আউস খাজরাজ গোত্রকে খৃষ্টান প্রমাণ করতে চেয়েছেন অথচ তারাই ওই দুই গোত্র যারা জেনে-বুঝে স্বেচ্ছায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত কবুল করে নিয়েছিল। তখন একথাও তাদের জানা ছিল, এ দাওয়াত কবুল করলে গোটা আরব তাদেরকে আক্রমণের লক্ষ্যস্থল বানাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হবে। কিন্তু তারা আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তায়ালার কাছে থাকা প্রতিদানের আশায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্য-সহায়তা দেবার জন্য বাইয়াত প্রদান করে। তারা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার-পরিজনকে যেভাবে নিরাপত্তা দেয়, সেভাবে নবীজিকে নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে। তারাই ছিল ইসলামের একনিষ্ঠ সেনাদল। একাধিক জায়গায় কুরআন তাদের প্রশংসা করেছে। তাইতো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা ইরশাদ করেছেন:
وَا لَّذِيْنَ تَبَوَّؤُ الدَّا رَ وَا لْاِ يْمَا نَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّوْنَ مَنْ هَا جَرَ اِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُوْنَ فِيْ صُدُوْرِهِمْ حَا جَةً مِّمَّاۤ اُوْتُوْا وَيُـؤْثِرُوْنَ عَلٰۤى اَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَا نَ بِهِمْ خَصَا صَةٌ ۗ وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَـفْسِهٖ فَاُ ولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ
"(আর এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা মুহাজিরদের আসার আগে থেকেই (মাদীনাহ) নগরীর বাসিন্দা ছিল আর ঈমান গ্রহণ করেছে। তারা তাদেরকে ভালবাসে যারা তাদের কাছে হিজরাত করে এসেছে। মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা পাওয়ার জন্য তারা নিজেদের অন্তরে কোন কামনা রাখে না, আর তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে) নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়- নিজেরা যতই অভাবগ্রস্ত হোক না কেন। বস্তুত: যাদেরকে হৃদয়ের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম।" (সূরা হাশর: ০৯)
কিন্তু লুইস শেইখো মানুষকে কুরআনেরর বর্ণনার বাইরে অন্য কিছু গেলাতে চায়।
•শায়বান
লুইস শেইখো দাবি করেছেন শায়বান গোত্র খৃষ্টান ছিল। এটা প্রমাণে তিনি অনেক কসরত করেছেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তিনি লিখেছেন: শায়বান হল বকর ইবনে ওয়ায়েলের একটা মহল্লা। আত তাজ গ্রন্থের ৩২৮ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে:
শায়বান দুজন ছিল। একজন হল শায়বান ইবনে সালাবা ইবনে উকাবা ইবনে সা'ব ইবনে আলী ইবনে বকর ইবনে ওয়ায়েল। অপরজন হল শায়বান ইবনে যহল ইবনে সালাবা ইবনে উকাবা ইবনে সা'ব ইবনে আলী ইবনে বকর ইবনে ওয়ায়েল। বংশ-পরম্পরার চতুর্থ ও পঞ্চম স্তরে এরা হলো দুটো গোত্র। উভয় গোত্র খৃষ্টান হিসেবে পরিচিত যেমনিভাবে তাদের মূল পুরুষ বকর ইবনে ওয়ায়েল খৃষ্টান ছিলেন। বনু শায়বানের অবস্থানস্থল ছিল জাজিরাতুল আরবে যেটা দিয়ারে বকর নামে পরিচিত। স্থানটা দজলা নদীর কাছাকাছি যেখানে খৃষ্টানদের বেশ আবাদ ছিল। রোম ও সিরিয়াকের ইতিহাসে বনু শায়বান অধিকাংশ সময় বনি সালাবা নামে পরিচিত হয়েছে। (সালাবা গোত্র সম্পর্কে আমরা যা বলেছি তা দ্রষ্টব্য)[6]
এদিকে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, শায়বান গোত্রের অধিকাংশই খৃষ্টান ছিল না। তাদের নেতৃবৃন্দ এবং প্রভাবশালীদের অধিকাংশই ছিল মুশরেক। এই কারণেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় হজের মৌসুমে তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন, ইসলামের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তারাও উত্তম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং সুযোগ চেয়েছে। তাদের প্রতিক্রিয়া নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও পছন্দ করেছেন। পরবর্তীতে তারা ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিল।
ইমাম ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:
“ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আলী ইবনে আবি তালেব আমার কাছে বর্ণনা করেছেন: যখন আল্লাহ তাঁর রসূলকে নির্দেশ দিলেন যেন তিনি আরবের গোত্রগুলোর সামনে নিজেকে পেশ করেন, তখন নবীজি বের হয়ে পড়লেন মিনা অভিমুখে। আমি এবং আবু বকর ছিলাম নবীজির সঙ্গে। সেখানে গিয়ে আমরা আরব লোকদের কোন একটি বৈঠকের কাছে পৌঁছলাম। তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অগ্রসর হয়ে সালাম করলেন। আবু বকর ছিলেন সকল কল্যাণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী। তিনি ছিলেন বংশীয় মর্যাদাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। যাইহোক আবু বকর বললেন- আপনারা কোন গোত্র থেকে? তারা জবাবে বলল রাবিয়া গোত্র থেকে।
....................................
বর্ণনাকারী বলেন: অতঃপর আমরা আরেকটা জমায়েতে গিয়ে পৌঁছলাম, যেখানে খুবই প্রশান্ত নীরবতা ও ভাবগাম্ভীর্য বিরাজ করছিল। সেখানকার শাইখরা খুবই মর্যাদাসম্পন্ন এবং সম্ভ্রান্ত পরিসাজে ছিলেন। তখন আবু বকর অগ্রসর হয়ে সালাম করলেন। বর্ণনাকারী আলী বলেন: আবু বকর ছিলেন সকল কল্যাণের ক্ষেত্রেই অগ্রগামী; যাইহোক আবু বকর তাদেরকে বললেন- আপনারা কোন গোত্র থেকে? তারা জবাবে বলল, বনি শায়বান ইবনে সালাবা গোত্র থেকে। তখন আবু বকর নবীজির দিকে ফিরলেন অতঃপর বললেন: আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক! তাদের গোত্রে তাদের অপেক্ষা অধিক শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাশালী আর কেউ নেই। অন্য বর্ণনায় এসেছে: আবু বকর বলেছেন:ليس وراء هؤلاء غرر من قومهم، وهؤلاء غرر الناس অর্থাৎ তাদের পেছনে তাদের গোত্রের অধিক সম্ভ্রান্ত আর কেউ নেই তারাই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত।
তাদের মাঝে ছিলেন মাফরুক ইবনে আমর, হানি ইবনে কাবিসা, মুসান্না ইবনে হারেসা এবং নোমান ইবনে শারিক।
উপস্থিত সকলের মাঝে হযরত আবু বকর রাযি. এর সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন মাফরুক ইবনে আমর। কথাবার্তা ও আলাপচারিতায় সবার মাঝে সেরা ছিলেন তিনি। যেন তাঁর বক্ষদেশে বক্তৃতামালার দুটো নহর প্রবাহিত ছিল।
যাই হোক, তিনি মজলিসে হযরত আবু বকর রাযি. এর সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন। হযরত আবু বকর রাযি. তাকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনারা কত সংখ্যক লোক রয়েছেন? তখন তিনি জবাবে তাকে বললেন: আমরা তো হাজারের উপরে রয়েছি। অল্প লোক দিয়ে হাজারকে কখনোই পরাস্ত করা যায় না। তখন হযরত আবু বকর রাযি. তাকে বললেন: আপনাদের মাঝে প্রতিরোধ শক্তি কেমন? তখন তিনি জবাবে বললেন: আমাদের দায়িত্ব সংগ্রাম করে যাওয়া আর সম্প্রদায়ের সবাই এ বিষয়ে বেশ সচেতন সজাগ। তখন আবু বকর রাযি. বললেন: শত্রুদের সঙ্গে আপনাদের লড়াই কেমন হয়? মাফরুক জবাবে বললেন: যখন আমরা ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ি, তখনই আমরা সবচেয়ে ভয়ানকভাবে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হই। আমরা সন্তানাদির চেয়ে ঘোড়াকে প্রাধান্য দিই এবং টিকা দেয়ার চেয়ে অস্ত্রকে বেশি গুরুত্ব দিই। সাহায্য আল্লাহর পক্ষ থেকে। কখনো তিনি আমাদের দিকে বিজয় দেন, কখনও তাদের দিকে। আপনি মনে হয় কুরাইশ ভাই? তখন আবু বকর রাযি. বললেন: আপনাদের কাছে যদি আল্লাহর কোন রসুলের সংবাদ পৌঁছে থাকে, তবে তিনি হলেন এই ইনি। তখন মাফরুক্ বললেন: তাঁর সম্পর্কে আমাদের কাছে সংবাদ এসেছে যে, তিনি রিসালাতের কথা বলেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ফিরে বসলেন। এদিকে আবু বকর রাযি. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আপন কাপড় দ্বারা ছায়া দিচ্ছিলেন। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “আমি আপনাদেরকে দাওয়াত দিচ্ছি, আপনারা এই কথার সাক্ষ্য দেবেন, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল; আপনাদেরকে আরও দাওয়াত দিচ্ছি, আপনারা আমাকে আশ্রয় দেবেন এবং সাহায্য করবেন। যাতে আল্লাহ তায়ালা আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর পয়গাম পৌঁছে দিয়ে আমি সেই নির্দেশ পালন করতে পারি। কারণ কুরাইশরা আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেছে, আল্লাহর রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং সত্য থেকে বিমুখ হয়ে মিথ্যা ও বাতিল নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে, অথচ আল্লাহ তায়ালাই সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী এবং সকল প্রশংসার হকদার।”
তখন মাফরুক বললেন: হে কুরাইশ ভাই! আপনি আর কোন বিষয়ের দাওয়াত দিতে চান?
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেলাওয়াত করলেন:
قُلْ تَعَا لَوْا اَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ اَ لَّا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْئًـــا وَّبِا لْوَا لِدَيْنِ اِحْسَا نًا ۚ وَلَا تَقْتُلُوْۤا اَوْلَا دَكُمْ مِّنْ اِمْلَا قٍ ۗ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَاِ يَّاهُمْ ۚ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَا حِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ ۚ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللّٰهُ اِلَّا بِا لْحَـقِّ ۗ ذٰ لِكُمْ وَصّٰٮكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ * وَلَا تَقْرَبُوْا مَا لَ الْيَتِيْمِ اِلَّا بِا لَّتِيْ هِيَ اَحْسَنُ حَتّٰى يَبْلُغَ اَشُدَّهٗ ۚ وَاَ وْفُوْا الْكَيْلَ وَا لْمِيْزَا نَ بِا لْقِسْطِ ۚ لَا نُـكَلِّفُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا ۚ وَاِ ذَا قُلْتُمْ فَا عْدِلُوْا وَلَوْ كَا نَ ذَا قُرْبٰى ۚ وَبِعَهْدِ اللّٰهِ اَوْفُوْا ۗ ذٰ لِكُمْ وَصّٰٮكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ * وَاَ نَّ هٰذَا صِرَا طِيْ مُسْتَقِيْمًا فَا تَّبِعُوْهُ ۚ وَلَا تَتَّبِعُوْا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهٖ ۗ ذٰ لِكُمْ وَصّٰٮكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ
অর্থ: "বল, ‘এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করেছেন তা পড়ে শোনাই, তা এই যে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর, দরিদ্রতার ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, আমিই তোমাদেরকে আর তাদেরকে জীবিকা দিয়ে থাকি, প্রকাশ্য বা গোপন কোন অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না, আল্লাহ যে প্রাণ হরণ করা হারাম করেছেন, তা ন্যায় সঙ্গত কারণ ছাড়া হত্যা করো না। এ সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা চিন্তা- ভাবনা করে কাজ কর।"
"আর এটাই আমার সঠিক সরল পথ, কাজেই তোমরা তার অনুসরণ কর, আর নানান পথের অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এভাবে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তাঁকে ভয় করে যাবতীয় পাপ থেকে বেঁচে চলতে পার।"
"(ইয়াতীমরা) বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্য ছাড়া ইয়াতীমদের সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না। পরিমাপ ও ওজন ন্যায়সঙ্গতভাবে পূর্ণ কর, আমি কোন ব্যক্তির উপর সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেই না, যখন কথা বলবে তখন ইনসাফপূর্ণ কথা বলবে- নিকটাত্মীয়দের সম্পর্কে হলেও, আর আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা পূর্ণ কর। এসব ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।" (সূরা আনআম: ১৫১—১৫৩)
মাফরুক তখন বললেন, হে কুরাইশ ভাই! আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, এগুলো কোন পৃথিবীবাসীর বক্তব্য হতে পারে না। যদি তাই হত তাহলে আমরা বুঝে যেতাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেলাওয়াত করলেন:
اِنَّ اللّٰهَ يَأْمُرُ بِا لْعَدْلِ وَا لْاِ حْسَا نِ وَاِ يْتَاۤىِٕ ذِى الْقُرْبٰى وَيَنْهٰى عَنِ الْفَحْشَآءِ وَا لْمُنْكَرِ وَا لْبَغْيِ ۚ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ
অর্থ: "আল্লাহ ন্যায়-বিচার, সদাচরণ ও আত্মীয়দেরকে দেয়ার হুকুম দিচ্ছেন, আর তিনি নিষেধ করছেন অশ্লীলতা, অপকর্ম আর বিদ্রোহ থেকে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দিয়েছেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।" (সূরা নাহল: ৯০)
মাফরুক তখন নবীজিকে বলেন: আল্লাহর শপথ করে বলছি- হে কুরাইশী! আপনি উত্তম চরিত্র, নীতি-নৈতিকতা এবং সদাচরণের দাওয়াত দিয়েছেন। এমন সম্প্রদায় ধ্বংস হবে যারা আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং আপনার বিরুদ্ধে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেছে। মনে হলো তিনি চাইলেন- হানি ইবনে কাবীসা আলাপচারিতায় তার সঙ্গে অংশ নিক। তাই তিনি বললেন: ইনি হলেন হানি ইবনে কাবীসা। তিনি আমাদের শাইখ এবং ধর্মীয় বিষয়ে পণ্ডিত। হানি তখন নবীজিকে বলেন: ‘আমি আপনার বক্তব্য শুনেছি হে কুরাইশ ভাই এবং আপনার কথা সত্যায়ন করছি। কিন্তু আমার খেয়াল হলো, আজ আপনার সঙ্গে আমাদের যে মজলিস অনুষ্ঠিত হলো যার কোন শুরু নেই শেষ নেই, এমন একটি মজলিসের কারণেই যদি আমরা আমাদের ধর্ম ছেড়ে দিই এবং আমাদের অনুসারীদেরকে আপনার ধর্মের জন্য অনুমতি দিয়ে দিই, অথচ এখন পর্যন্ত আমরা আপনার দাওয়াত নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা-ফিকির করতে পারিনি, আপনি যে বিষয়ের আহ্বান জানিয়েছেন তার পরিণতি নিয়ে চিন্তা করতে পারিনি; তবে তো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এটা আমাদের পদস্খলন, বুদ্ধি-বিবেচনার ক্ষেত্রে অপরিপক্কতা এবং অপরিণামদর্শিতা বলে বিবেচিত হবে। কারণ তাড়াহুড়ো করলেই তো পদস্খলন ঘটে থাকে। আমাদের পেছনে সম্প্রদায়ের আরো কত লোক রয়েছে যাদেরকে না জানিয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অপছন্দ করি। তাই আপনি ফিরে যান আমরাও ফিরে যাই; আপনি চিন্তা-ভাবনা করুন! আমরাও করি।’
তখন মনে হলো- তিনি মুসান্না ইবনে হারেসাকে আলাপচারিতায় অংশগ্রহণ করাতে চাইছেন। তাই তিনি বললেন: এই যে মুসান্না তিনি আমাদের শাইখ এবং সামরিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তখন মুসান্না বললেন: ‘হে কুরাইশ ভাই! আমি আপনার বক্তব্য শুনেছি এবং আমার কাছে ভালো লেগেছে। আপনি যা বলেছেন তা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। হানি ইবনে কাবীসা যা বলবেন সেটাই আমাদের সবার জবাব বলে বিবেচিত হবে। আপনার সঙ্গে আমাদের অনুষ্ঠিত এই মজলিসের মাধ্যমেই আমরা আমাদের ধর্ম এবং অনুসারীদেরকে আপনার ধর্মের সামনে ছেড়ে দিতে রাজি আছি, তবে আমরা দুটো অবস্থার ভিতর আছি অনেক আগে থেকেই। একটা হল ইয়ামামা অপরটা হল সামামা। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: সে দুই জায়গা কি কি? তখন জবাবে বলেন: একটা হল স্থলভূমি ও আরব অঞ্চল। অপরটা হলো পারস্যের নদী অঞ্চল এবং কেসরার দেশ। আমরা কেসরার কাছে অঙ্গীকার করেছি, আমরা কোন নূতন বিষয় সৃষ্টি করবো না এবং এমন কাউকে আশ্রয় দেবো না। আপনি যে বিষয়ে দাওয়াত দিয়েছেন সেটা গ্রহণ করলে ঐ রাজারা এটা অপছন্দ করবে। তাই আরব অঞ্চলসংলগ্ন আমাদের যে অংশটা সেখানে কিছু করা হলে ক্ষমা পাওয়া যাবে এবং আরজি গৃহীত হবে। আর পারস্য অঞ্চলসংলগ্ন আমাদের যে অংশ, সেখানে কিছু করা হলে ক্ষমা পাওয়া যাবে না এবং আরজি গৃহীত হবে না। তাই আপনি যদি চান, আমরা আরব অঞ্চলসংলগ্ন অংশে আপনাকে সাহায্য করি এবং আশ্রয়দান করি, তবে সেটা আমরা রাজি আছি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যেহেতু আপনারা দ্ব্যর্থহীনভাবে সত্য উচ্চারণ করেছেন তাই আপনাদের জবাব খারাপ হয়নি। তবে আল্লাহর দ্বীন তাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হবে, যারা বিশ্বের সকল প্রান্তে এই দ্বীন নিয়ে চলতে প্রস্তুত।’
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আচ্ছা আপনাদের খেয়াল বলুন, যদি অল্প কিছুদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা আবার তাদের দেশ এবং অর্থ-সম্পদ আপনাদেরকে দান করেন, তাদের কন্যাদেরকে আপনাদের আয়ত্তে এনে দেন, তবে কি আপনারা আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করবেন, তাঁর প্রশংসা বর্ণনা করবেন এবং তাঁর গীত গাইবেন? তখন নোমান ইবনে শারীক বলেন: হে কুরাইশ ভাই! আপনাকে এমন কথা আমরা দিতেই পারি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেলাওয়াত করেন:
يٰۤـاَيُّهَا النَّبِيُّ اِنَّاۤ اَرْسَلْنٰكَ شَاهِدًا وَّمُبَشِّرًا وَّنَذِيْرًا * وَّدَا عِيًا اِلَى اللّٰهِ بِاِ ذْنِهٖ وَسِرَاجًا مُّنِيْرًا
অর্থ: "হে নবী! আমি তোমাকে পাঠিয়েছি (যুগে যুগে প্রেরিত নবী রসূলগণ যে তাঁদের উম্মতের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন- এ কথার) সাক্ষীস্বরূপ এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর পথে আহবানকারী ও আলোকপ্রদ প্রদীপরূপে।" (সূরা আল আহযাব: ৪৫)[7]
প্রিয় পাঠক! এবার বলুন খৃষ্টানরা কি মক্কার হজ করবে? তারপর কথা হল, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাদের নেতৃবৃন্দ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের আলাপচারিতায় খৃষ্টান ধর্মের কথা কোথায় বলা হয়েছে? ইসলাম কবুলের ব্যাপারে তারা নবীজির কাছে সুযোগ চাওয়া এবং আরব সংলগ্ন ভূমিতে নবীজিকে নিরাপত্তা দেবার প্রস্তাব উত্থাপনে; কোন কিছুতেই তো খৃষ্টান ধর্মের কোন কথা নেই।
পরবর্তীতে শায়বান গোত্র স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিল। নিশ্চয়ই তা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ, তিনি যাকে চান তাকে দান করেন।
•কিনদা
কিনদা অঞ্চলের লোকদের খৃষ্টান ধর্মের ব্যাপারে লুইস শেইখো বলেছেন: “হেজাজ ও নজদ এলাকায় খৃষ্টান ধর্ম চর্চার ব্যাপারে আলোচনাকালে কিনদা ও এ অঞ্চলের অধিবাসীদের খৃষ্টান ধর্মের ব্যাপারে পূর্বে আমরা আলোচনা করেছি। ইবনে হিশাম তাঁর সিরাত গ্রন্থে ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন, মুসলমানদের নবীর আগমনের পরেও তারা নিজেদের ধর্মের উপর অটল ছিল। তিনি বলেছেন (পৃষ্ঠা নং ২৮২): নবীজি কিনদা বসতিতে এলেন। তাদের মাঝে তাদের এক নেতা উপস্থিত ছিল, যাকে বলা হত মালীহ। তখন নবীজি তাদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলেন এবং তাদের সামনে নিজেকে পেশ করলেন। তারা প্রত্যাখ্যান করলো।[8]
লুইস শেইখো তার পূর্বের অভ্যাস মতো এখানে অর্ধসত্য উল্লেখ করেছেন। তিনি একথা উল্লেখ করেননি যে, সে সময়টা ছিল হজের মৌসুম। এখন বলুন, অন্যান্য মুশরিক গোত্রের মত খৃষ্টানরা কি কাবার হজ করতে এসেছিল?
সেইসঙ্গে লুইস শেইখো একথাও উল্লেখ করেননি, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কিনদা অঞ্চলের লোকদের পুরো আলাপচারিতা কি ছিল? কারণ সে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে, তারা আসলে খৃষ্টান ছিল না।
হাফেজ ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ তাঁর রচিত ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: “হাফেজ আবু নুয়াইম বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে অজলাহ এবং ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ আল্ আমাবী 'র সূত্রে, তারা উভয়ে মুহাম্মদ ইবনে সায়েব আল কালবী, তিনি আবু সালেহ সূত্রে, তিনি ইবনে আব্বাস সূত্রে এবং তিনি আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন: ‘আমার মনে হয় না তুমি এবং তোমার ভাই মিলে আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে। এখন বলো তোমরা কি আগামীকাল আমাকে বাজারে নিয়ে যাবে? সেখানে বিভিন্ন গোত্রের লোকদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে?’ বস্তুতঃ সে বাজারে ছিল আরবের বিভিন্ন গোত্রের জমায়েত। বর্ণনাকারী বলেন: তখন আমি বললাম: এই যে কিনদা এবং তার আশপাশের এলাকার লোকজন। ইয়েমেন থেকে যারা হজ করতে আসে তাদের মাঝে এরাই সর্বশ্রেষ্ঠ। আর এই যে বকর ইবনে ওয়ায়েলের বসতি। আরো দেখুন, আছে বনি আমের ইবনে সাসার বসতি। এখন আপনি পছন্দ করুন।
বর্ণনাকারী বলেন অতঃপর নবীজী কিনদা অঞ্চলের লোকদেরকে দিয়ে আরম্ভ করলেন। তাই তাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন: আপনারা কোন গোত্র থেকে?’ তারা বলল আমরা ইয়েমেনের অধিবাসী। তখন নবীজী বললেন: 'ইয়ামেনের কোন এলাকার?' তারা বলল: কিনদা। নবীজী বললেন: কিনদা এলাকার কোন গোত্র? তখন তারা বলল: বনি আমর ইবনে মুয়াবিয়া। তখন নবীজী বললেন: 'আপনারা কি কল্যাণের পথে অগ্রসর হতে চান?' তারা বলল কি সেই কল্যাণ? নবীজী বললেন: তোমরা সাক্ষ্য দেবে আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, সালাত কায়েম করবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে, সেগুলোর প্রতি ঈমান রাখবে।' আব্দুল্লাহ ইবনে আজলাহ বলেছেন; —অপর সূত্রে আমার পিতা তার সম্প্রদায়ের কতক শাইখের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন, কিনদার লোকেরা বলেছিল: যদি আপনি বিজয়ী হন, তবে আপনার পরে আমাদেরকে কর্তৃত্ব দান করবেন? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: 'নিশ্চয়ই কর্তৃত্ব আল্লাহর, তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন।' তখন তারা বলেছিল: আপনার দাওয়াত কবুলের কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের।
কালবী বলেনঃ তারা বলেছিল: আপনি আমাদের উপাস্যদের কাছ থেকে আমাদেরকে দূরে সরাতে এবং গোটা আরবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বলছেন? আপনি আপনার গোত্রের কাছে যান। আপনার দাওয়াতের কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের।[9]
এ থেকে বোঝা যায়, কিনদা অঞ্চলের লোকেরা আরবের অন্যান্য মুশরিক লোকদের মতোই কাবা ঘরের হজ করতে এসেছিল। তাদের ইসলাম প্রত্যাখ্যানের কারণ ছিল, তাদের সেই শর্ত প্রত্যাখ্যাত হওয়া যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাদেরকে শাসন কর্তৃত্ব দিতে হবে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি তারা বলেছিল, আপনি আমাদের উপাস্যদের কাছ থেকে আমাদের কে দূরে সরাতে এসেছেন? অর্থাৎ তারা মুশরিক ছিল।
হাফেজ আবু নুআইম আল আসবাহানী রহিমাহুল্লাহ যা উল্লেখ করেছেন সেটা থেকে আমাদের উপরোক্ত বক্তব্য আরো জোরালো হয়:
“ইবনে রুমান এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ থেকে বর্ণিত, তারা বলেছেন: উকাযের বাজারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিনদা এলাকার লোকদের বসতিতে উপস্থিত হলেন। তাদের চেয়ে অধিক নম্র ও নমনীয় আরবের অন্য কোন গোত্রের কাছে তিনি আসেননি। যখন তিনি তাদের নমনীয়তা নম্রতা এবং নবীজির জন্য তাদের ললাটের তেজ লক্ষ্য করলেন তখন তিনি তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে আরম্ভ করলেন এবং বললেন: “আমি আপনাদেরকে এক আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিচ্ছি; যিনি কোন অংশীদার রাখেন না। আমি আপনাদেরকে আরও দাওয়াত দিচ্ছি, আপনারা যেভাবে নিজেদেরকে নিরাপত্তা দেন, এভাবে আমাকে নিরাপত্তা দেবেন। যদি আমি বিজয়ী হই তবে তারপর থেকে আপনাদের ইচ্ছা।” তখন তাদের সাধারণ লোকেরা বলল: কত সুন্দর কথা বলেছেন, কিন্তু আমরা তো সেসব প্রতিমার উপাসনা করি, আমাদের বাপ-দাদারা যেগুলোর উপাসনা করত। তখন সম্প্রদায়ের সবচেয়ে কনিষ্ঠজন বলে উঠল: হে আমার সম্প্রদায়! অন্যরা এ ব্যক্তির দাওয়াত কবুল করার আগেই আপনারা তাঁর দাওয়াত কবুল করে নিন! কারণ আল্লাহর শপথ! আহলে-কিতাবেরা খুব বলাবলি করে, হারাম শরীফ থেকে একজন নবীর আবির্ভাব ঘটবে, যার আগমনের সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। তাদের মাঝে একজন অন্ধ লোক ছিল সে বলে উঠলো: তোমরা আমাকে একটু বলতে দাও। এই ব্যক্তি কে তার প্রতিবেশীরা বের করে দিয়েছে আর তোমরা কিনা তাকে আশ্রয় দিচ্ছ? তোমরা কি গোটা আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে প্রস্তুত হতে চাও? না কখনই তা হতে পারে না। তখন নবীজী মনঃক্ষুন্ন হয়ে তাদের কাছ থেকে চলে গেলেন। এদিকে ওই সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের লোকদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে অবহিত করল। তখন ইহুদিদের একজন বলে উঠল: আল্লাহর শপথ! তোমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছো। যদি আগেভাগে তোমরা এই ব্যক্তিকে গ্রহণ করে নিতে, তবে তোমরা আরবকে নেতৃত্ব দিতে পারতে। আমরা আমাদের কিতাবে তার বিবরণ পেয়েছি। আমরা দেখেছি মক্কা থেকে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে এবং তাঁর হিজরতের ভূমি হবে ইয়াসরিব। তখন ওই সম্প্রদায়ের সকলে পরবর্তী বছর হজের মৌসুমে নবীজির কাছে পৌঁছার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সে বছর তাদের এক নেতা তাদেরকে হজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে সফল হল, ফলে তাদের কেউই সে বছর যেতে পারেনি। এদিকে ইহুদি মারা গেল এবং তার মৃত্যুর সময় শোনা গেল, তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যায়ন করছেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান ঘোষণা করছেন”।[10]
এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ওই সম্প্রদায়ের লোকেরা মুশরিক ছিল; খৃষ্টান নয়।
পরবর্তীতে কিনদা অঞ্চলের প্রতিনিধিদল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে মদিনায় বিরাট দলবল নিয়ে মুসলিম হয়ে উপস্থিত হয়েছিল।
ইবনে ইসহাক রহিমাহুল্লাহ বলেন:
“আশআস ইবনে কায়েস নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিনদা অঞ্চলের প্রতিনিধি দল নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। যুহরি আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি কিনদা হতে আশিজন অশ্বারোহী নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তারা তাদের চুলের অগ্রভাগ টেনে বেঁধে রেখে ছিলেন এবং নিজেদের উপরে চাদরের দীর্ঘ পোশাক দিয়ে রেখেছিলেন; সেগুলোর মধ্যে রেশমী কাপড়ের কাজ ছিল। যখন তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উপস্থিত হলেন, তখন নবীজি তাদেরকে বললেন: 'তোমরা ইসলাম গ্রহণ করোনি?' তারা জবাবে বলল: অবশ্যই করেছি। তখন নবীজী বললেন: 'তাহলে তোমাদের কাঁধে এ রেশমি কাপড় কেন?' বর্ণনাকারী বলেন তখন তারা সে কাপড় খুলে ফেলে দিল”।[11]
অতঃপর লুইস শেইখো এমন দলীল হাজির করতে চেয়েছেন, যা খোদ প্রমাণিত হওয়ার জন্য অন্য দলীলের প্রয়োজন। তার সেই দলীল হল, একটা গ্রন্থ; যার নাম হচ্ছে— كتاب عبد المسيح الكندي إلى عبد الله الهاشمي অর্থাৎ আব্দুল মাসীহ আল কিনদীর পক্ষ থেকে আব্দুল্লাহ হাশেমীর কাছে প্রেরিত পত্র।
সেই পত্রে আব্দুল মাসীহ কিনদী তার খৃষ্টান পিতৃপুরুষের কথা বলে গর্ব প্রকাশ করেছেন। সেখান থেকেই লুইস শেইখো একথা উদ্ধৃত করেছেন যে: “আরবে আমাদের কেমন প্রাধান্য ছিল, আমরা কতটা গোছালো ছিলাম সে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পছন্দ করি না। আরব অঞ্চলে আমাদের পিতৃপুরুষ কতটা মর্যাদাবান ছিলেন সেগুলো নিয়ে আমরা গর্ব করতে চাই না। কারণ এই বিষয়গুলো সকলেরই জানা। আমাদের বাপ দাদাদের এ বিষয়গুলো কারো কাছে অস্পষ্ট নয়। জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনা সম্পন্ন সকলেই জানেন, কিনদায় যারা শাসক ও রাজা-বাদশা ছিলেন; যারা আমাদেরকে জন্ম দিয়েছেন তারা কেমন ছিলেন এবং গোটা আরবে তারা কতটা মর্যাদাবান ছিলেন?! আমরা এগুলো নিয়ে গর্ব করতে চাই না। আমরা সেই কথাই কেবল বলতে চাই, যা সত্যের বার্তাবাহক পল বলেছেন: 'শুনে রাখ কেউ যদি গর্ব করতে চায়; সে যেন আল্লাহকে নিয়ে এবং পুণ্যকর্ম নিয়ে গর্ব করে। কারণ এগুলোই চূড়ান্ত মর্যাদা ও গর্বের বস্তু। তাই আজ আমরা যা নিয়ে অনেক গর্ব করি তা হল খৃষ্টান ধর্ম। এ ধর্মে রয়েছে আল্লাহর মারেফত ও পরিচয় লাভ এবং এ ধর্মের মাধ্যমেই আমরা পুণ্য কর্মের দিশা লাভ করি...”[12]।
যে গ্রন্থের কথা বলা হলো, যার লেখক অজ্ঞাত, সে গ্রন্থের ব্যাপারে সংক্ষেপে বলবো: খৃষ্টানরা হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দী মোতাবেক খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে একটি চিঠি প্রকাশ করে। তারা দাবি করে, খলিফা মামুনের দরবারে দুজন ব্যক্তি কাজ করতো এবং তাদের মধ্যকার চিঠিপত্র এটি। তাদের মধ্যে একজন হলো মুসলমান এবং তাকে ডাকা হতো আব্দুল্লাহ আল্ হাশেমী বলে। আর অপরজন খৃষ্টান, তাকে ডাকা হতো আব্দুল মাসীহ আল কিনদী বলে। এই চিঠিপত্রে তাদের কথিত মুসলিম ব্যক্তি তাদের কথিত আব্দুল মাসীহকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করে। তখন আব্দুল মাসীহ জবাবে যে পত্র প্রেরণ করে সেখানে ইসলামকে আক্রমণ করে এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের দ্বারা নিজের বক্তব্যের পক্ষে দলীল পেশ করে। খৃষ্টানরা তার সেই জবাবী পত্র খুব যত্ন সহকারে গ্রহণ করে এবং মুসলমানদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য নমুনা হিসেবে প্রাচ্যবিদদের মাঝে সে পত্র প্রচার করে। পত্রটা লন্ডনে ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে মুদ্রিত হয়। অতঃপর ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে পুনরায় মুদ্রিত হয়। এমনিভাবে কায়রোতে তা ১৯১২ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
অথচ ইতিহাসে এমন দুই নামে কোন দু'ব্যক্তি সম্পর্কে জানা যায় না। লুইস শেইখো দাবি করেছেন, সে পত্রটা বাস্তবে ছিল এবং তার দলীল হল আল বিরুনি তার الآثار الباقية গ্রন্থে সে পত্রের কথা উল্লেখ করেছেন।[13]
কিন্তু গবেষকদের অনেকেই এ পত্রকে বানোয়াট বলেছেন এবং সিরিয়াক পাদ্রীদের তৈরি বলেছেন।[14] এমনিভাবে খৃষ্টান চিকিৎসক দার্শনিক ইয়াহিয়া ইবনে আদী —যিনি ৩৬৪ হিজরী মোতাবেক ৯৭৫ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন তার তৈরি বলেছেন।[15] এছাড়াও এ পত্রের লেখক হিসাবে একজন ইহুদির কথা বলা হয়, যে খৃষ্টান হয়ে গিয়েছিল এবং ইসলামের ব্যাপারে মিথ্যাচার করার জন্য এ পত্র রচনা করেছিল আগ্রাসী স্প্যানিশদের তোষামোদি হিসেবে।[16]
কিছু কিছু ক্ষতিকর বিষয় উপকার টেনে আনে এখানেও তেমনটা ঘটেছে। আল্লামা খাইরুদ্দিন আবুল বারকাত নুমান আলুসি[17] তাঁর রচিত الجواب الفسيح لما لفقه عبد المسيح গ্রন্থে[18] এ পত্র খণ্ডন করেছেন।
তিনি সে গ্রন্থে কিনদীর চিঠিপত্রে যত মৌলিক কথা ছিল, সেগুলো নিয়ে এসেছেন এবং এমন কোনো সংশয় অবশিষ্ট রাখেননি, যা তিনি নিরসন করেননি। তাদের সবগুলো আপত্তিকে তিনি বিভিন্ন দলীলের মাধ্যমে দূর করে দিয়েছেন। সেসব দলীলের মধ্যে রয়েছে, খোদ তাদের বাইবেলের বক্তব্য এবং তাদের ধর্মীয় পণ্ডিত লোকদের বিভিন্ন উক্তি।
(চলবে, ইন শা আল্লাহ)
[1] النصرانية وآدابها بين عرب الجاهلية ج: 2 ص: 114 وما بعدها
-খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১১৪ থেকে সামনে।
[2] এখানে আমি লুইস শেইখোর বক্তব্য তুলে ধরবো। যাতে আমার ব্যাপারে এই মিথ্যাচার করা না হয় যে, আমি তার লেখা গোপন করেছি। সেইসঙ্গে তার উপস্থাপিত দলীল-প্রমাণের সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা যাতে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, যেগুলো সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এগুলো নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে নেয়া হয়েছে—এ জন্যেও তার দলীলগুলো তুলে ধরা দরকার।
লুইস শেইখো বলেছেন: “আমি এই অধ্যায়ের শুরুতে দেখেছি, খ্রিস্টান ধর্মের দাঈ ও আহ্বায়করা খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের দিক থেকেই হেজাজের ভূমিতে প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছিলেন। শুধু তাই নয় বরং প্রথম ইসলামিক ঐতিহাসিক ইবনে জারীর মদীনাবাসীর কাছ থেকে একটি বর্ণনা নকল করেছেন; সেখানে মদীনাবাসী বর্ণনা করেছেন, তাদের অঞ্চলের পাশে আকিক পর্বতে যীশু খ্রিস্টের একজন বার্তা বাহকের সমাধি তারা পেয়েছেন। (পৃষ্ঠা নং ১০৭ দ্রষ্টব্য)
মদীনার অধিবাসী আরবেরা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ছিল এ বিষয়ের পক্ষে আরো একটি দলীল হল, আউস ও খাজরাজ এই দুই গোত্র হারেস ইবনে সা'সা'র সঙ্গে সম্বন্ধিত ছিল। ফলে তাদের বংশ পরম্পরা বনি গাসসানের সঙ্গে গিয়ে মেলে। আর গাসসান গোত্রের খ্রিস্টান হওয়া এমনভাবে সাব্যস্ত, এ নিয়ে কোন সন্দেহ করার সুযোগ নেই। কেবল সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চাইলে কেউ এ বিষয় নিয়ে সন্দেহ করতে পারে, যেমনটা আপনারা দেখেছেন। অতএব, এ কথা বলা কি সঠিক নয়, আউস এবং খাজরাজ এই দুই গোত্র গাসসান গোত্রের ধর্মীয় উত্তরাধিকার লালন করবে? এছাড়াও আরেকটি দলীল হল, শামের বাদশাহ আবু জুবাইল আল-গাসানি, যিনি তাঁর খ্রিস্টান ধর্মের জন্য পরিচিত, তিনি যদি না জানতেন যে, আউস খাজরাজ গোত্রের লোকেরা তাঁর ধর্ম অনুসরণ করে, তবে তিনি মদীনার ইহুদীদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করতেন না।
এর পক্ষে আমাদের কাছে আরও একটি প্রমাণ রয়েছে, যা আরও জুতসই ও দালীলিক শক্তিসম্পন্ন। তা হল, ইয়াসরিব শহরের অধিবাসীদেরকে দেয়া নাম, যাদেরকে কোন শর্ত ছাড়া 'আহলে কিতাব' বলা হত। শাহরিসতানী আল মিলাল ওয়ান নিহাল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা নং ১৬২, লন্ডন সংস্করণ): “নবীজির রিসালাতের পূর্বে যে দুটো দল ছিল, সেগুলো হল আহলে কিতাব এবং উম্মীরা। উম্মী বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যার অক্ষর জ্ঞান নেই। অতএব, বোঝা গেল ইহুদী খ্রিস্টানরা ছিল মদীনায় আর উম্মীরা ছিল মক্কায়।”
এখানে আমি বলব: শাহরিসতানীর এরপরের বক্তব্য আমাদের দেখতে হবে, যা লুইস শেইখো উদ্ধৃত করেননি। “যারা আহলে-কিতাব ছিল তারা আসবাত তথা ইসহাক নবীর সন্তানদের ধর্মকে সাহায্য করত এবং বনি ইসরাইলের মাযহাব অনুসরণ করতো। আর উম্মীরা কবিলা এবং ইসমাইল নবীর সন্তানদের গোত্রীয় পরম্পরাগত ধর্ম অনুসরণ করতো (শাহরিসতানীর প্রণীত আল মিলাল ওয়ান নিহাল, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২২৮)
অর্থাৎ, শাহরিসতানী মদীনার অধিবাসী বলে যাদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন, তারা হল ইহুদীরা। শাহরিসতানীর বক্তব্য দ্বারা দলীল দেয়াটা কতটা উপযুক্ত সে কথা নাই বললাম।
অতঃপর লুইস শেইখো বলেছেন:
“তার এই বক্তব্য থেকে বুঝে আসে, মদীনাবাসী দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। একভাগে ইহুদীরা, যেমন- কুরাইজা বনু নাজির। অপরভাগে হলো খ্রিস্টানরা, যেমন- আউস খাজরাজ গোত্র এবং কুদাআ গোত্র। তারা সবাই মদীনায় বাস করত। বরং কখনো কখনো এমন হয়, দেখা যায় খ্রিস্টানদের ব্যাপারে আহলে কিতাব কথাটা বেশি প্রযোজ্য হয় যেমনটা বলেছেন কুসতুলানী। মুহাম্মদের মদীনার উদ্দেশ্যে হিজরতের দিন আউস গোত্রের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যাকে আবু আমের বলা হত, যার নাম থেকে তার ধর্মের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, সে থেকেও আমাদের উপরের বক্তব্য সমর্থন পায়। এ ব্যক্তি ওহুদের দিন মুহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। অতঃপর সপরিবারে সাকিফ রওয়ানা হয়ে যান। তিনিই ওই ব্যক্তি যাকে ইসলামের রসূল ফাসিক বা পাপীষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
খৌরি বুট্রোস আজিজ কর্তৃক ১৯০৯ সালে প্রকাশিত ক্যাল্ডিয়ান চার্চের পুরানো ক্যালেন্ডারে (পৃষ্ঠা নং: ৮) বলা হয়েছে: নেস্টোরিয়ানরা ইয়াসরিবে একটি মেট্রোপলিটন প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং সেখানে তিনটি চার্চ ছিল। সেগুলোর নাম হলো ইব্রাহিম আল খালিল, আইয়ুব আস- সিদ্দীক এবং মূসা আল কালীম।”
মসুলবাসীদের মধ্যে একজনের অন্য একটি হস্তলিখিত ক্যালেন্ডারে আমরা এ রেওয়ায়েত ও বর্ণনা পেয়েছি। আল্লাহ তায়ালা এর শুদ্ধতা সম্পর্কে ভাল জানেন।
যাইহোক, ইসলামপূর্ব যুগে মদীনায় খ্রিস্টান ধর্মের উপস্থিতি এবং ইসলাম আবির্ভাবের পরেও প্রথমদিকে খ্রিস্টান ধর্ম চর্চার বিষয়টা কোনোভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কারণ খ্রিস্টানরা যেখানে আরব সীমানার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, সেখানে রোমানদের রাজ্যগুলির প্রতিবেশী অঞ্চলে খ্রিস্টান ধর্মের উপস্থিতি সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? প্রাচ্যবিদরা তাদের বর্তমান বইগুলোতে এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন। একজন বড় মাপের প্রাচ্যবিদ ওয়েলহাউসেন বলেছেন: “মুহাম্মদ ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মের মাধ্যমে ক্ষেত্র প্রস্তুত পেয়েছেন। কারণ সেখানে অনেক ইহুদী বসবাস করত, তদুপরি মদীনা শহরটি রোমান ও গ্রীকদের সীমানায় এবং আরামিয়ান খ্রিস্টানদের প্রভাব বলয় ও কর্তৃত্বের আওতাভুক্ত ছিল।” একইভাবে, প্যারিসের প্রাচ্য ভাষার অন্যতম শিক্ষক হটউইগ ডর্নবার্গ আল-মুসাভি, যিনি ১৯১০ সালে মারা গিয়েছিলেন, বলেছেন:
“আরব উপদ্বীপে খ্রিস্টধর্মের অনেক ভূমিকা ছিল। উত্তরে আল-হিরা ও গাসসান রাজ্যের মালিকানা তাদের ছিল, জাজিরাতুল আরবের মধ্যভাগে মদীনায় এবং দক্ষিণ ভাগে ইয়েমেনের বিশপদের কর্তৃত্বও তাদের কাছে ছিল”।
এমনকি ইসলামের নবীর ইন্তেকালের পরেও ইয়াসরিবে খ্রিস্টানরা অবশিষ্ট ছিল যেমনটা বোঝা যায় হাসসান ইবনে সাবেতের সেই কবিতা থেকে যা তিনি মুহাম্মদের বিরহশোকে গেয়েছেন— (লেডন সংস্করণ, ৫৯ Hischfeld):
فرحت نصارى يثرب ويهودها لما توارى في الضريح الملحدِ
অর্থ: ইয়াসরিবের খ্রিস্টান ও ইহুদীরা খুশি হয়েছে, যখন তিনি মাটির নিচে কবরে শায়িত হয়েছেন।
সম্ভবত খ্রিস্টান ও ইহুদীরা মদীনায় ওমর ইবনুল খাত্তাবের আমল পর্যন্ত থেকে গিয়েছিলো যিনি উভয়দলকে জাজিরাতুল আরব থেকে বিতাড়িত করেন হাদিসের একটি বর্ণনার ভিত্তিতে। সে হাদীসে নবীজী বলেন: “আমি অবশ্যই অবশ্যই খ্রিস্টান ও ইহুদীদেরকে জাজিরাতুল আরব থেকে বহিষ্কার করে দেব”।
ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক যখন ৮৮ হিজরীতে (৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) মদীনায় নববী মসজিদ নামে পরিচিত বড় মসজিদের ভবন সংস্কার করতে চাইলেন, তখন তার স্থপতিরা ছিল রোমক ও কিবতীয় খ্রিস্টান। ঐতিহাসিকরা এমনটাই বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিক তাবারী বলেছেন (২:১১৭): “রোমানদের রাজা তাকে একশ শ্রমিক, এক লক্ষ মিসকাল স্বর্ণ এবং মোজাইক বহনকারী চল্লিশটি উট পাঠিয়েছিলেন। শ্রমিকেরা তখন মসজিদ নির্মাণ করে এবং তার দৈর্ঘ্য দুইশ গজ বৃদ্ধি করে। পরবর্তীতে কোনো কোনো নাগরিক কাজটাকে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেনি কারণ তাদের মনে হয়েছিল, নির্মিত মসজিদ ভবন গির্জার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়েছে। [النصرانية وآدابها بين عرب الجاهلية – খ্রিস্টধর্ম এবং প্রাক-ইসলামী যুগের আরবদের মধ্যে তার শিষ্টাচার, খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১১৪ থেকে ১১৬]।
আমি বলি: লুইস শেইখোর প্রমাণ উপস্থাপনের পদ্ধতি অনুসারে এ কথা কি বলা সম্ভব, রোমানদের রাজা মুসলমান ছিলেন?
[3] সীরাতে ইবনে হিশাম: খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪২৮, ৪২৯
[4] তাফসীরে কুরতুবী, সূরা তাওবা: ১০৭, খণ্ড: ১০, পৃষ্ঠা: ৩৭০
[5] ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব রহিমাহুল্লাহ থেকেوَإِرْصاداً لِمَنْ حارَبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ—এই আয়াতের শানে নুযুল বা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। “এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে আবু আমের ইবনে সাইফির ব্যাপারে। জাহেলী যুগে সে পাদ্রিদের পোশাক পরে পাদ্রি সেজে থাকতো। সে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কুফরি করে। ঘটনা হল- সে মদীনায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়। এরপর বলে: হে মুহাম্মদ! আপনি কিসের পয়গাম নিয়ে এসেছেন? নবীজী বলেন: “আমি ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের দ্বীনে হানিফ নিয়ে এসেছি।” তখন সে বলে আমি তো এই মতাদর্শের উপরেই প্রতিষ্ঠিত আছি। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আপনি এর উপর প্রতিষ্ঠিত নন। আপনি বাইরে থেকে অনেক কিছু এতে প্রবেশ করিয়েছেন।” তখন আবু আমের বলে: আমাদের মধ্যে যে মিথ্যাবাদী তাকে আল্লাহ বিতাড়িত ও সঙ্গীহীন অবস্থায় মরণ দিন! সে এ কথা বলেছিল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইঙ্গিত দিয়ে। যেহেতু তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে চলে এসেছিলেন। এদিকে সে নিজে একাকী সিরিয়া অভিমুখে রওনা হয় এবং কায়সারের ওখান দিয়ে অতিক্রমকালে মুনাফিকদের কাছে পত্র লেখে: তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করো আমি কায়সারের কাছ থেকে এক বাহিনী নিয়ে তোমাদের কাছে আসছি মুহাম্মদকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করার জন্য। এরপর সে নিজেই সঙ্গীহীন অবস্থায় শামে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে— وَإِرْصاداً لِمَنْ حارَبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ —[তাফসীরে কুরতুবী, সূরা আল আরাফ, আয়াত নং: ১৭৫] وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا ... খণ্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ৩৮৪
[6] النصرانية وآدابها بين عرب الجاهلية ج: 2 ص: 131 و132
খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১৩১-১৩২
[7] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৩৫২—৩৫৯, এছাড়াও হাদীসটি হাফেজ ইবনে হাজার ফাতহুল বারি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং এ সম্পর্কে বলেছেন: ‘হাকেম, আবু নুআইম ও বাইহাকী হাসান সনদে ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে আদ-দালায়েল গ্রন্থে এ হাদীস এনেছেন।’ [ফাতহুল বারি, মক্কায় বাইয়াতে আকাবা'র উদ্দেশ্যে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আনসারিদের প্রতিনিধিদল সম্পর্কিত অধ্যায়, খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ২২০]
[8] النصرانية وآدابها بين عرب الجاهلية ج: 2 ص: 139
খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১৩৯
[9] البداية والنهاية ج: 4 ص: 348 و349[আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৩৪৮, ৩৪৯]
[10] دلائل النبوة لأبي نعيم- خبر رقم: 222 ص: 297 [আবু নুআইম রচিত দালায়েলুন নবুওয়াহ, হাদীস নং: ২২২, পৃষ্ঠা: ২৯৭]
[11] السيرة النبوية لابن إسحاق ص: 655 و656 [ইবনে ইসহাক রচিত আসসীরাহ আন নববীয়া, পৃষ্ঠা: ৬৫৫-৬৫৬]
[12] النصرانية وآدابها بين عرب الجاهلية ج: 2 ص: 123
[13] النصرانية وآدابها بين عرب الجاهلية ج: 2 ص: 123
[14] এটি অধ্যাপক আল-বাকরি ১৯৪৭ সালে কলেজ অফ আর্টস জার্নালের প্রথম সংখ্যায় তার একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন। [بين الإسلام والمسيحية- رسالة أبي عبيدة الخزرجي، تحقيق وتقديم وتعليق: محمد شامة، مكتبة وهبة، القاهرة ص: 43].
[15] যেমনটি ডক্টর রাবি বিন মুহাম্মদ বিন আলী উল্লেখ করেছেন [الغارة على العالم الإسلامي وصدام الحضارات - তথা ইসলামিক বিশ্বে অভিযান এবং সভ্যতার সংঘর্ষ, পৃষ্ঠা: ৬৭ এবং তার পরেও।]
[16] تاريخ ترجمة المستشرقين لمعاني القرآن الكريم وبيان خطرها ص: 13، نقلها عن: مجلة النور عدد: 89، والإسلام في أبحاث الإستشراق الإسباني ج: 1ص: 146-147. [পৃষ্ঠা: ১৩, (কুরআনুল কারীমের অর্থের অনুবাদকর্মে প্রাচ্যবিদদের ভয়াবহ কার্যকলাপের ইতিহাস), তিনি 'আন-নূর' ম্যাগাজিনের ৮৯ সংখ্যা থেকে এবং الإسلام في أبحاث الإستشراق الإسباني প্রবন্ধ (ইসলাম ইন স্প্যানিশ ওরিয়েন্টালিস্ট রিসার্চ- খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৪৬-১৪৭) থেকে উদ্ধৃত করেছেন।]
[17] তিনি ১৩১৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তিনি মুফাসসিরে কুরআন ইমাম আল-আলুসির পুত্র রহিমাহুমাল্লাহ।
লুইস শেইখো (আরবি সাহিত্যের ইতিহাস)-এ সাইয়্যিদ আবিল-বারাকাত নুমান আল-আলুসির জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে বলেননি, যদিও তার পিতা ও ভাইদের (আল্লাহ তাদের সকলের উপর রহম করুন) সম্পর্কে লিখেছেন। পরোক্ষভাবে তিনি নিজ গ্রন্থে দুইবার তার নাম উল্লেখ করার পরেও তার জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে বলেন নি। হয়তোবা তার কারণ হচ্ছে, তার এ সম্পর্কে বলতে হলে এ কথাও বলতে হবে, তিনি হলেন ওই ব্যক্তি, যিনি কথিত আব্দুল মাসীহ আল-কিনদীর কিতাবের জবাব লিখেছিলেন।
[18] এটি ১৩০৬ হিজরিতে লাহোরে মুদ্রিত হয়েছিল, তারপর এটি ১৪০৮ হিজরিতে মোতাবেক ১৯৮৭ খৃষ্টাব্দে কায়রোতে মুদ্রিত হয়েছিল, যা শাইখ আহমেদ হিজাজি আল-সাক্কার তাহকীক ও পাদটীকা সহকারে এসেছিল।
Comment